শম্পালী মৌলিক: এ ছবির ট্রেলার যখন বেরয় তখন থেকেই মনে একটা ধাক্কা লেগেছিল। ছবি দেখতে গিয়ে বুঝলাম থ্রিলারের শরীরে শুধু খুন-জখম-রক্তের দাগ নয়, মনের প্রান্তর এফোড়-ওফোড় করে দেওয়ার মতন দৃশ্যকল্প এবং সংলাপ। যে লেখে, সে ছবি তো দেখতে পায়, সেই দেখা সিনেমার পর্দায় ট্রান্সফর্ম করাটা সবসময় মসৃণ হয় না। প্রতিম ডি গুপ্ত ‘চালচিত্র’ ছবিতে সেটা পেরেছেন।
শুরু থেকেই জানতাম চারজন পুলিশ এবং একজন সিরিয়াল কিলার ছবির কেন্দ্রে। বিশ্বক মুখোপাধ্যায়ের ‘কেদার ফাইল্স’ বই থেকে পরিচালক পুলিশের কর্মজগতের ধারণা পেয়েছেন খানিকটা, বাকি কাহিনি প্রতিম নিজস্ব মুন্সিয়ানায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিদেশি থ্রিলারের ছায়া থাকলেও ‘চালচিত্র’-র অন্তরাত্মা দেশজ, অথচ সব প্রান্তের সিনেমাপ্রেমীকে ছুঁয়ে যাবে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম দেখে অভ্যস্ত এখনকার দর্শক অনেক সময় আগে থেকে সিরিয়াল কিলিংয়ের মোটিভ আন্দাজ করে নিতে পারে। সেখানে এই ধরনের ছবি বানানো শক্ত। নির্দিষ্ট ব্যক্তির মনোজগতে এমন কোনও ক্ষত থাকে যা তাকে হিংস্রতার দিকে এগিয়ে দেয় লাগাতার। এ ছবিতেও তা ঘটেছে, চলচ্চিত্রায়ন চমৎকার। আমার কাছে সিনেমা মানে শুধুই প্রযুক্তির আস্ফালন নয়, সিনেমা মানে সেই কল্পজগৎ তৈরি করা, যেখানে ভালোবাসার রামধনু, চোখের জলের দাগ, প্রতিশোধের আগুন ছাপ রেখে যাবে এমন, হল থেকে বেরলেও মাথায় ঘুরবে দৃশ্যগুলো, শব্দরা গেঁথে যাবে মস্তিষ্কের অন্দরে। তাই ‘আমরা মৃত্যুকে এড়ানোর চেষ্টা করি ভালোবেসে, প্রার্থনা করে, যুদ্ধ করে, খুন করে’–জিয়াউল ফারুক অপূর্বর মুখে যখনই এই সংলাপ শুনি, তারপর এই লেখা লিখতে গিয়েও অনুরণিত হয়। এখানেই সিনেমার সাফল্য।
গল্পটা কেমন? থ্রিলার ছবি হলেও, একটু বলতেই হয়। এই শহরে এমন এক খুনির আবির্ভাব হয় যে পর পর হত্যা সংঘটিত করে চলেছে নিপুণ কায়দায়। প্রথম দৃশ্য থেকেই সেই নৃশংসতার আঁচ পাওয়া যায়। খুনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছে কিন্তু ধরনটা এক। এই সাংঘাতিক লোকটাকে ধরতে সিপি কনিষ্ক চট্টোপাধ্যায়ের (টোটা রায়চৌধুরি) নেতৃত্বে শহরের পুলিশ লড়ছে। যে দলে রয়েছে নাসির রহমান (অনির্বাণ চক্রবর্তী), রীতেশ কুমার (শান্তনু মহেশ্বরী), বিশ্বরূপ অধিকারী (ইন্দ্রজিৎ বসু)। অনভিজ্ঞ রীতেশ আর বিশ্বর কাছে খুনের নৃশংসতা অভিনব হলেও পোড়খাওয়া নাসির আর কনিষ্কর কাছে নতুন নয়। তাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল বারো বছর আগের সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনা। সেই খুনিও একলা মেয়েকে টার্গেট করত, আর খুনের পর লাল পাড় সাদা শাড়িতে সাজিয়ে চালচিত্র ফ্রেমে ঝুলিয়ে রেখে যেত। দুটোর মিল-অমিল খুঁজতে কনিষ্করা নাজেহাল হতে থাকে। তার মুখে, ‘যারা ভালো রাঁধুনি প্রতিশোধের ব্যাঞ্জন ঠান্ডাই পরিবেশন করে থাকেন’–রহস্যের দিকে খানিক আলোকপাত করে। দুরন্ত সব সংলাপ লিখেছেন পরিচালক। এই জট ছাড়াতে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি এক ব্যক্তির (ব্রাত্য বসু) দ্বারস্থ হয় পুলিশ টিম। তারপর জট ছাড়াতে ছাড়াতে এগোয় এই মনস্তাত্বিক ‘হু ডান ইট’। দারুণ স্মার্ট মেকিং। পুলিশের কাজের পাশাপাশি তাদের পারিবারিক জীবনটা এমন বুনেছেন প্রতিম, একটা অন্যটার থেকে আলাদা করা যায় না। কনিষ্কর নিজস্ব মানসিক জটিলতা, স্ত্রীর সঙ্গে শীতল হয়ে আসা সম্পর্ক, আদ্যন্ত রিয়েল। নাসিরের নিজস্ব যুদ্ধ রয়েছে তার আটিস্টিক মেয়ে পুতুলকে (তানিকা বসু) নিয়ে। রীতেশ চিরকালের ফার্স্টবয় কিন্তু এসে পড়েছে পুলিশের কঠোর জগতে, তার ওপর সে অবাঙালি এসে পড়েছে তিন বাঙালির মাঝে। সেই সঙ্গে তার প্রেমে পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষা। পূরবী (স্বস্তিকা দত্ত) তার বড় আস্থার জায়গা। অন্যদিকে বিশ্ব ডাকাবুকো, মাথার চেয়ে হাত চলে বেশি। তদন্তের কাজের সমান্তরালে সে দিনশেষে আশ্রয় খোঁজে এক দেহোপজিবীনির কাছে (প্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়)। গল্পে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় কনিষ্কর কেরিয়ারগ্রাফের একটা ব্যর্থতা। বাংলা দেশের স্টার অপূর্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্রে। যখন বলেন– ‘বাঁ দিক আর ডানদিক যদি না মেলে... কষতে থাকো’, সঙ্গে ওই অট্টহাসি, স্রেফ ঘুম উড়িয়ে দেয়। তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স এমনই চোখ সরানো যায় না। থ্রিলার যত ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোয় আগ্রহ চেপে বসে। খুনিকে ধরার পর্বটা প্রেক্ষাগৃহে দেখাই ভালো। প্রত্যেকটা চরিত্র নির্মাণ এত যত্ন নিয়ে করা হয়েছে, এতটুকু অবিশ্বাস্য লাগে না।
Advertisement
এবার আসি অভিনয় প্রসঙ্গে। টোটা রায়চৌধুরি প্রায় ‘আনবিটেবল’ এই মুহূর্তে। তিনি ছাড়া ‘কনিষ্ক’ ভাবা যেত না। অনির্বাণ চক্রবর্তী ‘মিস্টার ডিপেন্ডবল’, যেকোনও চরিত্র তিনি বের করে দিচ্ছেন অনায়াস দক্ষতায়। তাঁর ‘নাসির’ মনে থেকে যাবে। নবাগত ইন্দ্রজিৎও খুব ভালো। শান্তনু মহেশ্বরী পাশের বাড়ির ছেলে হলেও তার ক্যারিশমা আলাদা। নারীচরিত্রদের স্ক্রিন টাইম কম হলেও গুরুত্ব কম নয়। স্বস্তিকা দত্ত চোখে কথা বলেন। তাঁকে শুধু সুন্দর দেখতে লেগেছে বললে, তাঁর কাজকে খাটো করা হয়, চরিত্রের প্রত্যেকটা স্তরে তিনি অভিনয়ে প্রাঞ্জল। প্রিয়া বাংলা ছবিতে প্রথমবার, কিন্তু নজরকাড়া। তানিকা বসু প্রথমদিন থেকেই অনবদ্য কাজ করেন। এই ছবিতে তিনি সব ওভারে বাউন্ডারি মারলেন। এককথায় ব্রিলিয়ান্ট তানিকা। রাইমা তাঁর স্নিগ্ধতা দিয়ে চরিত্রের চাহিদা মিটিয়েছেন সুন্দর। স্বল্প পরিসরে ভালো লাগে অনিন্দিতা বোসকেও। আলাদা করে বলতে হয়, ব্রাত্য বসুর কথা। মাস্টারস্ট্রোক কীভাবে আসে দু’-তিনটে সিনেও, তাঁর কাছে শিখতে হয়। ছোট্ট চরিত্রে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় যথাযথ। আর শেষভাগে গানের দৃশ্যে লহমা ভট্টাচার্য চিনির মতো মিষ্টি! তুর্যা ঘোষ-এর ক্যামেরা এবং দেবজ্যোতি মিশ্রর মিউজিক দুরন্ত থ্রিলারকে পূর্ণতা দিয়েছে। ‘চালচিত্র’ মাস্ট ওয়াচ।