shono
Advertisement

‘ভয় পেয়ে মৃণালদাকে মিথ্যে বলেছিলাম’, একান্ত সাক্ষাৎকারে অকপট কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

'পালান' ছবি নিয়ে কথা বলতে গিয়েই ফাঁস অতীতের গল্প।
Posted: 03:36 PM Sep 15, 2023Updated: 04:09 PM Sep 15, 2023

মৃণাল সেনের শতবর্ষে কৌশিক গঙ্গোপাধ‌্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ‌, ‘খারিজ’ থেকে অনুপ্রাণিত তাঁর ছবি ‘পালান’। ছবির মুক্তির আগে পরিচালকের সঙ্গে কথোপকথনে শম্পালী মৌলিক।

Advertisement

মৃণাল সেনের ‘খারিজ’ থেকে অনুপ্রাণিত আপনার ‘পালান’। ছবিটি বানানোর ইচ্ছেটা কীভাবে দানা বেঁধেছিল?
প্রথমত, শতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো একটা ছুতো। বড় বড় পরিচালক যাঁদের প্রভাব আমাদের মানে ফিল্মমেকারদের ওপর থাকে, তার প্রভাব বোঝানোর জন‌্য আলাদা করে শতবর্ষ থাকে না। সব ছবির মধ্যে মিলেমিশে থাকে সেগুলো। কাজেই ‘নগর কীর্তন’, ‘সিনেমাওয়ালা’, ‘ছোটদের ছবি’ এই ধরনের ছবির মধ্যে মৃণাল সেনের প্রভাব আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে। তাঁকে আমি বহুবার উদ্‌যাপন করেছি আমার মতো করে। তাঁর জন‌্য আমার ভাললাগা, এবং অনুপ্রেরণা বহুবার ফিরে এসেছে। এবার শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার সুযোগ আসে। এমন তো নয়, শতবর্ষে ওঁকে নিয়ে বিরাট উৎসব হচ্ছে শহরে। বরং কয়েকটা জায়গায় অনুষ্ঠান, কলেজে একটা জমায়েত এটুকুই হয়েছে। সেখানে একটা ছবির মাধ‌্যমে যদি তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো যায়, নাথিং লাইক ইট।

 

‘খারিজ’-এর অঞ্জন দত্ত, মমতা শঙ্কর, শ্রীলা মজুমদার এবং দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত রয়েছেন এই ছবিতে। কিন্তু সেই ছবির সিক্যুয়েল নয় ‘পালান’।
না, সিক্যুয়েল নয়। একদম অন‌্য গল্প। ওই চরিত্রগুলো এক রয়েছে।

সেটাই কি দুটো ছবির যোগের জায়গা?
হ্যাঁ, চরিত্রটাই যোগের জায়গা। আর ডেফিনিটলি এদের ইতিহাসটা, সেটা তো ‘খারিজ’। এটা নতুন গল্প। যাঁরা ‘খারিজ’ দেখেননি তাঁদের কোনও অসুবিধা হবে না এই ছবি দেখতে। কারণ সংলাপে তাদের পুরনো সমস‌্যাগুলো আলোচনা করাই আছে। তবে এটায় এক সেকেন্ডের জন‌্যও ‘খারিজ’-এর কোনও পুরনো ফুটেজ ব‌্যবহার করা হয়নি। গল্পটা আজকের দিনের। ৪১ বছর পরে মানুষগুলোর জীবনে নতুন সমস‌্যা থাকবে না, এ তো হতে পারে না। আমার কাছে, মৃণাল সেনকে শ্রদ্ধা জানানোর উপায় ছিল– তাঁর যে মানসিকতা, জীবনদর্শন, অ‌্যাটিটিউড, সেটা একটা গল্পের মধ্যে সেলিব্রেট করা।

