স্টাফ রিপোর্টার: বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Justice Abhijit Gangopadhyay) সাক্ষাৎকার দেওয়া ও তা সম্প্রচারের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিল না কলকাতা হাই কোর্ট (Calcutta High Court)। বস্তুত সোমবার রাতে ওই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সম্প্রচার হওয়ার পর জনমানসে জোর চর্চা শুরু হয়েছে, আদৌ একজন বিচারপতি কর্মরত অবস্থায় এভাবে টিভি চ্যানেলে তাঁরই এজলাসে চলা বিচারাধীন মামলা নিয়ে এমন মন্তব্য করতে পারেন কি না?
কলকাতা হাই কোর্টের একাধিক প্রবীণ আইনজীবী মন্তব্য করেছেন, ‘‘স্বাধীনতার পর কখনওই সংবাদমাধ্যমে সরাসরি মুখ খুলে কোনও বিচারপতি এমন নজির গড়েননি। এরপর যদি বিচারপ্রার্থীরা বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুখ খোলে, তখন কী হবে?’’ হাই কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অরুণাভ ঘোষের দাবি, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ও গাইডলাইন অনুযায়ী একজন কর্মরত বিচারপতি এভাবে সংবাদমাধ্যমে ইন্টারভিউ দিতে পারেন না।’’ রাজ্যসভার বামপন্থী সাংসদ তথা প্রবীণ আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যর বক্তব্য, ‘‘কর্মরত বিচারপতি ইন্টারভিউ দিতে পারেন কি না, তা যুক্তিসাপেক্ষ।’’
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘‘এটা নিয়ে এখন কিছু বলছি না।’’ হাই কোর্ট বারের সহ-সভাপতি কল্লোল মণ্ডল বলেন, ‘‘কোনও বিচারপতি যদি সমাজের ভাল নিয়ে মন্তব্য করেন, তাহলে খারাপ কিছু নয়। কিন্তু, যদি বিতর্কিত মন্তব্য করেন, খারাপ কিছু বলেন, যাতে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে অবশ্যই নিন্দনীয়।’’
যদিও সাক্ষাৎকারের সময় স্বয়ং বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘‘বেঙ্গালুরু প্রোটোকলের মধ্যে থেকেই আমি এই ইন্টারভিউ দিচ্ছি। বিচারপতিরা
কী করতে পারেন, তার রূপরেখা রয়েছে এখানে। এই প্রোটোকলেই বলা আছে বিচারপতিদেরও বাক স্বাধীনতা আছে। আর আমি বিচারব্যবস্থা নিয়ে কিছু বলছি না। রাজনৈতিক কোনও কথাও বলছি না।’’
[আরও পড়ুন: নবান্ন অভিযানে জখম এসিপিকে দেখতে হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশ কর্তার দ্রুত আরোগ্য কামনা]
এবিপি আনন্দ টিভি চ্যানেলে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়ে আদালতে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলায় হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ স্থগিতাদেশ না দিলেও পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। জানিয়েছে, ‘‘ডিভিশন বেঞ্চ আশা রাখবে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সমাজের একটি বৃহৎ অংশের মানুষের স্বার্থে জড়িত রয়েছেন। তাই সম্প্রচার মাধ্যমে তিনি এমন কোনও বক্তব্য রাখবেন না, বা কিছু বলবেন না, বা বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যমও সেটা দেখাবে না, যাতে আদালতের সম্মান নষ্ট হয়।’’
আদালতের প্রথমার্থে হাই কোর্টের একজন কর্মরত বিচারপতির সাক্ষাৎকার দেওয়ার বিরোধিতায় প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন হাই কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য আইনজীবী অচিন্ত্য বন্দোপাধ্যায়। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেয় আদালত। তার প্রেক্ষিতে আদালতের দ্বিতীয়ার্ধে মামলার শুনানি হয়। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল সৌমেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় জানান, এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সম্মানের প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে।
১৯৯৭ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ও গাইড লাইন অনুযায়ী এবং ‘ফুল কোর্ট মিটিং’-এ এই সিদ্ধান্ত রয়েছে। এখানে শুধুমাত্র একজন বিচারপতির সম্মানই জড়িত রয়েছে তা নয়, তাঁর সঙ্গে গোটা প্রতিষ্ঠানের সম্মানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। তিনি আরও দাবি করেন, ‘‘২০১৮ সালে ৪ জন বিচারপতি প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন। কিন্তু এখানে একজন বিচারপতি একটি নির্দিষ্ট বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। যা নিয়ম বিরুদ্ধ।’’
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় কিছুতেই এমন সাক্ষাৎকার দিতে পারেন না বলে দাবি করে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের তথ্য উল্লেখ করেন তিনি। আদালতে বলেন, ‘‘১৯৯৭ সুপ্রিম কোর্টের ‘ফুল কোর্ট মিটিং’-এ পরিষ্কার বলা হয়েছে একজন বিচারপতির কোনও পাবলিক ডিবেট-এ অংশ নেওয়া উচিত নয়। তার কোনও রাজনৈতিক এবং ভবিষ্যতে বিচার্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বা বিচারাধীন এমন কোনও বিষয়ে বক্তব্য রাখা উচিত নয়। একজন বিচারপতির বক্তব্যই তাঁর নির্দেশ, রায়। তাই কোনও সংবাদ মাধ্যমে তাঁর সাক্ষাৎকার দেওয়া উচিত নয়।’’
অচিন্ত্য বন্দোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘প্রত্যেকেরই সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। আমরা প্রতিষ্ঠানের সম্মান হানি হতে দিতে পারি না। এনিয়ে সুপ্রিম কোর্টের একাধিক নির্দেশ বা রায় রয়েছে। এখানে যিনি সঞ্চালক, তাঁর সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত ক্লিপ দেখে বোঝা যাচ্ছে ইন্টারভিউয়ের বিষয়বস্তু কী হতে চলেছে।’’ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের আইনজীবী রত্নাংক বন্দ্যোপাধ্যায় পালটা দাবি করেন, ‘‘অনুমানের ভিত্তিতে এই মামলা করা হয়েছে। সাক্ষাৎকারের বিষয়বস্তু কী হবে তা নিয়ে শুধু অনুমান করা হচ্ছে। এটা একজন বিচারপতির ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ’ এর প্রশ্ন। সেই স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের মতো একজন বিচারপতিরও রয়েছে। যে বিচারপতি সাক্ষাৎকার দিতে যাচ্ছেন তিনি নিশ্চয়ই সাক্ষাৎকার দেওয়ার ক্ষেত্রে কী প্রোটোকল রয়েছে তা জানেন। এটা তার ব্যক্তিগত পচ্ছন্দের বিষয়।’’ তাঁর আরও দাবি, এখানে যে বিচারপতিকে নিয়ে আপত্তি তাঁকে এই মামলাতে পক্ষভুক্ত করা হয়নি।