'খুব কম মানুষ আমাকে শিল্পী হিসাবে চেনেন', 'লহ গৌরাঙ্গের নাম রে' মুক্তির সময় একান্ত আলাপচারিতায় ব্রাত্য বসু। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের মতো আইকনিক চরিত্র, এই জন্যই কী ‘লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’ ছবিতে একেবারেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন?
...সৃজিতের ছবিতে আমি অভিনয় করতে চাইছিলাম। ‘রাজকাহিনী’ করতে বলেছিল, করতে পারিনি ব্যস্ততার কারণে। আর এবারে ব্যস্ততা থাকলেও দ্বিতীয় কারণ গিরিশচন্দ্র ঘোষ। গিরিশচন্দ্র ঘোষকে নিয়ে আমি উপন্যাস লিখেছি, তাঁকে নিয়ে বই সম্পাদনা করেছি, খুব ডিটেলে স্টাডি করেছি। তাই মনে হয়েছিল এই পার্টটা করতে পারলে আমার ভালো লাগবে। প্রাথমিক ট্রিগার যদি বলো, তা হলে সৃজিত।
আপনার কি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবির ধরন ভালো লাগে বা রেগুলারলি ফলো করেন?
...সব ছবি দেখেছি তা নয়। ‘অটোগ্রাফ’, ‘গুমনামী’-সহ অনেক ছবিই দেখেছি। অভিনেতা হিসেবে আমার মনে হয়েছে, ওর ছবির চরিত্রদের সংলাপে এক ধরনের লিরিক আছে। সেই লিরিক যে সব অ্যাক্টর ধরতে পারে বলে আমি মনে করি না। আমার মনে হয়েছিল এই চ্যালেঞ্জটা নেব না কেন?
ওঁর ছবির সংলাপ খুব ড্রামাটিকও!
...খুব ড্রামাটিক, খুব লিরিকাল। অভিনেতা হিসেবে সে।। আকৃষ্ট করেছে।
কিন্তু আপনার মনে হয় না সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের চরিত্ররা যেভাবে কথা বলে, ততটা লিরিকালভাবে সাধারণত আমরা কথা বলি না?
...না, কিন্তু তুমি যদি শম্ভু মিত্র দেখো বা অজিতেশের সাক্ষাৎকার ফিরে গিয়ে পড়ো বা উৎপল দত্তর কোনও কোনও কথাবার্তা শোনো তাহলে এই লিরিকাল কোয়ালিটি পাবে। আমি যেটা বলতে চাইছি, সিনেমার যে এলিমেন্ট আছে, সেটা হল কর্ণের রথ, যেখানে চাকা মাটির মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। আর থিয়েটারের মানুষদের কথাবার্তার চলটা হল যুধিষ্ঠিরের রথের মতো, মাটি থেকে দু-আঙুল উপরে উঠে আছে। থিয়েটার ব্যাপারটা স্বভাববাদী নয়, বিমূর্ত। যেখানে বিমূর্তের আগমন সেখানে কাব্য স্বাভাবিকভাবেই প্রবেশ করবে। সৃজিতের ছবিতে সেটা আমি অনেকবার লক্ষ্য করেছি। যেহেতু গিরিশ ঘোষকে আপনার এতটা জানা এবং বোঝা রয়েছে, একটা দৃষ্টিভঙ্গি অলরেডি তৈরি হয়ে রয়েছে। সৃজিতের
ছবির চিত্রনাট্যের সঙ্গে এই ভাবনার কতটা মিল বা অমিল রয়েছে?
...আমার মনে হয় ব্যাপারটা এক। কারণ যে স্ক্রিপ্টটা নিয়ে রিসার্চ করেছে, সেখানে গিরিশ ঘোষের চরিত্রটা অনেকটাই আমার উপন্যাস দ্বারা অনুপ্রাণিত। যে গিরিশকে এখানে দেখানো হয়েছে, ১৮৮৪ সালের গিরিশ। ১৮৯০ সালের যে গিরিশকে আমরা দেখতে পাব সে তখন পরিত্যক্ত, ছন্নছাড়া। ১৮৮৩-তে রামকৃষ্ণ আসছেন, চৈতন্যলীলা দেখতে। তারপর বেশিদিন বিনোদিনী কনটিনিউ করছে না। এই ছবির অংশে যেটা আছে, রামকৃষ্ণ সম্পর্কে গিরিশ ঘোষ তখনও সন্দিহান। তার পুত্রসন্তান তখনও বেঁচে। এই সময় ও খুবই ‘সিনিক’, ‘স্লাইমি’। সে বেনে, অর্থাৎ ট্রেডার। তীক্ষ্ণ পলিটিশিয়ান। থিয়েটারের যে পলিটিক্স! একই সঙ্গে যে ভাষাটা নিয়ে আসছে, ভাঙা অমিত্রাক্ষর, সেটা পরে গৈরিশ ছন্দ বলে চিহ্নিত হচ্ছে। সেটাকে বাংলা স্টেজে ইনট্রোডিউস করছে। সেটা স্বভাববাদী অভিনয় মানে অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফিদের অভিনয়কে শুইয়ে দিয়েছে। যাত্রাধর্মী অভিনয় নিয়ে আসছে। আমার মনে হয় গিরিশধর্মী অভিনয় বেশি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, যদিও আমি নিজে অর্ধেন্দু শেখর ধারার অভিনেতা। এই দুটোর কলিশনটা অ্যাক্টর এবং ক্রিয়েটর হিসেবে আমার মধ্যে ছিল এবং সৃজিত এই ছবিতে সেটা ভালো ধরেছে।
কিন্তু আপনাকে যখন পর্দায় দেখব, গিরিশ ঘোষের চরিত্রে, কী দেখব? তার কর্মকাণ্ড আমরা জানি, কিন্তু লোকটা কেমন?
