সংকলন বা সংগ্রহও কি ‘সম্পাদনা’ আখ্যা পাওয়ার যোগ্য? বাংলা বই প্রকাশনার আধুনিক জগতে এমন ‘সম্পাদক’ বিস্তর দেখা যায়, যাঁরা শুধু পুরনো লেখাগুলি সংগ্রহ করে পরপর সাজিয়ে সংকলনটুকু করেছেন, অথচ বইয়ের প্রচ্ছদে বা টাইটেল পেজে তাঁদেরই নাম সাড়ম্বরে ঘোষিত হয়েছে ‘সম্পাদক’ হিসাবে। সম্পাদনা ছাড়া, অজস্র ভুলে ভরা বইয়েও, ‘সম্পাদক’ উজ্জ্বল হয়ে থাকেন কী করে? লিখছেন সম্পাতি।
বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক, শিল্প-বিশেষজ্ঞ, সমাজতাত্ত্বিক এবং ভ্রামণিক অধ্যাপক নির্মলকুমার বসুর লেখা কোনারক-সম্পর্কিত বইটি বহুকাল অলভ্য থাকার পর দেড় দশক আগে যখন তার সটীক সংস্করণ প্রকাশিত হয়, সেই সংস্করণ প্রসঙ্গে বইটির দুই টীকাকার বলেছিলেন, ‘সম্পাদনার ছোঁয়া এই বইতে তেমনভাবে নেই কারণ নির্মলকুমার বসুর লেখা সম্পাদনা করার সাহস কল্পনার বাইরে।’ এই বিষয়ে একটু চিন্তা করলেই মনে হবে, তুখড় সাহিত্যিক এ-দেশে অনেক এসেছেন, যাঁদের কালোত্তীর্ণ এবং রসোত্তীর্ণ সৃষ্টি যখন নিয়মিতভাবে বা অনেক সময়ের ব্যবধানে নতুন করে প্রকাশিত হয়– তখন সেই পুরনো লেখায় সম্পাদনার পরশ দেওয়ার প্রয়োজন তো হয়-ই না, বরং সেগুলি রদবদল বা পরিমার্জন করার যোগ্য কেউ আছেন বলেও বোধ হয় না।
তবে বাংলা বই প্রকাশনার আধুনিক জগতে এমন ‘সম্পাদক’ বিস্তর দেখা যায়, যাঁরা শুধু পুরনো লেখাগুলি সংগ্রহ করে পরপর সাজিয়ে সংকলনটুকু করেছেন, অথচ বইয়ের প্রচ্ছদে বা টাইটেল পেজে তাঁদেরই নাম সাড়ম্বরে ঘোষিত হয়েছে ‘সম্পাদক’ হিসাবে।
তাঁদের ভূমিকা ‘সংকলক’ বা ‘সংগ্রহকারী’-র বেশি নয়। যেমন, পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কলকাতা সমগ্র ১’ (প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং) বইটির কথা। সেখানে ‘সম্পাদক’-আখ্যাত ব্যক্তি অয়ন দত্ত বলেই রেখেছেন, সংকলিত গ্রন্থগুলির ‘শেষতম সংস্করণের মূল পাঠটিকে বইয়ে মুদ্রিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ অতএব, ‘সম্পাদনা’ বলতে যা বোঝায়, এই সংকলনে তা সম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে এই বইয়ের ‘সম্পাদক’-এর কাজ হল বইগুলি প্রচ্ছদ-সহ সংগ্রহ করা, প্রকাশের কালানুক্রমে সাজানো, একটি কৈফিয়ত রচনা এবং গ্রন্থশেষে সংযুক্ত ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশটি তৈরি করা। হয়তো আরও কিছু কাজও তিনি করেছেন। কিন্তু যা-ই করে থাকুন, তাতে ‘সম্পাদক’ পদমর্যাদার অধিকারী হওয়া যায় তো?
[আরও পড়ুন: অধরা ভিটেছাড়াদের ক্ষতিপূরণ! বারাণসীর ভোটে এবার ইস্যু কাশী বিশ্বনাথ করিডর]
পূর্ণেন্দু পত্রীর লেখায় না-হয় সম্পাদনার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তেমন যে একেবারে দরকার হয় না, তা তো নয়। স্বয়ং সত্যজিৎ রায়-ই তো একবার ফেলুদার গল্পে ভুলবশত পুরীর রেল স্টেশনে মাদ্রাজ মেল এনে ফেলেছিলেন। পরে সেই কাহিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় একবার সব ঠিক আছে কি না, দেখতে গিয়ে, অভিজ্ঞ প্রকাশক বাদলবাবু ভুলটি অনেকাংশে সংশোধন করে দিতে পেরেছিলেন বলে শোনা যায়। তাই বলে অবশ্য ভদ্রলোক বইটির সম্পাদকের পদ দাবি করেননি।
সম্পাদনা প্রয়োজন হয়েছে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত-র রচনা সংকলনের ক্ষেত্রেও। কারণ, একই বিষয় নিয়ে তঁার লেখা প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে আলাদা শিরোনামে। স্বাভাবিক কারণেই সেগুলির বক্তব্য সব ক্ষেত্রেই এক। শুধু তা-ই নয়, কখনও একই ভাষায় একইভাবে রাধাপ্রসাদ বিষয়টি বিবৃত করেছেন, যাকে ‘পুনরুক্তি’ বলা অন্যায় হবে না। কিন্তু, ‘বাণীশিল্প’ প্রকাশিত রাধাপ্রসাদ গুপ্ত-র ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ বইটিতে সগর্জনে ঘোষিত একজন ‘সম্পাদক’ থাকলেও, তিনি, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, খেয়াল করেননি যে, ‘বইয়ের জগতের কালজয়ী ত্রয়ী’, ‘একটি মৃত্যুহীন বই’ এবং ‘একটি পৃথিবী কঁাপানো বই’ শীর্ষক তিনটি প্রবন্ধে এমন পুনরুক্তি ছড়িয়ে রয়েছে পাতায়-পাতায়, ছত্রে-ছত্রে। আর সেই পুনরুক্তি এমনই, যাতে তিনটি প্রবন্ধর তফাত করা মুশকিল।
[আরও পড়ুন: বুকে পদ্মের ব্যাজ, নির্বাচনে হস্তক্ষেপ! এবার রাজ্যপালের বিরুদ্ধে কমিশনে তৃণমূল]
বিভিন্ন প্রবন্ধ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের সময় রেফারেন্স হিসাবে রাধাপ্রসাদ কখনও ছবিও যুক্ত করেছিলেন
লেখার সঙ্গে। সংকলনে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলির বেশ কয়েকটিতে সেই চিত্রাবলির উল্লেখ থাকলেও ছবিগুলি এই বইয়ে ছাপা যায়নি। ছাপা না-যেতেই পারে। কিন্তু তার জন্য সম্পাদকীয় টীকা না-থাকার কারণ বোধগম্য হয় না। এই বইয়ের সম্পাদকের গা-ছাড়া মনোভাবের চরম নমুনাটি থেকে গিয়েছে গ্রন্থ-শেষে সংযুক্ত ‘প্রবন্ধের কালানুক্রমিক তালিকা’-য়। সেই তালিকায় ১৯৮৯-এ প্রকাশিত প্রবন্ধের পর এসেছে ১৯৮২ বা ১৯৮৫-তে প্রকাশিত প্রবন্ধের উল্লেখ। আর তারও অনেক পর ১৯৭৯ বা ১৯৮১-র প্রবন্ধের শিরোনাম। সম্পাদনার প্রয়োজন সত্ত্বেও সম্পাদনা না-করে যে বাংলা বইয়ের ‘সম্পাদক’ হওয়া যায়, এই বই যেন তা-ই প্রমাণ করে!
বিজ্ঞানী পার্থ ঘোষের বৈজ্ঞানিক ও ব্যক্তিগত জীবনের স্মৃতিচারণ ‘কণামাত্র’ (আনন্দ পাবলিশার্স) বইটি লেখকের হয়ে অনুলিখন করেছেন সিজার বাগচী। এটি অনুলিখন, অনেকটা ‘ঘোস্ট রাইটিং’-এর রকমফের। সেটুকু করে কি অনুলেখক ‘সম্পাদক’ হতে পারেন? মূল লেখকের কথা শুনে যিনি নিজেই বইটি লিখেছেন, তঁার নিজেরই লেখা পরিমার্জন বা সংশোধন করা যে ‘সম্পাদনা’ হতে পারে, তা আর কে জানত! আর, সেই সম্পাদনা এমনই, যার ফলে রাসেলের ‘এবিসি অফ রিলেটিভিটি’ হয়ে যায় ‘এবিসিডি অফ রিলেটিভিটি’ কিংবা ‘র্যানসম অ্যান্ড রেপিয়ার’ দঁাড়ায় ‘র্যানসম অ্যান্ড রেপিরায়’-এ।
‘পূর্ণেন্দু পত্রীর সত্যজিৎ’ নামক যে-বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে দে’জ পাবলিশিং থেকে, সম্পাদনার প্রয়োজন ছিল না সেটিতে সংকলিত লেখাগুলির। বলা যায়, সেগুলিও ‘সম্পাদনা করার সাহস কল্পনার বাইরে’-ই থাকা উচিত। সম্পাদক অয়ন দত্তকে তাই সম্পাদনা করতে হয়নি। তার বদলে সংগ্রহ করতে হয়েছে লেখাগুলি, সেগুলিকে বিষয়ানুক্রমে ভাগ করতে হয়েছে আর খুঁজতে হয়েছে লেখাগুলি প্রথম প্রকাশের সূত্র। এই কাজ বা কিছু ক্ষেত্রে বানানরীতির সামঞ্জস্য নিয়ে আসা ছাড়া আর কিছু সম্পাদককে করতে হয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সেই কাজ তো আদতে সংকলক, ইংরেজিতে যাকে ‘কম্পাইলার’ বলা যায়, তঁার এবং প্রুফ-সংশোধনকারীর। তবে পূর্ণেন্দু পত্রীর এই বইটিতে খেল দেখিয়েছেন বটে বইটির ‘মুখবন্ধ’-লেখক উজ্জ্বল চক্রবর্তী। তিনি সম্ভবত ধরতে পারেননি, বইটির লেখক পূর্ণেন্দু পত্রী এবং বিষয়বস্তু সত্যজিৎ রায়।
[আরও পড়ুন: ‘কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’, ৪০০ আসনের টার্গেট পূরণে পুরনো স্লোগান মনে করালেন হিমন্ত]
ফলে সত্যজিৎ রায়ের মূল্যায়ন পূর্ণেন্দু পত্রী কতখানি করতে পারলেন, বা পূর্ণেন্দুর এই রচনাগুলি কেন এখনও প্রাসঙ্গিক– এসব আলোচনায় না গিয়ে মুখবন্ধের লেখক আদা-জল খেয়ে লেগে পড়লেন সত্যজিৎ আর পূর্ণেন্দুর তুলনামূলক আলোচনায়। আর, তা করতে গিয়ে বইয়ের বিষয়বস্তুকে ‘নাকছাবির হিরে’ আখ্যা দিয়ে বইটির লেখককে টেনে নামালেন ‘কচুপাতায় হিম’-এর স্তরে। যাঁর বইয়ের মুখবন্ধ লিখছেন, তাঁকেই কী অপমান করে বসলেন না মুখবন্ধর লেখক! এ যেন ‘লাইফ অফ স্যামুয়েল জনসন’-এর সম্পর্কে আলোচনা করতে বসে
ডক্টর জনসনের সঙ্গে জেমস বসওয়েলের তুলনা টানা।
পুনশ্চ বাংলা বইয়ের একজন নিষ্ঠ পাঠকের পর্যবেক্ষণ-স্বরূপ এই কথাগুলি বলা। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় সাব্যস্ত করা, বা কাজের বিচ্যুতি নিয়ে তাঁর সমালোচনা লক্ষ্য নয়। বাংলা বইয়ের জগৎ অবিলম্বে এই সূক্ষ্ম ভ্রান্তিগুলি কাটিয়ে উঠুক– এটাই কাম্য।