সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: “আমাদের দেশে বিনামূল্যে রেউড়ি (উত্তর ভারতে জনপ্রিয় গুড়ের মিষ্টি) বিতরণ করে ভোট সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই রেউড়ি সংস্কৃতি দেশের উন্নয়নের জন্য খুবই বিপজ্জনক। দেশের জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজকে এই রেউড়ি সংস্কৃতি থেকে সতর্ক
থাকতে হবে।”
১৭ জুলাই, ২০২২। রাজনৈতিক অভিধানে নতুন শব্দ যুক্ত করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি– ‘রেউড়ি রাজনীতি’। স্বাভাবিকভাবেই মোদির আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বিরোধী দলগুলি, যারা নিজ নিজ রাজ্যে সামাজিক প্রকল্পে জনতাকে নগদ অর্থ প্রদান করে থাকে।
[আরও পড়ুন: RBI থেকে উধাও ৮০০ কোটি, তদন্তে সাতসকালে কলকাতায় সিবিআই তল্লাশি]
২০২৩-এর ডিসেম্বর। আরেকটা লোকসভা নির্বাচনের আগে মধ্যপ্রদেশের (Madhya Pradesh) বিধানসভা ভোটে তাঁর দল বিজেপির (BJP) ক্ষমতায় টিকে থাকতে ‘সহায়’ হল সেই রেউড়িই। ‘লাডলি বহেন যোজনা’য় মহিলাদের মাসিক এক হাজার টাকার বদলে তিন হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। কন্যাসন্তানকে দু’লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য, উজ্জ্বলা ও লাডলি বহেন যোজনার আওতায় থাকা পরিবারকে ৪৫০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার। একের পর এক মহিলামুখী প্রকল্প। ভোটপ্রচারের মঞ্চ থেকে একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন গেরুয়া শিবিরের নেতারা। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, এই বিধানসভা নির্বাচনে মধ্যপ্রদেশে বিজেপির বিপুল ভোট পাওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের এই ঢালাও মহিলামুখী প্রকল্প এবং প্রতিশ্রুতি।
একাধিক বুথ ফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস মিলিয়ে সেখানে ক্ষমতায় ফিরছে বিজেপি। বিধানসভার ২৩০ আসনের মধ্যে ১৬৪ আসনে জিতেছে তারা। কংগ্রেস আটকে গিয়েছে ৬৫টিতে। কয়েকটি বুথ ফেরত সমীক্ষায় স্পষ্ট ভোট-ফলের এই প্রবণতারই ইঙ্গিত ছিল। বলা হয়েছিল, মহিলাদের ভোটের ক্ষেত্রে বিজেপি কংগ্রেসের তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশে এগিয়ে থাকতে পারে। মধ্যপ্রদেশে বিজেপির প্রাপ্ত মোট ভোটের ৪৪ শতংশই আসতে পারে মহিলা ভোটারদের কাছ থেকে৷ ফল বলছে তা মিলতে চলেছে। কংগ্রেস ভোটের আগে টাকা বিতরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, তাতে বরং রাজ্যের জনতা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
[আরও পড়ুন: ছিল টাকা, হয়ে গেল ডলার! চিরকুট কোডেই বহু কোটি পাচার বিদেশে]
শুধু মহিলাদের জন্যই নয়, বিজেপির ভোট-প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল– গরিব পরিবারকে আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশন, কৃষিপণ্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) বৃদ্ধি ছাড়াও কৃষক সম্মাননিধি প্রকল্পে প্রত্যেক কৃষককে ১২ হাজার টাকা সাহায্যের কথা। তারই স্রোতে ভর করে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া অতিক্রম করলেন ‘মামা’ শিবরাজ সিং চৌহান। পিছনে ঠেলে দিলেন ভোটের প্রচারে কংগ্রেসের তোলা দুর্নীতি, কর্মসংস্থানের অভাব, কৃষকদের ফসলের দাম না পাওয়ার মতো বিষয়গুলিকে।
ভোটের ফল স্পষ্ট হতেই শিবরাজ সিং চৌহান বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর স্ট্র্যাটেজি এবং জনমুখী প্রকল্পের জন্যই তাঁদের এই জয় এসেছে৷ আর হ্যাঁ, বহেন নে সাথ দিয়া.. (বোনেরাও পাশে থেকেছেন)।” অর্থাৎ, বিপুল মহিলা ভোটও যে তাঁদের এই জয়ের অন্যতম কারণ, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী মোদি দেশের রাজনৈতিক অভিধানে যে ‘রেউড়ি’ শব্দটি তুলে এনেছিলেন, মধ্যপ্রদেশে তাতে ভর করেই মুখরক্ষা হল বিজেপির। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাঁচ রাজ্যের ভোট রীতিমতো উদ্বেগ বাড়িয়েছিল মোদি-শাহ ব্রিগেডে। এই সেমিফাইনালে ভরাডুবি হলে ফাইনাল, অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচনে কী হবে, সেটাই ছিল বিজেপির অন্দরে মূল প্রশ্ন। কংগ্রেস পাঁচ রাজ্যে একের পর এক সামাজিক কল্যাণ প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করলে বেকায়দায় পড়ে বিজেপির রাজ্য ইউনিটগুলি।
কারণ, মোদি নিজেই ‘রেউড়ি রাজনীতি’র বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন বিরোধীদের ঠেকাতে। ফলে রাজ্যনেতাদের ‘রেউড়ি বিলির’ ঢালাও ছাড়পত্র দিয়ে দেয় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাতেই ফল মিলল মধ্যপ্রদেশে। যেখানে চার বছর আগে কংগ্রেস সরকারকে উৎখাত করে ‘অপারেশন লোটাস’-এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিল বিজেপি।