বেশ কিছু দিন ধরেই প্রশান্ত কিশোরের রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ে গণমাধ্যমে আকাশকুসুম জল্পনার ফল এখন চোখের সামনে। বিহারের রায়: জন সুরাজ পার্টির আসনসংখ্যা শূন্য। প্রশ্ন: নির্বাচনী রাজনীতির হঠকারিতায় প্রশান্ত কিশোর কি নিজেকে একজন অপ্রস্তুত নেতা হিসাবে প্রমাণ করলেন, না কি তিনি সত্যিই লম্বা রেসের ঘোড়া? লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই।
এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে দঁাড়িয়ে আমরা, যেখানে ইনস্টাগ্রাম রিল্সের দাপট তার্কিক আলোচনার চেয়ে সুদূরপ্রসারী। ঠিক সেই কারণেই বিহারে ভোটগণনার দিন আমার একটি ভিডিও ক্লিপ মুহূর্তে ‘ভাইরাল’ হয়ে গেল, যেখানে আমি মন্তব্য করেছিলাম– প্রশান্ত কিশোর ‘হিরো থেকে জিরো’-য় অবতীর্ণ হলেন। বিজেপি-সমর্থিত দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্রের অনুরাগীরা এক সময়ের পোস্টার বয়ের এমন পতন দেখে যারপরনাই আনন্দিত, যিনি আবার কিনা ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সফল প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই কিশোর-সমর্থকরা আমার এই মন্তবে্য ক্ষুব্ধ, কারণ তাদের মনে হচ্ছে– আমি তাদের নেতাকে ‘ট্রোল’ করেছি। আদতে স্টুডিওয় বসে যেরকম পরিস্থতিতে আমি এমন মন্তব্য করি তা নিছকই একজন সঞ্চালকের উত্তেজনার বশে করা, এর মধে্য কোনও বিদ্বেষপূর্ণ অভিসন্ধি ছিল না।
বেশ কিছু দিন ধরেই বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরামর্শদাতা থেকে রাজনীতিবিদের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করা প্রশান্ত কিশোরের রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ে গণমাধ্যমে আকাশকুসুম জল্পনা-কল্পনা চলছিল– যার ফল এখন চোখের সামনে। বিহার ভোটের রায়ে– জন সুরাজ পার্টির আসনসংখ্যা ০ এবং মাত্র ৩.৪ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তি। এরপর আর-একটি যুক্তিসংগত প্রশ্ন হল: নির্বাচনী রাজনীতির হঠকারিতায় প্রশান্ত কিশোর কি নিজেকে একজন অপ্রস্তুত নেতা হিসাবে প্রমাণ করলেন, না কি তঁাকে এখনই বাতিলের খাতায় ধরে নেওয়া কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি?
ভারতে একটি সফল রাজনৈতিক স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠা করা, চালানো নিঃসন্দেহে অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন। সাম্প্রতিক সময়ে একমাত্র অরবিন্দ কেজরিওয়াল পেরেছিলেন। আম আদমি পার্টি প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন এবং তারপর পাঞ্জাবে বড় জয়লাভের মাধ্যমে প্রায় ‘ইউনিকর্ন’-এর মর্যাদা অর্জন করেন। দিল্লির মতো তুলনামূলকভাবে ছোট শহর-রাজ্যে জয়ের নেপথ্যে ছিল ‘ইন্ডিয়া এগেইস্ট কোরাপশন’ আন্দোলনের অবদান, আর পাঞ্জাবে ভাল ফলাফলের প্রধান কারণ –শিখদের তীব্র হতাশা-প্রকাশ। কিন্তু পরবর্তীতে নিজেকে ও দলকে মেলে ধরা সহজ হয়নি কেজরিওয়াল পক্ষেও।
পূর্ববর্তী যুগে, অন্ধ্রপ্রদেশে এন. টি. রামা রাওয়ের অভিনব উত্থান একজন ক্যারিশম্যাটিক চলচ্চিত্র তারকার ‘রিল’ ও ‘রিয়েল’-এর মধ্যবর্তী সরলরেখাকে সহজেই ঝাপসা করে দিয়েছিল। ১৯৮৫ সালে অসমে অভিবাসী-বিরোধী মনোভাবের কারণে অসম গণপরিষদও তাৎক্ষণিকভাবে সাফল্য অর্জন করেছিল, কিন্তু খুব দ্রুতই তারা জৌলুস হারিয়ে ফেলে।
