রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: ৩০ মার্চ, ওয়াংখেড়ে প্রেস কনফারেন্স রুম। মুম্বই। প্রাক্ মুম্বই ইন্ডিয়ান্স যুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলন করছেন যিনি, নাম তাঁর চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত। কেকেআর (KKR) হেড কোচ। ঈষৎ হেসে, পিচ বিতর্কের প্রত্যুত্তরে যিনি বলছেন, “হোম অ্যাডভান্টেজ কে না চায়, বলুন? কোচ হিসেবে ঘরের মাঠ থেকে একটু তো কিছু প্রত্যাশা করতেই পারি!”
২ এপ্রিল, ইডেন প্রেস কনফারেন্স রুম। কলকাতা। প্রাক্ সানরাইজার্স হায়দরাবাদ (SRH) যুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলন করছেন যিনি, তাঁর পিতৃদত্ত নাম ডোয়েন ব্র্যাভো! অধুনা পেশাগত পরিচয়, কেকেআর মেন্টর। তা, হোম অ্যাডভান্টেজ নিয়ে শলাকা-সম প্রশ্ন ধেয়ে গেল ঠিকই প্রাক্তন ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার অভিমুখে। কিন্তু ফিরে এল মুখ চুন করে! আসবে। আসাই স্বাভাবিক। আরে, ব্র্যাভো যে বলে দিলেন, “পিচ-ফিচ নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। টার্ন করল, নাকি করল না, আমার কিছু যায় আসে না। বরং আমি টিমের ক্রিকেটারদের বলি, পরিবেশ যেমন, পিচ যেমন, সেই মতো নিজেদের খেলাকে অ্যাডজাস্ট করো!”
লেখার মুখবন্ধে ভারতবর্ষের দুই ভিন্ন মাঠে, দুই ভিন্ন ক্রিকেট চরিত্রের দুই সাংবাদিক সম্মেলনের বিবরণ দেওয়ার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। প্রথমত, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত এবং ডোয়েন ব্র্যাভো দু’জন আলাদা মানুষ হলেও, দু’জন বর্তমানে ওতঃপ্রোত ভাবে যে আইপিএল (IPL 2025) ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে, তা এক এবং অভিন্ন–কেকেআর। দ্বিতীয়ত, তাঁরা যে বিষয়টা নিয়ে চার দিনের ফারাকে বলছেন, তা-ও অভিন্ন এবং এক– হোম অ্যাডভান্টেজ এবং মনের মতো পিচ। কেকেআরের ক্ষেত্রে যা ‘টার্নার’। শুধু দু’টো মতবাদ আলাদা। সম্পূর্ণ আলাদা। কেকেআর হেড কোচ মনে করেন, হোম অ্যাডভান্টেজ পেলে মোটেও মন্দ হয় না। বরং ঘরের মাঠে খেলার সুবিধে-টুবিধে অল্প-বিস্তর আশা করা যেতেই পারে। কিন্তু কেকেআর মেন্টর মনে করেন, এ সমস্ত পিচ-টিচ পুরো ফালতু। টার্নার পাওয়া না পাওয়ায় কিছুই যায়-আসে না। আসে-যায়, ভালো ক্রিকেট খেলায়। পরিবেশ বুঝে। পারিপার্শ্বিক বুঝে। পরিস্থিতি বুঝে।
দেশের প্রাজ্ঞ ক্রিকেট সাংবাদিকরা প্রায়শই ডিপার্টমেন্টাল জুনিয়রদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন যে, যে কোনও খবরাখবর শতকরা দু’শো শতাংশ নিশ্চিত হয়ে লিখতে। দরকারে সরকারি বয়ানের জন্য অপেক্ষা করো। কিন্তু বিবিধ জল্পনা-কল্পনা লিখে খামোখা ঝঞ্ঝাট সৃষ্টির কোনও প্রয়োজন নেই। সে যুক্তি শিরোধার্য করে নাইট ডাগআউটের চারপাশ থেকে পেঁজা তুলোর মতো ভেসে আসা