আলাপন সাহা: কথাগুলো ভাবলে মুকেশ কুমারের এখনও চোখে জল আসে। বড্ড কাতর হয়ে পড়েন। গলা ধরে আসে। আইপিএল (IPL) নিলামে দিল্লি ক্যাপিটালস যখন তাঁকে সাড়ে পাঁচ কোটি দিয়ে কিনল, লাইভ দেখতে পারেননি। বন্ধুবান্ধবদের ফোনে জানতে পারেন। শোনা মাত্র হয়তো সেই আট-দশ বছর আগের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল মুকেশের। বাবা কোনওরকমে টেনেশুনে সংসার চালাতেন। তালতলার ওই ছোট্ট বাড়িতে ক্রিকেট মানে তখন বিলাসিতা। বাবাও যে প্রথম প্রথম মুকেশের ক্রিকেট প্রেম নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলেন সেটা নয়। কিন্তু মুকেশ কখনও নিজের লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি। ম্যাচ খেলে পাঁচশো টাকা পেতেন। ধার করা কিটে চালিয়ে গিয়েছেন অনুশীলন।
একটা সময় পুষ্টির অভাবে বোন এডিমা হয়ে যায়। ক্রিকেট খেলা তো দূর, ঠিক ভাবে হাঁটতেও পারতেন না। ওই সময় অবশ্য সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) প্রচণ্ড সাহায্য করেছিলেন বঙ্গ পেসারকে। ক্রিকেট কিট ছিল না। সেটা মনোজ তিওয়ারি দিয়েছিলেন। তৎকালীন বোলিং কোচ রণদেব বসু থেকে শুরু করে জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, সিএবি কর্তা দেবব্রত দাস, প্রত্যেকেই মুকেশকে আগলে রেখেছিলেন। ক্রিকেট কেরিয়ার জুড়ে ঝড়-ঝঞ্ঝা এসেছে, কিন্তু কোনও কিছুই মুকেশকে দমাতে পারেনি। মুকেশ বলেন, ‘‘যদি কঠিন সময় না আসত, তাহলে হয়তো এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না। ওই পরিস্থিতিগুলো আমাকে আরও বেশি শক্তিশালী করেছে।’’
[আরও পড়ুন: এলএম টেনই অনুপ্রেরণা! খুন-ছিনতাইয়ের মতো অভিযোগে পুলিশের জালে ‘মেসি গ্যাং’]
গত কয়েক বছর ধরে ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে ভাল বোলিং করে গিয়েছেন। ইরানি ট্রফি হোক কিংবা ভারতীয় এ, আগুনে সব স্পেল করেছেন। আইপিএলে যে তিনি টিম পাবেন, সেটা মোটামুটি আন্দাজ করাই গিয়েছিল। কিন্তু তাঁকে নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের মধ্যে লড়াইটা এই পর্যায়ে যাবে, সেটা হয়তো মুকেশও ভাবতে পারেননি। বেঙ্গালুরু থেকে ফোনে বলছিলেন, ‘‘অবশ্যই ভাল লাগছে। আমি খেলার সুযোগ পেয়েছি, সেটাই আসল। কত টাকা পেলাম, সেটা নিয়ে আমি ভাবতে চাই না। আমার কাছে আসল হল ক্রিকেট। এই ক্রিকেটের জন্য এত কিছু করেছি। তাই খেলা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে আর ভাবি না। আমাকে যদি কেউ বেস প্রাইস (২০ লাখ) দিয়েও কিনত, তাহলেও একই রকম খুশি হতাম।’’
মুকেশ একটা কথা জানতেন, কোনওএ টিম তাঁকে নিক না নিক, দিল্লি তাঁর জন্য ঝাঁপাবে। গতবারের আইপিএলে দিল্লি টিমে নেট বোলার হিসাবে ছিলেন মুকেশ। সেখানে রিকি পন্টিংদের নজরে আরও বেশি করে চলে আসেন তিনি। বঙ্গ পেসার বলছিলেন, ‘‘আমি জানতাম কোনও টিম আমাকে দিল্লি ঠিক আমাক নেবে। আসলে গতবার দিল্লিতে দুটো প্র্যাকটিস ম্যাচে খেলেছিলাম। দুটো ম্যাচেই খুব ভাল বল করি। তখন পন্টিং স্যর আর আমরে স্যর (প্রবীন আমরে) খুব প্রশংসা করে। তাই মনে হয়েছিল দিল্লি আমাকে টিমে নেবে।’’
[আরও পড়ুন: চেন্নাইয়ে যোগ দিতেই ধামাকা, স্টোকসের হাতেই দলের নেতৃত্ব তুলে দিতে পারেন ধোনি!]
ছোট থেকেই মুকেশ একটা স্বপ্ন দেখতেন। ভারতীয় দলের জার্সিতে তিনি খেলবেন। সেই স্বপ্নের অনেকটাই পূরণ হয়েছে। জাতীয় দলে জায়গাটা এখন নিয়মিত করতে চান। বলছিলেন, ‘‘যেদিন ভারতীয় দলে ডাক পেলাম, সেদিনই স্বপ্নটা পূরণ হয়। এবার লক্ষ্য সিনিয়র টিমে নিজের জায়গাটা করে নেওয়া। আইপিএলে খেলতে পারব, সেটাও অবশ্যই দারুণ লাগছে। আরও ভাল লাগছে একটা কথা ভেবে, আমি বাংলা থেকে ভারতীয় দলে আর আইপিএলে প্রতিনিধিত্ব করতে পারব। বাংলা সবকিছু দিয়েছে। আমি যেটুকু করতে পেরেছি, সেটা বাংলার হয়ে খেলার জন্য। এই সুযোগটা না পেলে জানি না এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম কি না।’’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে মুকেশের।
আনন্দের দিনেও দুঃখ একটাই-বাবা এসব কিছুই দেখে যেতে পারলেন না। দেখতে পেলে হয়তো একটা কথাই বলতেন-‘মুকেশ তুনে কর দিখায়া, কর দিখায়া তুনে মুকেশ।’