...সে ক্যারিশম্যাটিক, একই সঙ্গে সিনিকাল। ওর প্রিয় ছাত্ররা যাদের সঙ্গে ও অভিনয় করছে, আর ছ’বছরের মধ্যে ওঁকে ওরা ঠকাবে। কিন্তু ওটাই ওর জীবনের কর্মা। ও বিনোদিনীর সঙ্গে যা করেছিল সেটা ওর জীবনের ডেবিট-ক্রেডিট– এটা এই জীবনেই ওকে মেটাতে হবে। একই সঙ্গে সে একজন ভাগ্য বিড়ম্বিত লোক। সে প্রোডিউসারদের থেকে যে সহৃদয়তা এবং আনুকুল্য আশা করছে, বারবার যাচনা করছে, কিন্তু পাচ্ছে না। তাহলে এই বঙ্গসমাজের সংস্কৃতির যে ধারণা এবং ভান, সংস্কৃতির উল্লাস এবং প্রতারণা– এই দুটোই গিরিশচন্দ্রের মধ্যে কতটা এসেছে, অভিনেতা হিসেবে সেটা ফুটিয়ে তোলা আমার কাজ ছিল। কতটা পেরেছি আমি জানি না।
বিনোদিনীর সঙ্গে সম্পর্কে একটা পাওয়ার পলিটিক্স ছিল!
...ভীষণভাবে পেট্রিয়ার্কাল সম্পর্ক। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি মিশে আছে। বিনোদিনীর সঙ্গে তিনি একরকম প্রতারণাই করেছিলেন। গিরিশের মধ্যে নানান লেয়ার আছে। প্রতারণা, আবার একই সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস।
আপনি গিরিশ ঘোষের সঙ্গে সিমপ্যাথাইজ করেন?
...হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। উনি ১৯১২-তে মারা যাচ্ছেন। এবং সেই চলে যাওয়া পরিত্যক্ত, ছন্নছাড়া, নিঃসঙ্গ। সব থিয়েটার থেকেই তিনি সরে গিয়েছেন। ছবিতে এতটা নেই। সাল উল্লেখ না হলেও মূলত ১৮৮২ থেকে ১৮৮৪ সাল ধরা পড়েছে। এবং বিনোদিনীর সঙ্গে নাট্যাচার্য এবং শিষ্যার যে সম্পর্ক, সেইটুকুই আছে।
কিন্তু এতটা জানা এবং বোঝা, এই যে এত কমপ্লেক্সিটি সেটা অভিনয়ে আনতে চাননি?
...সৃজিত যে ভাবে দেখতে চেয়েছে, আমি তার বাইরে ইন্টারপ্রিট করতে চাইনি।
ছবি: অপ্রতিম পাল
তার মানে আপনি ডিরেক্টর’স অ্যাক্টর?
...আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট ডিরেক্টর’স অ্যাক্টর। তবে সাজেশন দিতে পারি।
আপনার অভিনীত কিছু চরিত্র, যেগুলো কেন্দ্রীয় চরিত্র না হয়েও খুব স্মরণীয়। এবং সেটা লেখার কারণে হোক বা আপনার অভিনয়ের কারণে– দেখলে মনে হয় যতটা দেখা যায় তার চেয়ে বেশি অনুভূত হয়। চরিত্রের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবটা অনুভব করা যায়। যেমন ‘মায়ানগর’, ‘মায়ার জঞ্জাল’ বা ‘অসমাপ্ত’ ছবিতে। এমন চরিত্র আরও বেশি হয় না কেন?
...সেটা তো পরিচালকরা বলতে পারবেন। আমার ‘বারান্দা’, ‘বহমান’ করেও খুব ভালো লেগেছে। রিসেন্টলি করলাম ‘কর্পূর’। সেটা করেও দারুণ লাগল। তবে গিরিশ ঘোষকে নিয়ে একটু টেনশনে আছি। লোকের কেমন লাগবে.....
সৃজিত কোনও ইনপুট দিয়েছিলেন?
