রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়, রাঁচি: মহেন্দ্র সিং ধোনির নামে স্ট্যান্ড। অথচ মহেন্দ্র সিং ধোনিই তার উদ্বোধন করছেন না! বুধবার রাঁচিতে পা দেওয়ার পর থেকে নানা রংয়ের, নানা রকমের পরস্পরবিরোধী আবেগস্রোত চোখে পড়ছিল। পুরোটাই রাঁচিতে ধোনির শেষ ওয়ানডে ঘিরে। কেউ বিলাপ করছেন। কেউ নস্ট্যালজিক হয়ে পড়ছেন। কেউ আবার রাঁচিতে শেষ ম্যাচ ধারণাটারই সুতীব্র প্রতিবাদী। আর সঙ্গী হিসেবে বারবার যেটা উঠে আসছিল, মহেন্দ্র ধোনির মহানুভবতা প্রসঙ্গ। মেকন মাঠের গ্রাউন্ড ইনচার্জ উমাকান্ত জেনা থেকে শুরু করে ধোনির শৈশবের কোচ কেশব বন্দ্যোপাধ্যায়- স্মৃতির দেরাজ হাট করে খুলে বার করে আনছিলেন একের পর এক হীরে-পান্না। মেকন মাঠের গ্রাউন্ড ইনচার্জ বলছিলেন, কীভাবে ধোনি ভারত খেলার পরেও তাঁর বাড়িতে গল্পগুজবের সময়ে বসে থাকতেন মাটিতে, আর তিনি নিজে বসতেন চেয়ারে! কেশব আবার বললেন, কী ভাবে আজও তাঁর বাড়িতে মধ্যরাতে উপস্থিত হয়ে চাউমিন খাওয়ার বায়না ধরেন ধোনি!
কে জানত, ধোনির মহানুভবতা নিয়ে তার চেয়েও বড় চমক একটা থাকবে। রাঁচি স্টেডিয়ামে ধোনির নামে স্ট্যান্ড যে করা হবে, তার সিদ্ধান্ত বেশ কিছু দিন আগেই নিয়ে ফেলা হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে ভাবা হয়েছিল যে, ধোনিকে দিয়েই স্ট্যান্ড উদ্বোধন করানো হবে। কিন্তু সংস্থার সেই অনুরোধ যেতে পত্রপাঠ তা নাকচ করে দেন ধোনি। কারণ? কারণ- ধোনির মতে তিনি নিজেও ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট সংস্থার এক অংশ। আর সেই ক্রিকেট সংস্থার অংশীদার হয়ে নিজের স্ট্যান্ড নিজেই উদ্বোধন করা তাঁর পক্ষে শোভা পায় না! ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট সংস্থার সচিব দেবাশিস চক্রবর্তী বলছিলেন, “যখন ধোনিকে স্ট্যান্ড উদ্বোধনের কথা বলতে গেলাম, তখন ও বলল যে আমি যদি সেটা করি, তা হলে মনে হবে ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট সংস্থার অংশ আমি নই। কিন্তু আপনারা আমার নামে প্যাভিলিয়ন করার কথা ভেবেছেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ। সত্যি বলতে, ধোনির মতো এত মাটির কাছাকাছি থাকতে আমি কাউকে দেখিনি।”
[শেষ ওভারে কেদারের বদলে বিজয় শংকর কেন? ফাঁস করলেন কোহলি]
এক এক সময় মনে হচ্ছে, এ রকম কিছু একটা না ঘটলেই বরং ধোনিকে ঘিরে আবেগ-শ্রদ্ধা-ভালাবাসা-ভাললাগার বৃত্তটা অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তা সে যতই ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট সংস্থা ধোনির এ হেন সিদ্ধান্তে অস্বস্তিতে পড়ুক (প্রকাশ্যে অবশ্য স্বীকার করা হচ্ছে না) রাঁচিতে সকাল থেকে ঢোকার পর ধোনি নামক একের পর এক আবেগের হিমশৈল যে ভাবে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছিল! অর্ধেক লোক শুনতেই চাইছে না যে, আগামী শুক্রবারই, রাঁচিতে ধোনি শেষ বার! বরং প্রসঙ্গ শোনামাত্র কর্কশ ধাতানি উপহার পালটা উপহার দেওয়া হচ্ছিল। সীমন্ত লোহানি যেমন। এমনি নাম বললে কেউ চিনবে না। কিন্তু ‘এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’র পর শ্রীমন্ত লোহানি ওরফে চিট্টু-র নাম জানবে না, ভূ-ভারতে খুব কম আছে। তা, এ দিন ‘চিট্টু’ ফোনে প্রায় ঝাঁজিয়ে উঠে বললেন যে, “আরে দাঁড়ান, কী করে ধরে নিচ্ছেন এটাই শেষ? মাহি নিজে স্টেটমেন্ট দিয়ে বলেছে বিশ্বকাপের পর আর