নানা ছুটকো-ছাটকা বিতর্কের স্ফুলিঙ্গকে না হয় বাদই রাখছি। কিন্তু এ তো সূর্যালোকের মতো সুস্পষ্ট যে, ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’, ঘূর্ণি পিচের চাহিদা নিয়ে কেকেআর কোচ আর কেকেআর মেন্টরের মধ্যে বিস্তর মতানৈক্য! তা হলে উড়ো খইয়ের মতো যা যা ছিটকে এসে ক্রিকেট সাংবাদিকের কোলে-কাঁখে এসে পড়ছে, সে সবও সত্যি? আবারও লিখছি, সত্যি-মিথ্যে বলতে পারব না। তবে শুনলাম যে, কেকেআর হেড কোচ আর কেকেআর মেন্টরের মধ্যে নাকি কিছু-কিছু জায়গায় দর্শনগত বিরোধ হচ্ছে। ওয়াংখেড়েতে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের কাছে কুৎসিত হারের পর নাকি চন্দ্রকান্ত প্লেয়ারদের বকাঝকা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু ব্র্যাভো নিজ উদ্যোগে আটকে দেন। বুধবারও নাইট প্র্যাকটিস চলাকালীন দু’জনকে কেমন একটু দূরে-দূরেই থাকতে দেখা গেল। বৃহস্পতিবার ট্র্যাভিস হেড-অভিষেক শর্মাদের সানরাইজার্স হায়দরাবাদকে গুঁড়িয়ে দিতে পারলে, পুনরায় পুরোদস্তুর সুখী সংসার দেখা যাবে, নিশ্চিত। জয় আসলে ছোট-বড়, সমস্ত ফাটল ঢেকে দেয়। কিন্তু হেরে গেলে? তখন?
জানি না। জানা নেই। টিমের ভাবগতিক দেখে এটুকু বুঝলাম যে, মুম্বইয়ের কাছে বিপর্যয়ের হারের শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি কেকেআর। ওয়াংখেড়ের কালান্তক বাইশ গজ, তাতে চূড়ান্ত ব্যাটিং ব্যর্থতা নিয়ে এখনও হাহাকার চলছে। তা সে যতই ব্র্যাভো বলে যান, “আমরাই কি এই আইপিএলের একমাত্র টিম, যারা প্রথম তিনটেয় দু’টো হেরেছি?” কেউ কেউ বলছিলেন, আন্দ্রে রাসেলকে দিয়ে কেন যে আরও বেশি বোলিং করানো হচ্ছে না, বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, দিন শেষে রাসেল ‘প্যাকেজ’। বিধ্বংসী ব্যাটার। অসম্ভব কার্যকরী বোলার। সেই রাসেলকে তা হলে ‘আন্ডার ইউটিলাইজড’ রাখার অর্থ কী? অকাট্য যুক্তি। অষ্টাদশ আইপিএলে এ পর্যন্ত তিনখানা ম্যাচে সাকুল্যে তিন ওভারও পুরোপুরি বল করেননি রাসেল। আনরিখ নখিয়া আর এক ‘বিস্ময়ের’ নাম। ব্র্যাভো এ দিন বলে গেলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার আগুনে পেসার প্রায় ম্যাচ ফিট। অথচ নাইট ছাউনিতে থাকা একজন বললেন, পুরো ফিট না হলে নখিয়া ট্রেনিংয়ে পূর্ণ গতিতে বোলিং করছেন কী করে?
মুশকিল হল, ক্রিকেটীয় যুক্তি-তর্ক নিয়ে পড়ে থাকার মতো সময়ও বিশেষ পাওয়া যাচ্ছে না। কেকেআর যে বিগত তিনটে সম্মুখ সাক্ষাতে সানরাইজার্সকে হারিয়েছে, সে তথ্যও এ মুহূর্তে আমল পাচ্ছে না। লোকে তো এটাও ভুলে গিয়েছে, এই ম্যাচটা গত আইপিএল ফাইনালের ‘রি-ম্যাচ’! গত আইপিএল ফাইনালে সানরাইজার্স আর কেকেআরই তাজের জন্য লড়েছিল। আরে, ইডেন পিচ নামক নিরন্তর নাটক থেকে ফুরসত পাওয়া গেলে, তবে না ক্রিকেট? বুধবার বিকেল থেকে যা চলল, হিসেব রাখতে গেলে দু’খানা নোটবুক লাগবে!
এ দিন দুপুর সাড়ে তিনটের গায়ে-গায়ে ইডেনে ঢোকেন তিন নাইট-চরিত্র। সুনীল নারিন। মইন আলি। টিমের ভিডিও অ্যানালিস্ট। তখনও বাকি টিম আসেনি। এবং মাঠে ঢুকে তাঁরা সর্বপ্রথম চলে যান বাইশ গজের কাছে। পিচের ফুটেজ তোলা হয়। পরে যা দেখে টিম ম্যানেজমেন্ট। পরে ইডেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দফায়-দফায় কথা বলতে দেখা যায় কেকেআর কোচ থেকে প্লেয়ারদের। সানরাইজার্স ম্যাচের পিচে যে টার্ন থাকছে, তা ইতিমধ্যে সর্বজনবিদিত। কেকেআর যদি স্পেনসর জনসনকে বসিয়ে মইন আলিকে আজ খেলিয়ে দেয় (ইংল্যান্ড অলরাউন্ডারকে দীর্ঘক্ষণ ব্যাটিং-স্পিন বোলিং দু’টোই করিয়ে রাখা হল), আশ্চর্যের কিছু হবে না। কিন্তু তার পরেও ইডেন পিচ যে নাইটদের দারুণ মনঃপূত হয়েছে, লেখা যাবে না! সিএবি-র কেউ কেউ বললেন, কেকেআর নাকি পিচ থেকে আরও একটু টার্ন প্রত্যাশা করেছিল। তারা নাকি এমন পিচ চায়, যেখানে নিজেরা ১৭০ করে প্রতিপক্ষকে ১৪০ অলআউট করে দেওয়া যাবে স্পিনের বিষে! সিএবি-র এক কর্তা তো এ-ও বললেন যে, আইপিএলের মাস দেড়েক আগে কেকেআরের তরফে নাকি ইডেন বাউন্ডারির দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে বলা হয়েছিল! বোর্ড নির্দেশিকা অনুযায়ী, সেন্টার উইকেট থেকে বাউন্ডারির দূরত্ব ৬৫ গজ রাখতে হবে। ইডেনে সেখানে এমনিই কোথাও ৭০ গজ, কোথাও ৭২। কিন্তু তার পরেও নাইট কর্তারা নাকি আবদার করেছিলেন যে, দূরত্ব পারলে আরও কিছুটা পারলে বাড়িয়ে দিতে! কেন? খুব সহজ তো। বাউন্ডারি ‘রোপ’ পিছিয়ে দিলে স্পিনারের বলে বাউন্ডারি সীমান্তে ক্যাচ ধরার সম্ভাবনা বেশি, তাই!
বলুন না, এ ভাবে ভালো খেলা সম্ভব? পরিষ্কার লিখছি, ইডেনে আজ সানরাইজার্স-যুদ্ধ কেকেআরের প্রেক্ষিত থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অজিঙ্ক রাহানেরা পারলে ভালো। না পারলে আরও অবিন্যস্ত হয়ে যাবে সব কিছু। আর জিতলেই শুধু চলবে না। নেট রান রেট যতটা পারা যায়, বাড়িয়ে রাখতে হবে। কেকেআরেরই একজন স্মরণ করিয়ে দিলেন, বিগত কয়েক বছরে যে বার তিনেক আইপিএল প্লে অফ যায়নি কেকেআর, প্রত্যেকবার ভুগিয়েছে নেট রান রেট। যা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। প্রথমে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু একবার জাগলে, কিছু করার থাকে না। তা, শুনবেন নাকি আপাতত দশে দাঁড়িয়ে থাকা নাইটদের নেট রান রেট? ১.৪২৮। শুধু প্লাস নয়। মাইনাস মাত্র!
আজ আইপিএলে
কলকাতা নাইট রাইডার্স
বনাম সানরাইজার্স হায়দরাবাদ
ইডেন, সন্ধ্যা ৭.৩০
স্টার স্পোর্টস