...না, তেমন একটা না। খালি ‘ক্যারিশ্মা’ শব্দটা বলেছিল। আমরা সেটা রিহার্সাল দিয়েছিলাম। সেখানে ও ওই নাইনটিনথ সেঞ্চুরির যে গমগমে বিষয়টা যেটা প্রায় গৈরিশ ছন্দধর্মী অভিনয়, সেটা চেয়েছিল। সত্যি বলতে কী, সেটা আমার প্রথম দিকে পছন্দ হচ্ছিল না কারণ আমি নিজে ওই স্টাইল পছন্দ করি না। তো আমি চতুর্থ রিহার্সালে অ্যাডাপ্ট করলাম। কারণ পরিচালক যেটা চাইছে সেটা দিতে হবে।
এমন সমঝোতা করলে নিজের অভিনয় নিয়ে খুঁতখুঁত করে না?
...না না, আমি মনে করি আর্ট মানে ইন্টারপ্রিটেশন। এটা পরিচালকের মাধ্যম। আমি তো একটা গ্যাজেট মাত্র। আমরা সে অর্থে সবাই সমঝোতাবাদী, সবাই কনফর্মিস্ট, এখানে সমঝোতাটা শিল্পের
স্বার্থেই হচ্ছে।
‘হুব্বা’-র পর ‘শেকড়’ পরিচালনা করলেন। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। পরিচালনার ক্ষেত্রে কীভাবে বিষয় নির্বাচন করেন?
...আমি ‘হেমলাট’ করেছি, তার থেকে ‘রুদ্ধসংগীত’ একেবারে আলাদা। যখন ‘বোমা’ করছি তার থেকে ‘মুম্বই নাইটস’ বা ‘অদ্য শেষ রজনী’ একেবারে আলাদা। আসলে আমি পর্বতোরোহীর মতো বিভিন্ন পাহাড়চূড়োয় পৌঁছতে চাই। কোনও ট্রেক-এ হয়তো এভারেস্টের মতো একটা রুট আছে। কোনওটায় হয়তো কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো রুট নেই। কিন্তু দুটোই দেখতে চাই।
তার মানে আপনি খুবই অ্যাম্বিশ্বাস!
...শিল্পের ক্ষেত্রে আমি মূলত নিজেকে একজন ডন কিহোতে বলে মনে করি।
নিজেকে মনে করেন, না ডন কিহোতে হতে চান?
...শিল্পের ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে আমি ডন কিহোতে হয়ে যাই। তফাত হচ্ছে আমার সঙ্গে কোনও সাঞ্চো পাঞ্জাও থাকে না।
গিরিশ ঘোষের মধ্যে ম্যানুপুলেশন, রাজনীতি সবটাই আছে। নিজেকে কতটা রিলেট করলেন?
...আবার কোথাও একজন শিল্পী বা একজন ব্যবসায়ী। তিনটেই আমি। থিয়েটার যখন করি, ব্যবসায়ীর মতোই সব দিক দেখে নিই। আমিও সেখানে খানিকটা ব্রাত্য বাজোরিয়া কি কাজোরিয়া (হাসি)! কম টাকার লগ্নি, কিন্তু যেহেতু আমি কোনও গ্রান্ট নিই না, আমাকে হিসেব করতে হয় ব্রেক ইভেনে যেতে পারব কি! পলিটিক্স করি যখন, তখন আমার মধ্যে খানিকটা পলিটিক্স তো আছেই।
খানিকটা...
...হ্যাঁ, মানে ওই আর কী! আর আর্টিস্টও আমি নিজেকে কম বেশি মনে করি। অবিমিশ্র আর্টের সাধনা মানে এখন তানসেনের সময়টা নেই। তানসেনের একজন আকবর ছিল। ভার্জিল হতে গেলে একজন সিজার দরকার হয়। এখন তোমাকেই সিজার হতে হবে, তোমাকেই ভার্জিল হতে হবে।
আপনি সব সময় নিজেকে আগে অভিনেতা পরে নেতা বলে দাবি করেন? এটা কেন? ‘নেতা’-র যে সেলফ সেটা বেশির ভাগ সময় বেশি ফুটেজ নিয়ে নেয়, তাই ‘অভিনেতা’-র হয়ে গলা ফাটাতে হয়?
...না, না, তা নয় একেবারেই। আমাকে অনেকেই নাট্যকার বলেন, কিন্তু আমার প্রাইমারি ইনসটিংক্ট
হচ্ছে একজন অভিনেতার। আমি অমিতাভ বচ্চনের থিওরিতে বিশ্বাস করি। তিনি মনে করেন বেশির ভাগ ডিরেক্টর হচ্ছে ফ্রাসট্রেটেড অ্যাক্টর। আমার মনে হয় যাঁরা আমাকে রাজনীতির লোক বা মন্ত্রী হিসেবে চেনেন সেটা অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ। আর আর্টিস্ট হিসেবে চেনে খুব কম মানুষ। আর এই মানুষগুলোকে আমি খুব ভরসা করি, এই কম সংখ্যক মানুষদের আমি হারাতে চাই না। একটা উদ্বেগ এবং উচ্ছ্বাস দু-ই কাজ করে।
আর ভয়?
...না, ভয় লাগে না, কারণ আমি আমার আর্টকে বিশ্বাস করি।