খেলবে না? আশ্চর্য সব কথা!” জহর বিদ্যামন্দিরে ধোনির ক্লাস নেওয়া শিক্ষিকা সুষমা শুক্লা আবার শোকতপ্ত ভাবে বললেন, “ক্রিকেট ভাল লাগত না আমার। মাহি খেলতে শুরু করার পর ক্রিকেটের প্রেমে পড়ি। ভাবতেই পারছি না, এটাই ওর শেষ ম্যাচ হবে রাঁচিতে। আরও তো খেলতে পারত অনায়াসে।” শুধু শৈশবের কোচ কেশব বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা গেল, নিজের আবেগের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছেন। রাঁচি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের নিকটবর্তী নিজ ফ্ল্যাটে বসে বলছিলেন, “গত অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগে কথায় কথায় বলেছিল, আর টানবে না। ছেড়ে দেবে। তবে টানলেও অসুবিধে ছিল না।”
মহেন্দ্র সিং ধোনির পক্ষে এ দিন এত কিছু জানা সম্ভব ছিল না। তাঁকে ঘিরে শহরজুড়ে যখন আবেগের এমন উথালপাথাল চলছে, তখন তিনি এয়ারপোর্টে নেমে ‘হামার’ চেপে রওনা দিয়েছেন নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। দুই টিম ইন্ডিয়া সতীর্থ কেদার যাদব আর ঋষভ পন্থকে নিয়ে। ধোনি তাই আর জানবেন কী করে, ঘরের মাঠে যত তাঁর সম্ভাব্য অন্তিমলগ্ন এগিয়ে আসছে, তত শহর ফিরে যাচ্ছে তাঁর শৈশব-কৈশোর-যৌবনের অলিগলিতে। জহর বিদ্যামন্দিরের শিক্ষিকা গড়গড়িয়ে বলে দিচ্ছেন, কী ভাবে স্কুলের এক অনুষ্ঠানে ধোনিকে দেখার পর চলৎশক্তিরহিত হয়ে পড়েছিল স্কুলেরই এক কিশোরী। ছোটবেলার কোচ অক্লেশে বলে দিচ্ছেন, কীভাবে ধোনিকে বাঁচাতে দিনের পর দিন তিনি লড়ে যেতেন স্কুল প্রিন্সিপালের সঙ্গে! ধোনির অপরাধ? না, ছক্কা মেরে জানালার কাঁচ গুঁড়িয়ে দেওয়া। মেকনের মাঠকর্মী তো আজও চোখের সামনে দেখতে পান বছর আড়াইয়ের মাহিকে। যে দুপুরবেলায় প্লাস্টিক ব্যাট, বল নিয়ে মাঠে উপস্থিত হত আর তিনি ধমকেধামকে বাড়ি ফেরত পাঠাতেন। আর সঙ্গে ওই, ওই অদৃশ্য নীরব কোরাস- মাহি ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু কেন দেবে? শুধু একটাই যা দুঃখ। এত প্রাপ্তির মধ্যেও একটাই যা তীব্র হতাশা।
[বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়েই বদলা নিক ভারত, চাইছে কাশ্মীর]
দুপুরের মেকন কলোনি। বাড়ির নম্বর- ই ২৫। কলিংবেল বাজাতে যে মধ্যবয়সি ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন, তাঁর মুখচোখে একরাশ বিরক্তি। দুপুরের ভাতঘুম নষ্ট হওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। এবং কলকাতার আগন্তুকের সঙ্গে অপর্ণা শর্মা নামক মহিলার কথোপকথন এ রকম: মহেন্দ্র সিং ধোনি আগামী শুক্রবার রাঁচিতে শেষ বার খেলবেন, জানেন? যাবেন খেলাটা দেখতে? “না। আর শেষ কেন? এরপর আইপিএল খেলবে, বিশ্বকাপ খেলবে।”কিন্তু দু’টোর একটাও তো রাঁচিতে নয়। শুক্রবারই আদতে শেষ। “তো? ওর খেলা আগেও দেখেছি রাঁচিতে। নতুন দেখার কিছু নেই! বড় প্লেয়ার, রাঁচির নাম উজ্জ্বল করেছে। আমরা যাব না খেলা দেখতে!” এটা মহেন্দ্র সিং ধোনির পুরনো বাড়ি! আর ভদ্রমহিলা ধোনি পরিবার ছেড়ে যাওয়ার পর ওই বিখ্যাত বাড়ির নতুন অধিবাসী! যিনি ধোনির পুরনো বাড়ির বাসিন্দা হয়েও জানেন না শুক্রবার রাঁচিতে ধোনির শেষ ম্যাচ। বরং তাঁর শরীরীভাষায়, মুখেচোখে লেগে থাকে এক আকাশ নির্লিপ্ততা। ঠিক মহেন্দ্র সিং ধোনিরই মতো!
The post রাঁচির স্টেডিয়ামে নিজের নামে স্ট্যান্ড উদ্বোধন থেকে সরে এলেন ধোনি appeared first on Sangbad Pratidin.