বিহারের মতো রাজ্যে কাজ করা কিশোরের জন্য দ্বিগুণ কঠিন ছিল, কারণ সেখানে জাতিগত সম্পৃক্ততা দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত। তবুও গত তিন বছর ধরে রাজ্যজুড়ে নানাভাবে দল গঠনের চেষ্টা করে কিশোর যে-আলোচনার পথ বেছে নিয়েছিলেন তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। ভেবে দেখুন, তঁার মতো ভোটকৌশলী চাইলে সহজেই বিভিন্ন দল জুড়ে আরও সফল নির্বাচনী প্রচারণার চিত্তাকর্ষক (এবং অত্যন্ত লাভজনক) ‘ব্যবসায়িক মডেল’ তৈরি করতে পারতেন।
কারণ ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, স্বাভিমান, অথবা ঝুঁকি নেওয়ার খিদে যাই হোক না কেন, কিশোর শেষ পর্যন্ত এমন একটি পথ বেছে নিলেন, যে-পথে কমজনই হঁাটার ঝুঁকি নেয়। প্রশান্ত আত্মবিশ্বাসী, উল্লেখযোগ্যভাবে মিডিয়া-সচেতন, এবং অত্যন্ত পরিশ্রমী– এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু নির্বাচনী সাফল্যের দরজা খোলার চাবিকাঠি তঁার কাছে অধরা থেকে গেল হয়তো এই কারণেই যে, তাঁর দূরদর্শিতার স্বপ্ন তিনি জনগণের চোখে ফেরি করতে অপারগ। ফল: ভোট বাক্স খাঁ খাঁ করছে।আবারও প্রমাণিত– ডিজিটাল মাধ্যমে ভোট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আস্থা নির্মাণ, মনজয়ের প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে অভিজ্ঞতা ও উপযোগিতার উপর। বহুজন সমাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, কাসিরাম, ভারতীয় রাজনীতিতে নিজের জায়গা মজবুত করতে বছরের পর বছর সময় নিয়েছিলেন।
তিনিই একবার বলেছিলেন, ‘প্রথম নির্বাচন লড়তে হয় হারার জন্য, দ্বিতীয়বার মাঠে নামতে হয় অন্যদের পরাস্ত করার জন্য, তৃতীয়বার আসে জেতার লড়াই।’ আদতে, তিনি সুসময় এবং দুঃসময়ে একটি রাজনৈতিক দলকে টিকিয়ে রাখার মূলমন্ত্র তুলে ধরেছিলেন। কিশোর ভেবেছিলেন, প্রথমবারেই তিনি দঁাও মারবেন বিহারের তরুণ ভোটারে ভর করে। ভেবেছিলেন স্মার্টফোনধারী নতুন প্রজন্ম ব্যাপক সাড়া দেবে তঁার সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারে। কিন্তু বাস্তবে কিশোরকে ঘিরে অদম্য উৎসাহ থাকলেও তঁার কোনও স্বতন্ত্র বর্ণপরিচয় বা সূক্ষ্ম ও সুরক্ষিত সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না, যা এই সাময়িক উত্তেজনাকে দীর্ঘস্থায়ী করে তার উপর সিলমোহর দিতে পারে।
কেজরিওয়ালের মতো, কিশোরও চেয়েছিলেন তঁার দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তরুণ স্বেচ্ছাসেবক ও ক্যাডারের উপর নির্ভর করে। নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠাবিরোধী ব্যক্তিত্ব হিসাবে তুলে ধরে– চেয়েছিলেন বিহারে নেতৃত্বে থাকা দ্বৈতশক্তি নীতীশ কুমার ও যাদব পরিবারের প্রতি মানুষের ক্লান্তিকে ট্রাম্প কার্ড করতে। কিশোর বিহারের প্রকৃত সমস্যার সুরাহা করার প্রচেষ্টা ও বার্তা নিয়েই ভোট ময়দানে নেমেছিলেন। তঁার অ্যাজেন্ডায় ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত স্তরে বেকারত্ব, শিল্পের অভাব, ও ভিনদেশে কাজ করতে যাওয়ার বাধ্যতাকে কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস– তঁার মতে, এই তিনটি কারণই মূলত দায়ী বিহারের ক্রমপতনের জন্য। প্রার্থী বাছাইয়ের সময়ও কিশোর তাই বেছে নিয়েছিলেন মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী, ডাক্তার, অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও পুলিশ অফিসারদের।