ছবির একটা সংলাপ মনোযোগ কাড়ছে – ‘সময় বদলায়, সমস‌্যাটা নয়।’ কোন সমস‌্যার কথা উঠে আসছে? ট্রেলার থেকে আঁচ পাওয়া যায় পুরনো বাড়ি ছাড়ার বিষয়টা রয়েছে।
আমার কাছে বিষয়টা মধ‌্যবিত্তের সমস‌্যা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এত টেকনোলজি, কনজিউমারিজম এসেছে কিন্তু সেই সমস‌্যাগুলো বদলায়নি। কারণ, মধ‌্যবিত্তের সবচেয়ে বড় পুঁজি আত্মসম্মান। সেলফ প্রাইড প্রোটেকশনটাই তার সবচেয়ে বড় সমস‌্যা। আজকে ধরো ‘বিপজ্জনক’ বোর্ড টাঙানো কিন্তু বাড়িতে মানুষ থাকে, আমরা এমন দেখেছি। অনেক খবর পড়েছি, বারান্দা ভেঙে পড়ে লোক মারা গেছে। এমন তো নয় সেদিন ভূমিকম্প হয়েছিল। আসলে বাড়ির বারান্দাটা ঝুলছিল কিন্তু তাদের অন‌্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। প্রত্যেকটা মানুষ কিন্তু ট‌্যাক্স পেয়ার, তাদের প‌্যান-আধার কার্ড আছে। অর্থাৎ সে সম্মাননীয় নাগরিক। সে ধনী কি দরিদ্র বড় কথা নয়। তাহলে তাকে বিপজ্জনক অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না কেন? সেইটা আমার কাছে বড় সমস‌্যা। মৃণালদার ছবিটায় স্ট্রং সোশ‌্যাল স্টেটমেন্ট ছিল চাইল্ড লেবার নিয়ে এবং আমাদের ক্লাস ডিভিশন নিয়ে। ওই সময় দাঁড়িয়ে সেটা একটা স্টেটমেন্ট। আমারও মনে হয়েছে, মৃণালদাকে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে স্টেটমেন্ট থাকা দরকার ছবির মধ্যে। যেটা আমাদের সামাজিক অবস্থানকে অ‌্যাড্রেস করবে।

[আরও পড়ুন: ভেজা শরীরে সুইমিং পুলেই ঘুমিয়ে পড়লেন আলিয়া ভাট! দেখুন ভিডিও]

উনি নিজের কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ নিয়ে অত‌্যন্ত স্পষ্ট ছিলেন। সেই দিকটা কি ছবিতে উঠে আসবে? বা ওঁর জীবনদর্শনের কথা?
নিশ্চয়ই ওঁর জীবনদর্শনের কথা উঠে আসবে। উনি কমিউনিস্ট ছিলেন, সেটা তো অন‌্যদিক। আমার কাছে ওটা হিউম‌্যানিজম, কমিউনিজম নয়। সেই হিউম‌্যানিজম-কে সেলিব্রেট করা, মানুষের আত্মমর্যাদাকে সেলিব্রেট করতে চেয়েছি। কারণ কমিউনিজম দরিদ্র- প্রান্তিক মানুষদের প্রোটেকশন দিয়ে এসেছে। সেই মানসিকতাই মৃণাল সেনের। সেই জায়গাটাই উদ্‌যাপন করেছি ছবিতে।

আপনার সঙ্গে মৃণাল সেনের আলাপ ছিল। আপনার টেলিফিল্মও দেখেছেন উনি।
উনি দেখতেন এবং ফোন করে জানাতেন। একদিন সকালে ফোন করে বললেন, ‘আমি মৃণাল সেন বলছি। আপনি কি কৌশিক?’ তখন অনেক কম বয়েস আমার। ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল। বললাম, “হ্যাঁ, বলুন স‌্যর। উনি বললেন, ‘তোমার নম্বর আমি সুনেত্রার থেকে নিয়েছি।’ ফোন করে ‘শেষকৃত‌্য’ ছবির খুব প্রশংসা করলেন। তারপর থেকে বেশ কয়েকবার। ‘উষ্ণতার জন‌্য’, ‘অতিথি’ দেখেও করেছিলেন। বলতেন, ‘এগুলো যদি টেলিভিশনেই বানিয়ে ফ‌্যালো, ছবি করবে কবে?’ বলেছিলাম, ‘আমাকে কেউ ছবির জন‌্য টাকা দিচ্ছে না। আমাকে তো একটা কিছু করতে হবে।’ বলতেন, ‘কিছু সাবজেক্ট সরিয়ে রাখো। যেগুলো সিনেমা হবে না, সেগুলো টিভি-তে করো।’ আবার শাসনও করতেন।

