কমিক্সের পাতা থেকে রুপোলি পর্দায়! সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'রাপ্পা রায় ও ফুলস্টপ ডট কম' মুক্তি পাচ্ছে আগামী ৫ ডিসেম্বর। এই প্রথম বাংলা কমিক্সের কোনও নায়ক পূর্ণদৈর্ঘ্যের ফিচার ফিল্মে আবির্ভূত হচ্ছে। ধীমান বর্মণ পরিচালিত ও প্রযোজিত ছবিটি মুক্তির ঠিক আগে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের মুখোমুখি রাপ্পার স্রষ্টা সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়। আলাপচারিতায় বিশ্বদীপ দে।
বাংলা কমিক্স নিয়ে সিনেমা! এই প্রথম?
'হাঁদা-ভোঁদা' নিয়ে সিনেমা হয়েছে। কিন্তু সেটাকে ঠিক কমিক্স থেকে হওয়া সিনেমা বলা যায় না। এছাড়া আর কিছু হয়নি বলেই জানি। আসলে কমিক্স যে একটা সিরিয়াস মাধ্যম, সেটা কেউ ভাবেই না এখানে।
রাপ্পা রায়ের স্রষ্টার ছেলেবেলাটা কেমন ছিল? তখনই কি কমিক্স শিল্পী হওয়ার ইচ্ছেটা দানা বেঁধেছিল?
বলতে পারো। ছবি আঁকতাম ছোট থেকেই। কিন্তু আঁকার সময় ছবির সঙ্গে ডায়লগও লিখে দিতাম। যাকে স্পিচ বাবল বলা হয়। কিছু না বুঝেই করতাম। ফলে শুরু থেকেই আমি আসলে কমিক্সই আঁকতে চেয়েছি। স্কুলের দেওয়াল পত্রিকায় কমিক্সের মতো করে গল্প লিখতাম। সবাই পড়ে প্রশংসা করত। আনন্দ পেতাম। অবশ্য এখন বুঝি, বন্ধুরা হয়তো আমাকে খুশি করতেই বলত।
রাপ্পা রায়ের ছবির পোস্টার
ছোটবেলায় কোন কোন কমিক্স আকর্ষণ করত?
আর পাঁচটা বাচ্চার মতো বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা এসব তো ছিলই। মনে পড়ে, 'আজকাল'-এ বেরনো জেমস বন্ডের কথাও। সাদা-কালো কমিক্স। ফিগারিংসগুলো দারুণ লাগত। আমি রীতিমতো দেখে দেখে কপি করতাম। বলা ভালো, চেষ্টা করতাম। সেই সঙ্গে আমার যেটা চোখ টানত, তা হল বিভিন্ন বই বা পত্রপত্রিকায় থাকা অলংকরণ। খুব মনে পড়ে রাশিয়ার ঐতিহাসিক প্রকাশনা সংস্থা 'রাদুগা পাবলিশার্স'-এর বইগুলোর কথা। বাড়িতে এলে হাঁ করে দেখতাম। আসত 'ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক'। সেটাও দারুণ লাগত। এছাড়া আনন্দমেলা-শুকতারাও ছিল। আরও সব পত্রিকা বেরোত। কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান, কিশোর মন... সব খুঁটিয়ে পড়তাম। সেই সঙ্গে ছবিও দেখতাম। ছবির মাধ্যমে গল্পের ন্যারেশনের কীভাবে উত্তরণ হচ্ছে, সেটা দেখে মুগ্ধ হতাম। এভাবেই ক্রমে মাথার মধ্যে কমিক্স আঁকার ইচ্ছেটা জন্ম নিতে থাকে। তখন মোটামুটি সিক্স-সেভেনে পড়ি।
সেই স্বপ্ন নিয়েই আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া...
আমি প্রথমে বাংলা নিয়ে যাদবপুরে ভর্তি হয়েছিলাম। পরে আর্ট কলেজেও ভর্তি হই। একসঙ্গে দুটোই পড়তে থাকি। শেষে অনেকে বলতে লাগল, একসঙ্গে দু'টো পড়া যায় না। জানতে পারলে দুই জায়গা থেকেই নাম বাদ চলে যাবে। তখন ভয় পেয়ে যাদবপুরে যাওয়া বন্ধ করলাম। আর্ট কলেজটাই চালিয়ে গেলাম।
শুরুতেই নিশ্চয়ই কমিক্স আঁকার সুযোগ পাওনি। প্রথমে কি ইলাস্ট্রেশন করতে?
