টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: ১৮ বছর পার। তবু বুকে ক্ষোভের আগুনটা এখনও জ্বলছে। শুধু গরিব বলেই কি…! ছাতনা থেকে শুশুনিয়া যাওয়ার পথে ডানদিকের কাঁচা রাস্তা নেমে গিয়েছে। সকালের পশলা বৃষ্টিতে একেবারে কাদা। কুলুডিহি গ্রাম। ছাড়া ছাড়া ঘর। কয়েকটি বড় গাছ মাথা তুলে আকাশে। খানিক দূরে গ্রামের কচিকাঁচারা স্বাধীনতা দিবস পালনের পতাকার চেন বানাচ্ছে। একটি গাছের ছায়ায় বসে সেদিকেই অপলক তাকিয়ে বিকাশ চট্টোপাধ্যায়। এমনিতে গ্রামের পুরুতঠাকুর। কিন্তু কুলুডিহির বাইরে তাঁর পরিচয় ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ভাই হিসাবেই।
১৮ বছর ধরে বুকে পুষে রেখেছেন একটা ছবি। ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট। কিশোরী হেতাল পারেখকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের (Dhananjoy Chatterjee) ফাঁসি। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি, একঝাঁক এলোমেলো চুল ও পরনে রংচটা গামছা। বিকাশবাবুর কাছে যেতেই সাংবাদিককে বলে উঠলেন, “কাউকে বাঁচাতে গরিব বলেই ফাঁসি” বুঝেই খানিকটা ঝাঁঝালো গলাতেই উগরে দিলেন ক্ষোভ। “আমরা গরিব। টাকাপয়সা ছিল না। যাদের টাকাপয়সা আছে, আইন তাদের জন্য। দেশের বিচারব্যবস্থা হল প্রভাবশালীদের জন্য।” এই ক্ষোভ কেন? বিকাশবাবুর চোখ ছলছল করে ওঠে। সামনের গাছে টাঙানো জাতীয় পতাকার দিকে তাকিয়ে বলেন, “কী আর বলব। আমাদের উকিলকেই তো ওরা টাকাপয়সা দিয়ে কিনে নিয়েছিল। উকিল আমাদের হয়ে কোনও সওয়ালই করলেন না সেভাবে। ওটা ফাঁসি নয়, পরিকল্পনামাফিক আমার দাদাকে খুন করা হয়েছিল।”
[আরও পড়ুন: ‘দেশের ক্ষতি করছে ভাই-ভাতিজাতন্ত্র, ফেরত দিতে হবে লুঠের টাকা’, কড়া বার্তা প্রধানমন্ত্রীর]
তাঁরা তিন ভাই, চার বোন। বোনেদের সব বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দাদা গঙ্গাধরবাবু টিউশন করে সংসার চালান। ধনঞ্জয় ছিলেন মেজ। আর, বিকাশবাবুর ভরসা দিনমজুরি আর যজমানি। ধনঞ্জয়ের শোকে ফাঁসির দু’বছর পর তাঁদের বাবা বংশীধরবাবু মারা যান। মা গত হয়েছেন গত বছর। আর ধনঞ্জয়বাবুর স্ত্রী ফিরে গিয়েছেন তাঁর বাপের বাড়ি। তিনি নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন সংবাদমাধ্যমের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অঙ্গনওয়াড়ির দৈনন্দিন কাজটুকু বাদ দিলে দিনের বাকি সময়টুকু তিনি নিজেকে ঘরবন্দিই রাখেন। বিকাশবাবু বলেন, ভাইয়ের ফাঁসির আগে তৎকালীন কারাকর্তার কাছে ভাইয়ের শেষ আরজি ছিল, “আপনি বড় অফিসার। দেখবেন, যে কোনও অভিযোগের তদন্ত যেন ঠিকঠাক হয়৷”
বাবাও শেষ দিকটায় একথাই বিড়বিড় করতেন। ছেলে একটা কাজ নিয়ে শহরে গিয়েছে। বাবা স্বপ্ন দেখতেন ধনঞ্জয়কে নিয়ে। ভাইয়ের ফাঁসি মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আস্থা রেখেছিলেন বিচারব্যবস্থায়। বাবা বলতেন, ‘বিচার-পর্বে আগাগোড়া নিজেকে নির্দোষ দাবি করা ধনঞ্জয় এরকম কাজ করতে পারে না। সে গ্রামের হতে পারে, স্বল্পশিক্ষিত হতে পারে, কিন্তু এটা করতে পারে না। জানেন, বাবা এই রায় মানতে পারেননি। শেষদিকটায় শুধুই দু’পাশে মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না না এটা ঠিক নয়’ বলতেন।” ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে মা ও বাবা শেষ চেষ্টাও করেছিলেন। আইনি লড়াই লড়তে জমিজমা সব বিক্রি করে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন বাবা বংশীধর।
একদিকে ছেলে, অন্যদিকে বেঁচে থাকার রসদ হারিয়ে মাও বেসামাল অবস্থায় শেষ কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন বলে জানালেন বিকাশবাবু। তিনি বলেন, “মা এত আইনকানুন বুঝতেন না। সেসব নিয়ে মাথাও ঘামাতেন না। তিনি শুধু জানতেন, তাঁর মেজ ছেলে এ কাজ করতে পারে না। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। মা, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবুর নাম নিতে চাইতেন না। বুদ্ধদেববাবু ও তাঁর স্ত্রীর চক্রান্তেই ধনঞ্জয়কে হারাতে হল বলে শেষদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন মা। বলতেন, “ওরাই কাউকে বাঁচাতে আমার ছেলেকে বলি দিল। ওদের ভাল হবে না।” বিকাশবাবু বলেন, “আজ আমারও মনে হয়, শুধুই একটা বাজে পরিকল্পনা আমাদের সবকিছু শেষ করে দিল।”
১৯৯০’র ৫ মার্চ থেকে ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট। সব কাগজে তখন কোথাও ধনঞ্জয় ভিলেন, কোথাও আবার তাঁর স্ত্রী পূর্ণিমা কেঁদে বলছেন, তাঁর স্বামী নির্দোষ। কোথাও আবার ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিক। তাদের ছবি, তাদের বক্তব্য। স্বাধীনতা দিবসের সকালে সব কাগজের হেডলাইন সেই ধনঞ্জয়ের ফাঁসিই। তারপর…। বিকাশবাবু বলেন, “তারপরের এই ১৮ বছরে আরও অনেক ভয়ংকরতম ঘটনা কয়েক মিনিট, কয়েক ঘণ্টা বা বড়জোর কয়েকদিনের জন্য আমাদের বিচলিত করেছে, আমরা শিহরিত হয়েছি, কালের নিয়মে আবার তারপর ভুলে গিয়েছে মানুষ।” প্রশ্ন তুললেন, “ধনঞ্জয়কে ফাঁসি দিয়ে কী লাভ হল? দেশে ধর্ষণ, খুন কমানো গেল? নাকি যাঁদের টাকা আছে, তাঁরা পার পেয়ে গেলেন, আর আমরা…?”