shono
Advertisement
Re-release of Nayak

বড়পর্দায় কেমন ছিল উত্তম ম্যাজিক? নস্ট্যালজিয়ায় শান দিতে প্রেক্ষাগৃহে বাঙালির বর্তমান প্রজন্ম

নায়ক-এর মতো ক্লাসিক নির্মাণের নেপথ্যে শুধু পরিচালক নন, ছিলেন উত্তমের মতো মহানায়কও।
Published By: Sandipta BhanjaPosted: 06:21 PM Feb 24, 2025Updated: 06:28 PM Feb 24, 2025

নির্মল ধর: হিসেব করলে ৫৯ বছর আগে সত্যজিৎ রায়ের চোদ্দ নম্বর ও উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রথম সত্যজিৎ রায়ের ছবি 'নায়ক' মুক্তি পেয়েছিল এই কলকাতা শহরের সিনেমা হলে। আর ডি বনশলের প্রযোজনায় সেই সময়ের অন্যতম হিট ছবি। সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার হাতে পান ছবির নায়ক উত্তমকুমার। পুরস্কৃত হন পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও। এতো বছর বাদে বনশলের তৃতীয় প্রজন্মের বর্ষা বনশল এসে 'নায়ক' ছবির পুনর্মুক্তি ঘটালেন দুদিন আগে ২১ মে। তাঁর হাত ধরেই ছবির নতুন রেস্টোর্ড প্রিন্ট এল।

Advertisement

এখন এই শহরের অন্তত হাফডজন হলে বেশ কিছু দর্শকের উপস্থিতিতে 'নায়ক' চলছে। ষাট বছর আগে দেখা ছবিকে আবার ফিরে দেখার ভালোবাসা এবং চোখটাই অন্যরকম। যেমন ছবির টাইটেল কার্ডটা পুরোটাই দেখানো হয় নায়ক উত্তমকুমারের ব্যাক টু ক্যামেরা মাথার উপর। চুল আঁচড়ে নায়ক মাথা ফেরালে সেটা বোঝা যায়। এই ছবির সঙ্গে শুধু সত্যজিৎ-উত্তম প্রথম কাজ করলেন না, এই সেই ছবি যেখানে মহানায়কের সঙ্গে ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র এবং শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তেরও প্রথম কাজ হল।

এই ছবিতে কম করে ত্রিশবার বিগ ক্লোজআপে উত্তমকুমারকে ধরেছেন সুব্রত মিত্র। প্রত্যেকটাই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। বিশেষ করে সিগারেট খাওয়ার পাঁচটি শট, অদিতির (শর্মিলা) সঙ্গে তিনবার মুখোমুখি হওয়ার মাঝে কাট টু করে সাত/আটটি ক্লোজআপ, না জানিয়ে বাল্যবন্ধু বীরেশ (প্রেমাংশু) নায়ক অরিন্দমকে এক শ্রমিকদের প্রতিবাদ সভায় নিয়ে গেলে গাড়ির মধ্যে অনিচ্ছুক নায়কের দীর্ঘ ক্লোজআপ শটে নিচু স্বরে সংলাপ বলার ধরন বা অভিনয়ে ইচ্ছুক তরুণী প্রমীলার (সুমিতা) সঙ্গে কথা বলার সময় খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিক্ষেপ... এহেন দৃশ্যগুলোয় সুব্রত মিত্র উত্তমকুমারের মুখের শট নিয়ে এক অন্যতম ইমেজ তৈরি করেছেন। অবশ্যই এগুলো ঘটেছে সত্যজিতের অনুমতিতেই। মনে পড়ছিল, স্বপ্নের দৃশ্যে টাকার চোরাবালির মধ্যে নায়কের ডুবে যাওয়ার দৃশ্যটি তুলতে প্রযোজককে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি নিয়েই কয়েক কোটি টাকা ছাপার অনুমতি নিতে হয়েছিল। এবং শুটিংয়ের শেষে ব্যাংকের কর্মীদের উপস্থিতিতে সেই নকল টাকা পুড়িয়ে ফেলতে হয়।

শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত কলকাতা-দিল্লি যাওয়ার সেরা ট্রেন 'ভেস্টবুল এক্সপ্রেস'-এর প্রথম শ্রেণীর একটি কামরা নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওয় বানিয়েছিলেন। ভারতীয় রেল কতৃপক্ষ আসল ট্রেনেই শুটিং করতে অনুরোধ জানিয়েছিল সত্যজিৎকে, কিন্তু ক্যামেরা ও আলোর সংস্থাপন করা যাবে না বলে স্টুডিওর সেটেই কামরার সেট তৈরি হয়। বংশীবাবু নিজে রেলের কামরা দেখতে কারশেডে গিয়ে তখনকার সেরা ট্রেনটির সব খুঁটিনাটির স্যাম্পল নিয়ে আসেন। এবং স্টুডিওয় তৈরি সেটে সেগুলো ব্যবহার করেন। ডিটেইলসের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন বংশীবাবু। এমনকী ছবিতে সাউন্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সচেতন ছিলেন সত্যজিৎ। কামরার মধ্যে চলন্ত ট্রেনের শব্দের ব্যবহার যে কতরকমের হয়, সেটা এই ছবিতে প্রায় নিখুঁত! কামরার মধ্যে, টয়লেটের ভেতর, চলন্ত ট্রেনের দরজা খোলা থাকলে বা করিডোর দিয়ে যাওয়া-আসার সময়ে প্রতিটি দৃশ্যের শব্দ নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে এই ছবিতে। এগুলোতো গেলো ছবির টেকনিক্যাল দিক। নায়ক অরিন্দমের পাড়ার নাট্যদলের অভিনেতা থেকে একটাও ফ্লপ না করা সিনেমার 'দেবতুল্য নায়ক' হয়ে ওঠার দীর্ঘ কাহিনিকে দুটি স্বপ্ন দৃশ্য এবং তিনটি ফ্ল্যাশব্যাকে যেভাবে মসৃণ ভঙ্গিতে পর্দায় এনেছেন, সেটা সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যের অননুকরণীয় এক গুণ বলতেই হয়। নায়ক অরিন্দমের যে কোনও সময় জনপ্রিয়তা হারানোর আশঙ্কা বা প্রবীন অভিনেতার কাছ থেকে ক্যামেরার সামনে প্রথম শুটিংয়ের দিন অপমানিত হওয়ার প্রতিশোধ নেওয়ার দৃশ্যগুলির গঠন ও উপস্থাপনা কত অনায়াস ও সাবলীল এবং সেটা যে আজকের প্রযুক্তির কাছেও কতটা স্বাভাবিক, ভাবলে অবাক লাগে বইকী! সত্যজিৎ রায় নিজে বলতেন, 'চারুলতা' ছবি তাঁর প্রায় নিখুঁত ছবি। আর 'নায়ক' সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল, তাঁর দু-তিনটে ত্রুটি থাকলেও উত্তমের কাজে কোনও খুঁত ছিল না। এতবছর পরে আবার 'নায়ক' দেখার অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দিল কোনও ক্লাসিক নির্মাণের নেপথ্যে শুধু পরিচালক নয়, ছবির অন্যান্য কলাকুশলীদেরও অনিবার্য উপাদান ও অবদান থাকে।

অভিনয়ের কথায় আসা যাক, উত্তমকুমার তাঁর জীবনের সেরা পারফরম্যান্স দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ছবির অন্যান্য শিল্পীরা কেউই উত্তমের থেকে কম যাননি। ভারতী দেবী, নির্মল ঘোষ, প্রেমাংশু বোস, বীরেশ্বর সেন, যমুনা সিংহ, কামু মুখোপাধ্যায়, সোমেন বোস, রঞ্জিত সেন, সুব্রত সেন, মাত্র একটি দৃশ্যে সুমিতা সান্যাল- সকলে এক সুর-তালে অভিনয় করে গিয়েছেন। তবে নজরে পড়েননি সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি আশ্রমিকের পোশাকে সারাক্ষন চুপচাপ পাশের বেডে চুল আঁচড়ে, রাতে মাংস খেয়ে সকালবেলা শুধু একটি সংলাপ বলেন 'এই এসে গেলো...!' এবং আরও দুটি নাম অবশ্যই করতে হয়, অদিতির চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর এবং খবরের কাগজে চিঠি লিখে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা অঘোর চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকায় 'ফোকলা মুখো' জগেশ চট্টোপাধ্যায়। এক কথায় সত্যিই আবিষ্কার! এমন আবিষ্কার এখন আর হয় না কেন জানি না।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত কলকাতা-দিল্লি যাওয়ার সেরা ট্রেন 'ভেস্টবুল এক্সপ্রেস'-এর প্রথম শ্রেণীর একটি কামরা নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওয় বানিয়েছিলেন।
  • নায়কের ডুবে যাওয়ার দৃশ্যটি তুলতে প্রযোজককে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি নিয়েই কয়েক কোটি টাকা ছাপার অনুমতি নিতে হয়েছিল।
Advertisement