প্রথমে মানে? এখনও করি। আমার ধারণা শেষের দিকেও ওটা করে যেতে হবে (হাসি)। বিদেশে হয়তো কেবল কমিক্স শিল্পী হিসেবেই থাকা যায়। এখানে ছোট বাজার, বিনিয়োগ কম... তাই সেটা সম্ভব নয়। রাপ্পা রায় থেকে কিন্তু আমি যথেষ্ট উপার্জন করি। কিন্তু জিনিসপত্রের দামও তো বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে! ফলে অন্য কাজ করতেই হয়। এতে আখেরে কমিক্সের ক্ষতিই হচ্ছে। আমি জানি আমি যদি আর কিচ্ছু না করে সারা বছর ধরে রাপ্পা রায় নিয়ে কাজ করতে পারতাম, তাহলে কী করতে পারতাম! এটা খুব বেদনাদায়ক। আমার স্বপ্নের রাপ্পা রায় আমি এখনও তৈরি করে উঠতে পারিনি।
স্রষ্টার বাবার তরুণ বয়সই ছাপ ফেলেছে রাপ্পা রায়ের চরিত্রে
রাপ্পা রায়কে পেলে কোথায়?
আমার বাবার তরুণ বয়স ছায়া ফেলেছে চরিত্রটায়। বাবার ২১ বছর বয়সের চেহারাটাই এঁকেছি রাপ্পা হিসেবে। বাবার কথায় একটা স্বভাবসিদ্ধ হিউমার থাকত। এসবই মাথায় রেখে রাপ্পাকে সৃষ্টি করেছি।
বাবা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা?
একদম। আমার বড় হয়ে ওঠার পিছনে বাবার অবদানই সবচেয়ে বেশি। বাবা বারবার বলত, যে কাজটা করছিস তাতে যেন সময়ের ছাপ থাকে। না হলে খুব তাড়াতাড়ি সেটা মুছে যাবে। সেই কথাটা মাথায় রেখে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি আমার সময়ের গল্পটা বলতে।
রাপ্পা রায়কে বাবার মধ্যে পেলে। আর টোনি?
সত্যি বলতে আমি অতটা ভেবে কিছু করিনি। তবে পরে অনেকে বলেছে, ফেলুদার যেমন তোপসে, সেভাবেই আমি রাপ্পার বন্ধু হিসেবে টোনিকে এনেছি। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। শিল্পীদের অনেক রকম অনিশ্চয়তা থাকে। সেটা মাথায় রেখেই আমি টোনিকে সৃষ্টি করি। সে একজন পরিচালক। সব সময় খেয়াল রাখে লোকে তাকে চিনতে পারছে কিনা। চিনতে না পারলে খুব দুঃখ পায়। আসলে আমার নিজের যত হতাশা সেটাই টোনির মধ্যে এসেছে। বলতে পারো আমার সেলফ প্রোজেকশন। কিন্তু সেটাকে আমি অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছি। কেননা মাধ্যমটা কমিক্স।
লেখকের ছেলেবেলা। বাবার সঙ্গে
রাপ্পা রায়ের কমিক্সের আঁকা ও গল্প বলার ধরনে একটা অদ্ভুত মজা আছে। এটা কি প্রথম থেকেই ভেবেচিন্তে করা?
হ্যাঁ। নিজে যখন কমিক্স পড়তাম, দেখতাম যেখানে ব্যাঙ্গের অংশগুলো রয়েছে, সেগুলো খুব ভালো লাগছে পড়তে। এদিকে ততদিনে কেবল টিভি চলে এসেছে। দেখতে দেখতে বুঝতে পারতাম, আমাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে এই সব কিছুর সঙ্গে লড়াই করে মানুষকে আকৃষ্ট করা যায়। এও বুঝেছিলাম ভয়ংকর মজা, সামাজিক ব্যঙ্গ থাকলে তবেই সকলের মন জিততে পারব। অবশ্য ভেবে দেখলে লোকের কথাই যে ভেবেছিলাম তাও নয়। আমার নিজের ভালো লাগবে, সেটাই সবচেয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম। আর আমি যে গল্পটা বলতে চাইছি, সেটার ছবি কী হবে তা নিয়েও ভেবেছি। আমি এমনিতেই খুব 'ডার্ক' কিছু করতে পছন্দ করতাম না। ভেবেচিন্তে ফ্র্যাঙ্কো-বেলজিয়ান স্টাইলটাই বেছে নিলাম। অর্থাৎ সলিড কালার, লাইন ড্রয়িংয়ের ওপর কাজ করা। ইন্ডিয়ান পেন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করার সময় দেখেছি সেখানে ডিটেলিং খুব গুরুত্ব পায়। ইন্ডিয়ান ম্যুরাল খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, কীভাবে পার্সপেক্টিভ ভেঙে কাজ করা হয়। রাজপুত পেন্টিং যেমন। এই যে বড় ল্যান্ডস্কেপে অনেক সিচুয়েশন, অনেক ক্যারেক্টার... ঠিক করলাম আমিও এভাবেই করব। একদিনে হয়নি। করেছি, ছিঁড়ে ফেলেছি। করতে করতে একটা স্ট্রাকচার পেয়ে গেলাম।
কারও কাছে শুনেছিলাম টিনটিন স্রষ্টা হার্জে নাকি যে ঘরে বসে কাজ করতেন, সেখানে টিনটিন, হ্যাডক, রনজন-জনসনদের পোশাক ঝোলানো থাকত। এভাবে চরিত্রগুলোর মধ্যে বসে তিনি কাজ করতে চাইতেন। তুমি কি এমন কিছু করো?
নাহ। একটা কথা বলতে পারি, উনি যখন শুরু করেছিলেন তখন নিশ্চিত ভাবেই এসব করতেন না। হয়তো টিনটিন বিশ্ববন্দিত হওয়ার পরে স্টুডিওটাকে ওভাবে সাজিয়েছিলেন। তবে না সাজানো না হলেও কিছু এসে যেত না। আমরা সকলেই মনের ভিতরে সবটা লালনপালন করি। এই যেমন সেদিন আমি হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম একটা কেকের দোকানে মালপত্র দিতে এসেছে বড় গাড়ি। দরজাটা আলগা করে রাখা। ভাবলাম, যদি এখুনি কেউ ওটা হাট করে খুলে দেয়, তাহলে ফুটপাথ দিয়ে যে হেঁটে আসছে সে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাবে! সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা মাথায় খেলে গেল। এভাবে কত ছবি জন্ম নেয় অনর্গল। চরিত্রের পোশাকের পরিবর্তে সেখানে যদি মাছের ব্যাগও ঝোলানো থাকে আমার অসুবিধা হবে না। (হাসি) আমি সব সময়ই ভেবে চলি। খেয়াল রাখি, এটা আগে কখনও করিনি তো! নিজেকে রিপিট করতে চাই না। সেই সঙ্গেই রাস্তাঘাটে যে সব গাড়িঘোড়া চলে, সে সবও ডিটেলিং মাথায় রাখতে হয়। ধরো ২০০৬ সালে যখন শুরু করেছিলাম, শহরে কত অ্যাম্বাসাডর চলত! এমনকী ফিয়েটও ছিল। এখন তার পরিবর্তে ওয়াগনার বেড়েছে। সব মিলিয়ে কলকাতার দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। এই বদলটা মাথায় রেখেই ছবি আঁকতে হয়।
রাপ্পা রায় এত জনপ্রিয়। এই প্রত্যাশার চাপ সামলাও কী করে?
