রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্য়ায়: মহেন্দ্র সিং ধোনির কোচ কেশব বন্দ্যোপাধ্যায় অতিশয় তিতিবিরক্ত। ভদ্রলোক অধুনা বারাকপুর-নিবাসী। কেশববাবু শুক্রবার এসেছিলেন খেলা দেখতে। তা, প্রায় দু’ইনিংস মিলিয়ে সওয়া পাঁচশো রানের আইপিএল ম্যাচ দেখে বেরনোর সময় ঈষৎ বেদনাগ্রস্ত ভাবে বলছিলেন, ‘‘আচ্ছা, এটা কি ক্রিকেট? মারতে আমি মাহিকেও (মহেন্দ্র সিং ধোনিকে যে নামে ডাকা হয়) দেখেছি। ছোটবেলা থেকে বেধড়ক মারত। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে এখন যা দেখছি, বোলারদের তো আর ভূমিকাই নেই! পুরোটাই ব্যাটারদের খেলা হয়ে গিয়েছে।’’
ধোনি-দ্রোণাচার্যের আক্ষেপ-আফশোস অযৌক্তিক নয়। এ যা চলছে, তাতে এরপর টি-টোয়েন্টি থেকে বোলার প্রজাতিই না গায়েব হয়ে যায়! কেউ কখনও ভেবেছে, একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ২৬২ রান তাড়া হয়ে যাবে? তা-ও কি না আট বল হাতে রেখে! চলতি আইপিএলে যা শুরু করেছেন ট্রাভিস হেড, হেনরিক ক্লাসেন, অভিষেক শর্মা, জনি বেয়ারস্টো, সুনীল নারিন, ফিল সল্টরা– তাতে যা মনে হচ্ছে, আইপিএলে আড়াইশোই এখন ‘নিউ নর্ম্যাল’। দু’শো-টুশো কোনও রানই নয়!
[আরও পড়ুন: এবার নেতাদের বাড়িতে ঢুকতেও সেনা নামাতে হবে! সন্দেশখালি কাণ্ডে তীব্র খোঁচা দিলীপের]
রাতে কেকেআরের হয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসেছিলেন টিমের সহকারি কোচ রায়ান টেন দুশখাতে। যিনি ভেবে পাচ্ছেন না, ব্যাটারদের এ হেন নৃশংস প্রহার থামানো সম্ভব কীভাবে? ‘‘ভাবার কোনও কারণ নেই যে, স্কোরবোর্ডে ২৬১ রান দেখে আমাদের টিমের বোলাররা আত্মতুষ্ট হয়ে পড়েছিল। ওরা সেটা এতটুকু হয়নি। গোটা আইপিএল জুড়েই এ জিনিস চলছে। ইডেনে যা বুঝছি, ২৪০ ন্যূনতম তুলতে হবে। আবারও বলছি, বোলারদের নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। কিন্তু ওদের সময় দিতে হবে। বিপক্ষের এরকম মারমার-কাটকাট ব্যাটিং থামানো কীভাবে সম্ভব, তার উপায় খুঁজে বার করতে বোলারদের সময় প্রয়োজন, "দিশেহারা শোনাচ্ছিল দুশখাতেকে। সঙ্গে প্রাক্তন ডাচ ক্রিকেটার যোগ করলেন, ‘‘দেখুন, টি-টোয়েন্টিতে বোলারের পক্ষে কখনওই কিছু ছিল না। সব সময়ই খেলাটা ব্যাটারের পক্ষে ছিল। আর এখন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার, ইত্যাদি আসার পর তো আরও খেলাটা ব্যাটারের দিকে চলে গিয়েছে। পরিষ্কার বলছি, জেতার মতো রান করেছিলাম আমরা। ২৬১ তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরেও হল না। আমাদের আরও ভালো করা উচিত ছিল। কিন্তু যা বললাম আগে। বোলারদের সময় দিতে হবে এ ধরনের প্রহারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য।’’
দুশখাতে বিহ্বল। বিহ্বল যেমন তাঁদের টিম, টিম মালিক। বিহ্বল যেমন ইডেন কিউরেট সুজন মুখোপাধ্যায়। খেলা শেষে কেকেআর মেন্টর গৌতম গম্ভীরের মুখচোখের দিকে প্রায় তাকানো যাচ্ছিল না। শাহরুখ খান তো আবার ম্যাচ শেষে মাঠেই নামলেন না! রাজস্থান রয়্যালস ম্যাচও ইডেনে হেরেছিল কেকেআর। সেদিনও মাঠে এসেছিলেন ‘কিং খান’। কিন্তু খেলা শেষে মাঠে নেমেছিলেন শাহরুখ, অতিমানবিক সেঞ্চুরি করা জস বাটলারকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ‘বাদশাহী স্পিরিট’ দেখিয়ে। কিন্তু এদিনের হারটা এতটাই বিধ্বস্ত করে দেওয়া যে, বলিউড বাদশার স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছিল। পাঞ্জাব ইনিংসের অন্তিম পর্বে দেখা গেল, ‘বি’ ব্লকের কর্পোরেট বক্সে চরম বিধ্বস্ত ভাবে শাহরুখ বসে। প্রায় নির্জীবের মতো! করার নেই কিছু। আসলে কেকেআর ২৬১ তোলার পরে কেউ ভাবেনি, এমন অকল্পনীয় চিত্রনাট্য লিখে রাখবেন ক্রিকেট-বিধাতা। ভাবা যায়, পাঞ্জাব ইনিংসের দশ ওভার উত্তীর্ণ হতে না হতে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, কারা জিতছে খেলায়? এবং যতই শুনতে অবিশ্বাস্য লাগুক, সম্ভাব্য জয়ী তখন থেকে পাঞ্জাবকেই দেখাচ্ছিল। ২৬১ তোলা কেকেআর নয়!
রাতে হাহাকারে ডুবে যাওয়া পরিশ্রান্ত নাইট সমর্থকদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল, জনি বেয়ারস্টো নয়। ইডেন কিউরেটরকে ম্যাচ সেরার পুরস্কার দেওয়া উচিত! পুরোটাই আক্ষেপ-মিশ্রিত আম-সমর্থকের অভিব্যক্তি। যুক্তির পরোয়া যা কোনও কালেই করে না। তবে এটাও ঠিক যে, ইডেন কিউরেটর সুজনও ভাবতে পারেননি ২৬১ উঠে যাবে। আর শুধু উঠবে না, আট বল বাকি থাকতে তা তাড়াও হয়ে যাবে। রাতের দিকে ফোনে সুজন বলছিলেন, ‘‘জানি না, কী বলা উচিত আমার? আমি সব সময় চেষ্টা করি, ভালো পিচ দিতে। এই ম্যাচেও তাই করেছি। তবে আমি ভেবেছিলাম, ২২০-২৩০ উঠবে। ২৬১ উঠবে, ভাবিনি। আর সেই ২৬১ তাড়া হয়ে যাবে, সেটাও কল্পনা করতে পারিনি। ইডেনে শুনলাম, গোটা চারেক রেকর্ড হয়েছে। ২৬২ তুলে জেতাটা তো বিশ্বরেকর্ড, তাই না?’’ ঠিকই আছে। ক্রিকেট-বিস্ময়ের দিনে তো সর্বত্র বিহ্বলতাই থাকবে। নিস্তেজ-নিরামিষ চিত্রনাট্য এ সব দিনে কখনও থাকে নাকি?