shono
Advertisement
Voyeuristic Attitude

দৃষ্টিসুখের উল্লাসে!

‘ভয়্যারিজম’ শব্দটির অর্থ অন্য মানুষের ব্যক্তিগত ক্রিয়াকাণ্ড গোপনে পর্যবেক্ষণ করে আনন্দ পাওয়া।
Published By: Kishore GhoshPosted: 05:43 PM Nov 26, 2024Updated: 05:44 PM Nov 26, 2024

‘ভয়্যারিজ্‌ম’ শব্দটির অর্থ: অন্য মানুষের যৌন কার্যকলাপ বা ব্যক্তিগত ক্রিয়াকাণ্ড গোপনে পর্যবেক্ষণ করে আনন্দ পাওয়া। তবে এমন ভাবনায় ভ্রু-কোঁচকানোর আগে ভেবে দেখতে পারি যে, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে আমরা যারা নিয়মিত নাড়াচাড়া করি, অনেকেই কি অজান্তে এই ‘ভয়্যারিস্টিক’ আচরণে প্রবলভাবে আসক্ত নই? লিখছেন জয়তী চৌধুরী

Advertisement

নেটফ্লিক্সে কঙ্কনা সেনশর্মা পরিচালিত ‘লাস্ট স্টোরিজ ২’-এর (মুক্তি পেয়েছিল ২০২৩) ‘দ্য মিরর’ এপিসোডটি বেশ নাড়া দিয়ে গিয়েছে। এই সিনে-সিরিজটি বেশ কয়েকটি গল্পে গঁাথা। পরিচালক ‘দ্য মিরর’ পর্বটিতে ‘ভয়্যারিজ্‌ম’ (Voyeurism) ও শ্রেণি-সংঘাতকে অনন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে, বহু স্তরে শোভিত করে, উপস্থাপনা করেছেন।

ঈশিতা ও সীমা– সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণির দুই নারীর যৌন-আকাঙ্ক্ষা পূরণের গল্প ‘দ্য মিরর’। একদিকে, উচ্চবিত্ত নারী, ঈশিতার একক জীবনে বিলাসিতা এবং সামাজিক মর্যাদার অঢেল অবস্থান। অন্যদিকে, নিম্নবিত্ত পরিবারের সীমা, ঈশিতা-র গৃহ পরিচালিকা। সংগ্রামী সীমা, নিজের সামাজিক অবস্থান এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছে।

ঈশিতা একদিন হঠাৎ তারই ফাঁকা বাড়িতে, নিজের শোয়ার ঘরে, গৃহকর্মী সীমাকে ও সীমার স্বামীকে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দেখে ফেলে। এই অপ্রত্যাশিত দৃশ্যে ঈশিতা প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যায়, অপমানিত এবং বিব্রত বোধ করে। তারপর ঈশিতা দ্রুত বুঝতে পারে ফঁাকা বাড়িতে এটি একটি দৈনন্দিন ঘটনা। ধীরে-ধীরে ঈশিতার মধ্যে অদ্ভুত এক আকর্ষণ তৈরি হয়। নিজের লজ্জা এবং দ্বিধা কাটিয়ে সে প্রতিদিন গোপনে সীমা এবং সীমার স্বামীর রোম্যান্টিক সম্পর্কের এই গোপন মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে থাকে। এই ভয়‌্যারিস্টিক আচরণ ঈশিতাকে এক অনিশ্চিত ও উত্তেজনাপূর্ণ পথে নিয়ে যায়, যেখানে সে অজান্তেই সীমার সঙ্গে এক অদ্ভুত সম্পর্কের বঁাধনে জড়িয়ে পড়ে।

‘দ্য মিরর’-এ ঈশিতার ফ্ল্যাটে আয়নার অবস্থানটি অর্থবহ। যা নারীর শ্রেণি-বিভেদ ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি তুলনামূলক ‘মাধ্যম’ হিসাবে কাজ করে। পরিচালক কঙ্কনা সেনশর্মা অত্যন্ত সংবেদনশীলতা ও সূক্ষ্মতার সঙ্গে একটি অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করেছেন– যখন গৃহকর্মী সীমা প্রথমবার উপলব্ধি করে– ঈশিতা তাকে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দেখছে। আর, সেটি বুঝেও সীমা শোয়ার ঘরে স্বামীকে আলিঙ্গনের জন্য প্রস্তুত হয়। ফলে দেখা এবং দেখানোর এই উন্মুক্ত খেলায় পাশা হঠাৎ পাল্টে যায়।

‘কেমব্রিজ ডিকশনারি’-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘ভয়্যারিজ্‌ম’ শব্দটির অর্থ হল, অন্য মানুষের যৌন কার্যকলাপ বা ব্যক্তিগত ক্রিয়াকাণ্ড গোপনে পর্যবেক্ষণ করে আনন্দ পাওয়া। বস্তুত, মানুষের যৌন কার্যকলাপ বা ব্যক্তিগত বৃত্ত গোপনে দেখার মতো অস্বস্তিকর বিষয় নিয়ে এই গল্প! এমন ভাবনায় ভ্রু-কোঁচকানোর আগে ভেবে দেখতে পারি যে, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে আমরা যারা নিয়মিত নাড়াচাড়া করি, অনেকেই কিন্তু অজান্তেই এই ‘ভয়্যারিস্টিক’ (voyeuristic) আচরণে প্রবলভাবে আসক্ত!

বিগত কয়েক দশকে প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের প্রসারে জীবনযাত্রা ও সামাজিক আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে, বিবিধ সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তার সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়েছে অনেকটাই। এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ, বিতর্কিত এবং উদ্বেগজনক বিষয়– ‘ভয়্যারিজ্‌ম’।

সামাজিক মাধ্যম– যেমন: ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি আমাদের জীবনে একটি উন্মুক্ত পরিসর সৃষ্টি করেছে। এই মাধ্যমে ব্যক্তিগত জীবন প্রায়ই জনসাধারণের সামনে প্রকাশিত হয়, যা অনেককে অন্যের জীবনে উঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। এখান থেকেই ভয়্যারিজ্‌মের আধুনিক রূপের সূচনা। গলি থেকে রাজপথ– সব শ্রেণির মানুষকে– বন্ধু, শত্রু, বা অপরিচিত নির্বিশেষে– সমাজমাধ্যম এই উঁকি মারার ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। সমাজমাধ্যমে কিছু মানুষ সক্রিয়ভাবে, আবার, অনেকে নীরবে অংশগ্রহণ করে। সোশ্যাল মিডিয়াতে সেভাবে ফোটো শেয়ার না-করলেও, বা কোনও বিষয়ে তাদের মতামত সোচ্চারে না জানালেও, সমানভাবে সমাজমাধ্যমের ‘কনটেন্ট’ উপভোগ করে চলে। এখন, সমাজমাধ্যমের মজা হচ্ছে– এখানে ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ এবং ‘কনটেন্ট কনজিউমার’– দুই-ই হল সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা। একাধিক সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মে, স্বদেশে এবং বিদেশে, কে, কখন, বা কতজন মানুষ নীরবে এবং গোপনে আমার, আপনার প্রোফাইল দেখে চলেছে– সেই হিসাব আমাদের কারওরই নেই। তবে তা জানার দুর্মর বাসনাকে উপেক্ষা করা যায় না।

গোপনে একটি মানুষের জীবনযাপন অনুসরণ করা, আর ‘ভয়্যারিজ্‌ম’ কি এক? এখানে একটি খুব সূক্ষ্ম বিভাজনরেখা আছে। কৌতূহল মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। কৌতূহলের মতো স্বাভাবিক প্রবণতার জন্যই আমরা এলোমেলোভাবে অচেনা বা অল্প চেনা মানুষের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল, ফোটো, ভিডিও এবং পোস্ট অবিশ্বাস্য হারে দেখে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা সময় ব্যয় করে থাকি। কৌতূহল– তথ্য অনুসন্ধান দ্বারা চালিত। অন্যদিকে, ‘ভয়্যারিজ্‌ম’– গোপন দৃষ্টিসুখের সন্তুষ্টি দ্বারা চালিত। সমাজমাধ্যম আমাদের ‘মধ্যস্থ-ভয়্যারিজ্‌ম’-এ (mediated veyeurism) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার পূর্ণ সুযোগ করে দেয়। যে-কারণে, কোনও সেলিব্রিটি সঁাতার-পোশাক পড়া ছবি পোস্ট করলে ‘লাইক্‌স’ ও ‘কমেন্টস’-এর পাশাপশি ট্রোলিংয়ের ঢেউও বয়ে যায়। একই কারণে, সম্পর্কের ভাঙন, যৌন কেলেঙ্কারি, বিবাহবিচ্ছেদের মতো সংবেদনশীল ঘটনাকে সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় বা আলোচিত কনটেন্ট হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। বলাবাহুল্য, অগুনতি মানুষ ওসব কনটেন্ট পড়তে, তাতে লাইক করতে বা কমেন্ট করতে আকর্ষিত বোধ করে। ব্যক্তিগত যাপন এবং আচরণের এই উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার আমাদের সমাজের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার উপর নতুনতর জটিলতার সৃষ্টি করেছে।

‘ভয়্যারিস্টিক’ ব্যবহার আমাদের শুধু চেনা মানুষের নয়, নিজের জীবনের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক না-থাকা সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেও উঁকিঝুঁকি মারতে প্রলুব্ধ করে। অনস্বীকার্য, সমাজমাধ্যমে দৃষ্টিসুখ সাময়িক হলেও আপাত আনন্দ এবং সন্তুষ্টি প্রদান করে। গতানুগতিক, ক্লান্তিময়, সাদামাঠা জীবনের এ এক অমোঘ, আনকোরা আকর্ষণ। আপাতদৃষ্টিতে, ‘ভয়্যারিজ্‌ম’ বা গোপন দৃষ্টিসুখ একটি নির্দোষ আচরণ মনে হতে পারে। তবে, এই আচরণ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সীমারেখা কতটা মুছে ফেলছে– তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় বইকি। কেননা, অনেক সময় তা সহজেই সামাজিক ও নৈতিক সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলতে পারে।

‘ভয়্যারিজ্‌ম’ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে এই যোগসূত্রটি আমাদের অতি আধুনিক, ভার্চুয়াল সমাজের একটি অনুচ্চারিত, বাস্তব চিত্র। সমাজমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণহীন, অসচেতন ব্যবহার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সীমানা পেরিয়ে, অন্যের গোপনীয়তাকেও অসম্মান করতে পারে। পরিচিত এবং অপরিচিত মানুষের জীবনযাত্রার তুলনামূলক প্রবণতা মানুষের মানসিক ও সামাজিক আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে থাকে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে সাফল্য, সুখ এবং সম্পদের অতিরঞ্জিত উপস্থাপন প্রায়শই মানুষকে নিজেদের জীবনের সঙ্গে অন্যদের জীবন তুলনা করতে এবং অন্যের জীবনকে তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে করতে প্ররোচিত করে। ফলে, অনেকেই নিজেকে অসন্তুষ্ট, অসুখী এবং হীনমন্য বলে মনে করে। এই অনুভূতি থেকে হতাশা, ঈর্ষা এবং রাগ জন্ম নেয়, যা কখনও কখনও অনলাইন ট্রোলিং, আক্রমণাত্মক মন্তব্য বা অন্যান্য আবেগপ্রবণ আচরণে রূপান্তরিত হয়।

কঙ্কনা সেনশর্মার ‘দ্য মিরর’ আয়নায় দু’টি নারীকে মুখোমুখি দঁাড় করায় এবং নির্লজ্জভাবে তাদের অন্তরাত্মাকে উন্মুক্ত করে দেয়। সমান্তরালভাবে, সমাজমাধ্যমের আয়নায়, দেখা এবং দেখানোর এই অবিশ্রান্ত প্রদর্শনীতে আমরাও কি নিজেদের, একে-অপরের সামনে, অপ্রয়োজনীয় রকম উন্মুক্ত করে ফেলছি না?

(মতামত নিজস্ব)
লেখক গ্রন্থাগারিক ও সহযোগী অধ্যাপক,
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি
jchaudh5@calstatela.edu

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
Advertisement