অর্ণব আইচ: দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হল না। শুনানি শেষে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত কুন্তল ঘোষকে ইডি হেফাজতের নির্দেশ দিল ব্যাঙ্কশাল কোর্ট। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি ফের তাঁকে তোলা হবে আদালতে।
শনিবার সকাল পৌনে দশটা নাগাদ গ্রেপ্তারির পর এদিন তাঁকে ব্যাঙ্কশালের বিশেষ আদালতে তোলা হয়। তাঁর জামিনের আবেদন জানান আইনজীবী সেলিম রহমান ও পিন্টু কাড়ার। জামিনের বিরোধিতা করেন ইডির আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি ও ভাস্করপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের দাবি, টেট ও প্রাথমিক শিক্ষক দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে তাঁরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, কুন্তল আপার প্রাইমারি, নবম দশম ও একাদশ দ্বাদশ শ্রেণি, গ্রুপ সি ও ডির নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গেও যুক্ত। দু’পক্ষের আবেদন শুনে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুন্তল ঘোষকে ইডির হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। গ্রেপ্তারির পর কুন্তল দাবি করেন, তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে। যে তাপস মণ্ডল তাঁকে টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন, সেই তাপসই তাঁর কাছ থেকে জোর করে ৫০ লক্ষ টাকা দাবি করেন। তাপস সঙ্গী নীলাদ্রির সঙ্গে ইডি ও সিবিআইকে দিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করানোর হুমকি দিয়েও তোলাবাজি করেন বলে তিনি সিবিআইকে জানিয়েছেন। তাপস মণ্ডলকে টাকা না দেওয়ায় তাঁর এই হাল বলে দাবি কুন্তলের। গোপাল দলপতি নামে একজনের বিরুদ্ধেও কুন্তল অভিযোগ জানান।
তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘সিবিআই-এর জেরার পর ইডি-র তল্লাশি, তার পরই গ্রেপ্তার হন কুন্তল। আইনের পদ্ধতি নিয়ে আমি কোনও কথা বলব না। কিন্তু যেটা দৃষ্টিকটূ হয়ে যাচ্ছে, দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার প্রসন্ন রায়ের বাড়ি থেকে দিলীপ ঘোষের নথি পাওয়া গেলে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় না। উলটে দিলীপ ঘোষরা বলেন, তৃণমূলের বাড়ি যাবে সিবিআই। আর সিবিআই, ইডি তৃণমূলের নেতা, যুব নেতাদের গ্রেপ্তার করে মর্যাদাহানির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা দৃষ্টিকটূ।’’
[আরও পড়ুন: সংগঠন নড়বড়ে! ব্যর্থতা ঢাকতে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট করাতে চায় BJP]
কুন্তলের স্ত্রী জয়শ্রী মণ্ডল দাবি করেন, তাঁর স্বামীকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। লকডাউনের সময় তাঁদের ফ্ল্যাটেই তাপস মণ্ডল তাঁর কর্মচারী তাপস মিশ্রর সঙ্গে থেকে কলেজ চালাতেন। তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে যে তাপসের অ্যাকাউন্টে টাকা গিয়েছে, সেই প্রমাণ তাঁর কাছে রয়েছে। সূত্রের খবর, দু’টি ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়ে টাকা উদ্ধার হয়নি। তবে প্রচুর নথি ও বৈদ্যুতিন নথি উদ্ধার হয়। তদন্তে ‘অসহযোগিতা’ করায় তাঁকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে জেরা করা হয়। ৪৯ কোটি টাকা কীভাবে খরচ হয়েছে, নিউটাউনের ফ্ল্যাট কীভাবে কেনা হয়েছে, ইডির প্রশ্নবানে ‘ভেঙে পড়েন’ কুন্তল। এর পরই গ্রেপ্তার হন ওই নেতা।
ইতিমধ্যেই টেট দুর্নীতিতে মানিক ভট্টাচার্যকে ইডি গ্রেপ্তার করেছে। মানিকের স্ত্রী শতরূপা, ছেলে শৌভিক ও তাপস মণ্ডলের বিরুদ্ধে চার্জশিটও পেশ করেছে ইডি। এদিন ইডির আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি আদালতে আবেদনে জানান, প্রথমে মনে করা হয়েছিল দুর্নীতির ভারত মহাসাগর, কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে এটি দুর্নীতির প্রশান্ত মহাসাগর। ছাই রঙের ডায়েরিতে তাপস মণ্ডল যে কুন্তল ঘোষকে ১৯ কোটি ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন, তার প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে ১০ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ, ৩ কোটি ৩০ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা আপার প্রাইমারি শিক্ষক, ৫ কোটি ২৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা টেট ২০১৪ প্রাথী নিয়োগের জন্য, যার মধ্যে ৩ কোটি ২৫ লক্ষ প্রার্থীদের পাস করানোর জন্য নেওয়া হয়। অন্য খাতাটিতে প্রাথমিক শিক্ষক, আপার প্রাইমারি, গ্রুপ সি ও ডি নিয়োগে কুন্তল ও তাঁর সঙ্গীরা ৩০ কোটি টাকা যে তুলেছেন, তার হিসাব রয়েছে। যখন নোটের খাতা দেখানো হয়, তখন কুন্তল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে বলেন, তিনি ৩০ কোটির দশ শতাংশ কমিশন পেয়েছেন মাত্র। যদিও তিনি প্রচুর টাকা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তুলেছেন। টেট ২০১৪-র ৩২৫ জন সন্দেহভাজন প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন চাকরিও পেয়েছেন। ইডির দাবি, পুরো শিক্ষা দপ্তর দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছে। এই টাকা পাচার ও লেনদেনের আরও বিস্তারিত তথ্য ও এই দুর্নীতির সঙ্গে আরও যারা যুক্ত রয়েছে, তাদের সন্ধান চালাতেই কুন্তলকে ইডি নিজেদের হেফাজতে চায়।
কুন্তলের আইনজীবীর দাবি, ইডি কাকে কেমন দেখতে, তারই ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করছে। কুন্তল তদন্তে বাধাও দেননি। ফ্ল্যাট থেকে টাকা পাওয়া যায়নি। যা জিনিস উদ্ধার হয়েছে, তার জন্য কাউকে হেফাজতে নিয়ে জেরার প্রয়োজন হয় না। যদিও কুন্তলের টাকা ও সম্পত্তির সন্ধানে তাঁকে নিয়ে কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি করা হতে পারে বলে জানিয়েছে ইডি।