দেখতে দেখতে চোদ্দো-পনেরোটা কমিক্স হয়ে গিয়েছে। আগেই বললাম, রিপিট যাতে না হয় সেটা খেয়াল রাখি। তাছাড়া প্রতিটা ফ্রেম নিয়েই আলাদা করে ভাবি। কখনও কখনও দিশা পাই না। হয়তো তিনদিন ধরে ভেবে চলেছি। কিচ্ছু হচ্ছে না। আচমকা ভোর চারটের সময় একটা আইডিয়া এল! ঘুমচোখেই সংক্ষেপে নোট করে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। উঠেই সেটা করতে বসলাম। আবার অনেক সময় কিছু একটা করে হয়তো মনে হল ঠিকই আছে। পরদিন সেটা আর পছন্দ হল না। তখন সেটা ফেলে দিই। আবার নতুন করে ভাবি। তবু অতৃপ্তি থেকে যায়ই। কোনও কোনও কমিক্স ফিরে দেখতে গিয়ে মনে হয় আরও ভালো করা যেত। ডিটেলিংটা নিয়ে আরও ভাবলে হত। লোকে হয়তো ওটা পড়েই বলেছে, দারুণ হয়েছে। কিন্তু আমি জানি, যেমন করে করব ভেবেছিলাম, তেমন করে করলে ব্যাপারটা আরও ভালো হত।
রুপোলি পর্দায় রাপ্পা রায়কে কেমন লাগছে?
ধীমানবাবু প্রত্যেকটা রাপ্পা রায় মন দিয়ে পড়েছেন। উনি নিজের মতো করে কাহিনিটিকে সিনেমার মতো করে গড়ে তুলেছেন। পুরো ছবিটা এখনও দেখিনি। তবে যে অংশগুলো দেখেছি, আমার বেশ ভালো লেগেছে। তবে এও জানি, সিনেমা একটা আলাদা মাধ্যম। সেখানে অনেক কিছুই আলাদা করতে হয়। যেমন যে গল্প নিয়ে সিনেমাটা হচ্ছে, সেটা ২০১৪ সালের। তাতে টোনি কিংবা ডলফিন কোনও চরিত্রই ছিল না। কিন্তু টোনি আর রাপ্পা রায়ের বাবার রসায়নটা খুব মজাদার। তাই পরিচালক তাকে এবং ডলফিনকে নিয়ে এসেছেন এখানে। ফলে ঘটনাও বদলেছে।
ফুলস্টপ ডট কম ব্যাপারটা কী?
ফুলস্টপ ডট কম একটা সংস্থা। তারা পয়সা নিয়ে সুপারি কিলিং করে। মারধরও করে। ফুলস্টপ মানে একেবারে মেরে ফেলবে। সেমিকোলন মানে হাত ভেঙে দেবে। কমা মানে দুটো ঠ্যাং ভেঙে দেবে। সারা ভারতজুড়ে ছড়ানো রয়েছে এদের জাল। রাপ্পা এদের মোকাবিলা কেমন করে করল এটাই গল্প। এর সঙ্গে পরিচালক আরও নানা জিনিস যোগ করেছেন।
ছবিতে তো গানও আছে।
হ্যাঁ। যার মধ্যে একটা গান আমার খুব ভালো লেগেছে। 'আমি চলে যাব'। রাপ্পার মায়ের কণ্ঠে গানটা শোনা যাচ্ছে। টাইটেল ট্র্যাকটাও ভালো। কিন্তু এটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে।
কমিক্স থেকে সিনেমা হচ্ছে এটা খুব আনন্দের। কিন্তু সিনেমা নিয়ে মানুষের যতটা আগ্রহ থাকে, কমিক্স নিয়ে... বলতে গেলে সাহিত্য নিয়ে কি ততটা আছে?
কলকাত্তাইয়া বাঙালির মধ্যে একটা ভণ্ডামি এসে গিয়েছে এটা সত্যি। কিন্তু পুরোটাই অন্ধকার, এমনটা বলা ঠিক নয়। কয়েকদিন আগে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম কত ছেলেপুলে রাপ্পা রায় পড়েছে। কেবল রাপ্পাই নয়, নানা ধরনের বই তারা পড়ে। কাজেই সবটা নেগেটিভ ভাবে দেখা অর্থহীন। এমন একটা নড়বড়ে সময়ে আমরা বেঁচে আছি... সেটা গোটা পৃথিবী জুড়েই... সমাজটা কেমন শতচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে! তার মধ্যেই নতুন ছেলেমেয়েরা গল্প লিখছে, ছবি আঁকছে... ভালো লাগে দেখে। বুঝতে পারি, হতাশ না হয়ে নিজের কাজটুকু করে যেতে হবে। এর বেশি কিছু তো আমাদের হাতেও নেই।