কীরকম?
যখন ‘শূন‌্য এ বুকে’ বানিয়েছি। একটা টিজার পোস্টার ক‌্যাম্পেনিং করেছিলাম, বিখ‌্যাত হয়ে গেছিল হঠাৎ। ওই– ‘ভরা বুক না বুকভরা ভালবাসা।’ মৃণালদা এটা পছন্দ করেননি। আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘এ ভাবে কেন পাবলিসিটি করছ তুমি? তোমার তো এটা করার দরকার নেই। দর্শক তো এমনিই আসবে।’ আমি ওঁকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম। আমি জানতাম ওটারই প্রভাবে নন্দনে চার সপ্তাহ হাউসফুল ছিল। আমি ভয়ে ওঁকে বলেছিলাম, ‘আমি কিচ্ছু জানি না। যে এজেন্সি করছে, তারাই ওটা করেছে।’

‘পালান’-এর ঘরানা আর ‘অর্ধাঙ্গিনী’র ঘরানা একদম আলাদা। ‘অর্ধাঙ্গিনী’-র যে তুমুল বক্স অফিস সাফল‌্য, সেটা তো ‘পালান’-এর ক্ষেত্রে আশা করা যাচ্ছে না।
যে মধ‌্যবিত্তকে স্পর্শ করেছিল ‘অর্ধাঙ্গিনী’, এটা ঠিক তাদের গল্প। যদি বহুতল বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে দ‌্যাখো, নিচে যে স্ট‌্যান্ড অ‌্যালোন বাড়ির ছাদগুলো দেখবে, প্রত্যেকটা বাড়িতে অঞ্জন সেন, মমতা সেন আছে। ‘পালান’-এর ক্ষেত্রে আমি ইন্টারেস্টেড না বক্স অফিস নিয়ে। কারণ, একটা পুজো করতে গিয়ে ঈশ্বর কী কী বর দেবে আমাকে এটা ভেবে পুজো করলে, সেটা ধান্দাবাজি হয়ে যাবে। মৃণাল সেনকে শ্রদ্ধা জানাব, তার সঙ্গে এক্সেল শিট দেখব, তা হয় না। ওই মানুষটা জীবনে বোধহয় এক্সেল শিট দেখেননি, হাউসফুল বোর্ড-ও গোনেনি।

অ‌্যাওয়ার্ডের জন‌্য ছবি না বক্স অফিসের জন‌্য ছবি– আপনি কোন দিকে ঝুঁকে?
অ‌্যাওয়ার্ডের জন‌্য ছবি নয়। সেই বয়স আমার পেরিয়ে গেছে। আর ওটা নিয়ে উন্মাদনা নেই। কারও যদি মনে হয় দেবে। বেশি অ‌্যাওয়ার্ড পাওয়ারও বিপদ আছে, রাখার সমস‌্যা।

তাহলে এখন বক্স অফিসকে গুরুত্ব দেন?
বক্স অফিসের থেকেও বড় কথা, দর্শক ছবি দেখুক। প্রোডিউসারকে যদি টাকা ফেরত না দিতে পারি, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফেস্টিভ‌্যালে ছবি দেখিয়ে আমার লাভ নেই। কারণ, প্রযোজক আমাকে আর টাকা দেবে না। আমি যে সব প্রযোজককে চিনি তাদের আনন্দ পেতে দেখেছি, যখন ছবি হিট হয়। সেই চেষ্টাই করি। তার জন‌্য মৃণালদার ছবি যে মেজাজের হত, তার থেকে যদি আমার ছবি সরেও আসে অসুবিধা নেই। আই অ‌্যাম গ্ল‌্যাড যে মৃণালদা ‘পালান’ দেখবেন না। উনি আমাদের মাঝে থাকলে আমি কিছুতেই ‘পালান’ বানাতাম না। শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর তো অনেক পথ থাকে। আরও দু’জনে ওঁকে নিয়ে কাজ করছেন। অঞ্জন দত্ত ওঁকে খুব কাছ থেকে চেনেন। উনি মৃণালদাকে নিয়ে কাজ করছেন। সৃজিত করছে, মৃণালদার বায়োপিকের মতো। কাজেই দুটো ছবি জীবনীভিত্তিক, আমারটা জীবনদর্শন-ভিত্তিক।

[আরও পড়ুন: হাতে স্যালাইন, হাসপাতালেই ‘জওয়ান’ ছবির গানে নাচ রোগীর! ভিডিও দেখে কী বললেন শাহরুখ?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement