জয়ন্ত ঘোষাল: সোশ্যাল মিডিয়ায় বহুল প্রচারিত একটি মন্তব্য: এতদিন বাঙালি বিলেত ফেরত ডাক্তার দেখেছে, এবার দেখল বিলেত ফেরত রোগী। আপাত-লঘু মন্তব্য। কিন্তু এর মধ্যে আছে বাঙালির দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শ্লাঘার উপর এক তীব্র কষাঘাত। করোনা ভাইরাসের মহামারী দৌরাত্ম্যর পরও যদি আমরা ‘ভাল’, ‘দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন’ নাগরিকের পরিচয় দিতে না পারি, তবে এ দুঃসময় আরও জটিল, আরও প্রলম্বিত হতে পারে।
পৃথিবীতে চিনের পর প্রথম কোন দেশ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হল? ইটালি। ইতালির সবচেয়ে ধনী শহুরে নাগরিক এলাকায় এই রোগটির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ইটালির রাজশক্তি ভেবেছিল, এ সমস্যা সামলে নেবে। প্রথম দিকটিতে সেই অর্বাচীন বিলেতফেরত বঙ্গসন্তান রোগীটির মতোই হাবভাব ছিল ওদের। ‘ডোন্ট কেয়ার’। তারপর? দেশে নিউমোনিয়া-করোনার প্রকোপের মোকাবিলায় ভেন্টিলেটর আর অক্সিজেনই কম পড়ে গেল!
চিন বাদ দিয়ে ১১২টি দেশে করোনার থাবা প্রসারিত। ইটালিতে স্বাস্থ্য পরিষেবা ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’- এমনটাই রাষ্ট্রসংঘ পর্যন্ত মানত। কিন্তু সেই ইটালিতে মানুষের বেপরোয়া মনোভাব আর কিঞ্চিৎ বেশি গণতন্ত্র, অত্যধিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর সামাজিকতা দেশটাতে মড়ক লাগাল। চিন অবশ্য যা করেছে, যা করতে পেরেছে- তা ইটালি পারেনি, আমেরিকাও পারবে না। আমরা করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কীভাবে কতটা পারব জানি না।
[আরও পড়ুন: করোনার মারে অনিশ্চিতের পথে ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ]
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একদলীয় শাসনের সুবিধা নিয়ে চিনা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ‘ব্রুটাল কোয়ারেন্টাইন’ অর্থাৎ, বাধ্যতামূলক দমননীতির সাহায্যে একঘরে করেছে দেশের মানুষকে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি যতই বলুন, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক কাঠামোয় তা কি করা সম্ভব? প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘটনা জানার পর একবার ইউহান গেলেন, তারপরই নিয়ন্ত্রণের চিনা অপারেশন। স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে যেসব দেশে এক বিশ্বজনীন জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা আছে, সেসব দেশে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সহজ হচ্ছে। যেমন: ব্রিটেন। কিন্তু আমেরিকার মতো দেশে যেখানে বেসরকারি বাণিজ্যিক হাসপাতাল এখনও বেশি ক্ষমতাশালী লবি, সেখানে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ কঠিন। আমেরিকায় ২৮ মিলিয়ন মানুষ এখনও স্বাস্থ্যবিমার অধীনে নয়, ১১ মিলিয়ন মানুষ অবৈধ বসবাসকারী।
করোনা ভাইরাস নিয়ে আরও সমস্যা হল, এখনও এই ভাইরাসটি সম্পর্কে আমরা নিশ্চিতভাবে খুব বেশি কিছু জানি না। দ্বিতীয়ত, এই ভাইরাস মহামারীর আকার ধারণ করে যেভাবে দ্রুত ছড়াচ্ছে- ইটালি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে সে গতি আটকানো গেলেও, এখানে আমাদের গবেষক, চিকিৎসক ও রাষ্ট্রনেতাদের পক্ষে তা আটকানো সম্ভবপর তো? এখনও পর্যন্ত করোনার প্রকোপ গোটা দুনিয়ায় এবং আমাদের দেশে যা দেখা যাচ্ছে, তার সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ। বাজার—দোকান বন্ধ। বিশ্ব বাজারের আমদানি—রফতানি তথা শেয়ার বাজার সবই এক চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি। বাজার যদি স্তব্ধ হয়ে যায়, রাজস্ব সংগ্রহ যদি না হয়, তবে কর্মসংস্থান তথা জীবিকা কীভাবে চলবে? পরিস্থিতিতে কী পরিবর্তন হবে জানি না, কিন্তু ইতিমধ্যেই যা হয়ে গিয়েছে তাতেই সংকট যথেষ্ট গভীর। এমনিতেই বিশ্ব তথা ভারতের আর্থিক অবস্থা খারাপই ছিল। সেখানে করোনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিল।
এখন তাই ক্ষুদ্র রাজনীতি ভুলে, পারস্পরিক দোষারোপ ভুলে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের পাশে এসে দাঁড়াক- সেটাই কাম্য। চিন অভিযোগ করেছে, মার্কিন সেনাবাহিনী ইউহানে এই ভাইরাস ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর আমেরিকার প্রচার: চিন হল এই ভাইরাসের আঁতুড়ঘর, এখান থেকেই পৃথিবীতে ছড়িয়েছে; অতএব এ হল চিনের জৈব-রাসায়নিক যুদ্ধের রিহার্সাল। আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র বা সরকার নয়, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই প্রচার চলছে।
আর এখন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে কোনও জিনিস প্রচার করতে কোনও অসুবিধা নেই! কোনটা যে ‘সত্য’ আর কোনটা যে ‘মিথ্যা’- কে বিচার করবে? সত্য চাপা পড়ে যাচ্ছে ‘ফেক নিউজ’-এর দৌরাত্ম্যে । এ হল উত্তর—সত্য যুগ। তবে এ গুজবের বাস্তব ভিত্তি হল একটি উপন্যাস। মার্কিন ঔপন্যাসিক ডিন কুন্ট্জ-এর লেখা ‘দ্য আইজ অফ ডার্কনেস’—এর একটা পাতাও এখন ‘মহামারী’। ১৯৮১ সালে এই উপন্যাস যখন প্রকাশিত হয়, তখন ওই পাতায় ভাইরাসের নাম কিন্তু লেখা ছিল ‘গোর্কি—৪০০’। রুশ-মার্কিন চরম ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’-র সময়ই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ‘পেরেস্ত্রৈকা’-র পর যখন দু’—দেশের মধ্যে ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’-র অবসান হয়, তখন কুন্ট্জ সাহেব গোর্কি বাদ দিয়ে মারণ ভাইরাসটির নাম দিলেন ‘ইউহান—৪০০’। বইটি ১৯৮৯ সালে সংশোধিত হয়ে নবকলেবরে প্রকাশিত হয়।
আসলে ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’-র পর ততদিনে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে চিন। ‘সিএনএন’ ও ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ সম্প্রতি এসব তথ্য প্রকাশ করে আবার বাজার গরম করেছে। ’৮১ সালে ‘লেই নিকোল্স’ ছদ্মনামে ডিন কুন্ট্জ বইটি লেখেন, তারপর ’৮৯ সালে তিনি নিজের নামেই বইটি প্রকাশ করেন। তবে এখানেও তথ্য বিভ্রান্তি আছে। লেই নিকোল্স নাকি অন্য আর একজন ব্যক্তি ছিলেন, তা ‘ছদ্মনাম’ ছিল না। (তবে উইকিপিডিয়া, যা সাধারণ তথ্য পেতে মানুষের বেসিক সোর্স, সেখানে স্পষ্ট বলা যে, লেই নিকোল্স ছদ্মনাম-ই।)
জৈব রাসায়নিক যুদ্ধের সম্ভাবনা ও তার আগাম সায়েন্স ফিকশন সম্পর্কে আমার জ্ঞান কম। প্রবীণ সাংবাদিক তুলসী দত্ত, রূপকুমার বসু ও শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় এ ব্যাপারে বহু প্রবন্ধ লেখেন। জে. মিলার, এস. এন্ড্রেলবার্গ ও ব্রডের বিখ্যাত বই ‘জার্মস’। তাতেও এ ব্যাপারে আগাম অনেক কথা বলা হয়। কিন্তু আমার মনে হয় না, নিজের দেশের এত লোকসান করে চিন বা আমেরিকা কেউ—ই এ কাজ করবে। তাই আজ এসব গুজবভিত্তিক বৈরীর আবহকে না বাড়িয়ে বরং উচিত যৌথভাবে এই ভাইরাসের মোকাবিলা করা। দেখুন, এই ভাইরাস আজ কীভাবে ভারত ও পাকিস্তান, এই দু’টি দেশকেই কাশ্মীর সংকট ভুলিয়ে ঐক্যের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অনেক দিন পর কাঠমান্ডুতে দুটো দেশ মিলিত তো হল! প্রত্যেক বছর এ সময় ২৩ মার্চে ‘পাকিস্তান দিবস’ কেন্দ্র করে দিল্লিতে টেনশন বৃদ্ধি পায়। পাক হাই কমিশনে আমন্ত্রণ জানানো হয় হুরিয়াত নেতাদের। সেখানে এ বছর পাকিস্তান দিল্লি দূতাবাসে এই অনুষ্ঠানটিই বাতিল করে দিয়েছে।
ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন- দুই পক্ষ করোনা নিয়ে আলোচনায় বসছে। হয়তো দেখব উত্তর কোরিয়া আর কোরিয়াও কথা বলছে এই ভাইরাস নিয়ে। এই ভাইরাস যেহেতু পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত, তাই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত বন্ধ করতে হচ্ছে। সব রাষ্ট্রই সুরক্ষিত থাকার জন্য বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করছে। ‘কোয়ারেন্টাইন’ নামক (অধুনা জনপ্রিয়তম) শব্দটির আভিধানিক উৎসেও আছে ‘বন্দরের নিষেধাজ্ঞা’। রোগ সংক্রমণের প্রসার বন্ধ করার জন্য বন্দর এলাকায় যখন যাত্রীদের আলাদা করে রাখা হত, তখন তাকে বলা হত ‘কোয়ারেন্টিন’। আজ আবার সব দেশ নিজেদের ‘একঘরে’ করতে উদ্যত। আপাতত আমরাও তা করতে বাধ্য। সরকার করলেও তা মানতে হবে। গণতন্ত্রের নামে রোগীর যত্রতত্র বিচরণ সমর্থনযোগ্য নয়।
তবে এই সাময়িক রাষ্ট্রীয় ‘একঘরে নীতি’ বিশ্বায়নের সামাজিকতাকে যেন আঘাত না করে, কারণ একদিকে যেমন জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে ঠিক সেভাবেই সমস্ত দেশকে সমস্ত ভেদজ্ঞান ভুলে একত্রিত হতে হবে। মোকাবিলা করতে হবে করোনার। প্রয়োজন ভারসাম্য। একদিকে চাই বিশ্ব-ঐক্য সংহতি, অন্যদিকে কোয়ারেন্টিনের জন্য সংশ্লিষ্ট মানুষকে বাধ্য করা। গণতন্ত্র আর এই নির্দেশের মধ্যেও চাই সামঞ্জস্য। চিনের মতো ‘দমননীতি’ নয়, কিন্তু তাই বলে বিমানবন্দরে প্রত্যেক নাগরিকের পরীক্ষা হচ্ছে বলে অসহিষ্ণু ভারতীয়দের যখন টিভি ক্যামেরার সামনে চিৎকার করে সরকারকে গালি দিতে দেখছি, তখনও মনে হচ্ছে এহেন অসহিষ্ণুতা আজ মোটেই কাম্য নয়!
বরং প্রত্যাশা একটাই: দুনিয়ার গবেষক বিজ্ঞানীরা একত্র হয়ে খুব শীঘ্রই এই ভাইরাসেরও প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন, যেমনটা পেরেছেন অতীতে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বরিষ্ঠ সাংবাদিক,
দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া টিভি’—র রাজনৈতিক সম্পাদক
redhat.jayanta@gmail.com
The post COVID-19 কি তাহলে জৈব রাসায়নিক যুদ্ধের মহড়া? appeared first on Sangbad Pratidin.