রাজনৈতিক আখ্যানের দিক থেকে বিচার করলে, মরচে পড়া সিস্টেমের উপর আক্রমণ করে কিশোর মোটেই ভুল করেননি। তবে ভোট সংগ্রহের হাতিয়ার রূপে তঁার দূরদর্শিতা ও পদক্ষেপে খামতি থেকে গেল। ফল– বিহারের দু’টি প্রধান জোট সাকুলে্য প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে বসল, মূলত দৃঢ় বর্ণগত আনুগত্যের উপর ভিত্তি করেই– যে চক্রব্যূহে প্রবেশের পথ কিশোরের জানা নেই। তাই নতুন খেলোয়াড় হিসাবে জাত এবং সম্প্রদায়ের সমীকরণ ভেঙে ফেলে ‘বিহার প্রথম’ স্লোগান দিয়ে ভোটে জেতাও বর্তমানে অসম্ভব। বিহারিদের বর্ণপরিচয় উপ-জাতীয়তাবাদকে ছাপিয়ে যেতে পারে, কিশোর তা খানিক ঠাহর করলেও, বিনা চেষ্টায় মেনে নিতে চাননি। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন ভোরের, ভেবেছিলেন ‘যুব’ ভোটই হবে এবারের ‘গেমচেঞ্জার’। কারণ বিহারের ভোটার সংখ্যার ২২ শতাংশ ১৮-২৯ বছর বয়সি, যা নেহাত কম নয়। কিন্তু কিশোর যাদের বেমালুম ভুলে গেলেন, তারা বিহারের প্রধান ‘মহিলা’ ভোটার– ভারতীয় নির্বাচনের ‘এক্স ফ্যাক্টর’। যুব ভোটারার বিভক্ত হতে পারে, কিন্তু মহিলা ভোটারদের সমর্থন প্রস্তর-কঠিন, বিশেষত নীতীশ কুমারের ক্ষেত্রে এ কথা নিঃসন্দেহে প্রযোজ্য। মৌলিক কল্যাণ ও নগদ অর্থ বিতরণের মডেলের উপর ভিত্তি করে যে-সমর্থন নীতীশ অর্জন করেছেন এত বছর ধরে– তা অপ্রতিরোধ্য। প্রশান্ত কিশোর যখন বিহারে মদ বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, তখন নতুন করে সমাজের নিম্নশ্রেণির মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। মদ বিক্রি চালু হলে আর্থিকভাবে বিহার উপকৃত হবে এ-কথা ঠিক, কিন্তু মদ নিষিদ্ধ হওয়ার গ্রামাঞ্চলে কত মহিলা গৃহহিংসা ও অন্যান্য সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন– তা ভুলে গেল চলবে কেমন করে!
কারণ বিহারে এই মুহূর্তে জনস্বাস্থ্য এবং আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি অর্থনৈতিক সুবিধার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। বিহারের গ্রামাঞ্চল ঘুরে দেখেছি, যুবসমাজের চোখে কিশোরের দেখানো স্বপ্ন ঝলমলাচ্ছে– বিপরীতে মহিলাদের মধে্য কিশোরের উপস্থিতি টিমটিমে। তাই অবশেষে, এম (মহিলা) ফ্যাক্টরটি ওয়াই (যুব) ফ্যাক্টরকে সহজেই ছাপিয়ে গেল।
তাহলে কি কিশোরের পথ এখানেই ইতি? হ্যাঁ এবং না। হ্যাঁ, এ-কথা ঠিক তঁার মিডিয়া-চালিত রাজনৈতিক বিপণনের সীমাবদ্ধতাগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু আগামী দশকে, নীতীশ-লালু পরবর্তী যুগে, বিহারের মানুষ বিকল্প সন্ধানে নামতে বাধ্য। যদি কিশোর পিচ অঁাকড়ে পড়ে থাকেন, নিজেকে ‘ওয়ান ম্যান শো’-র আদল থেকে বেরিয়ে উচ্চজাতের বর্ণান্ধ জনগণ ও পিছড়েবর্গদের একসঙ্গে নিয়ে এগতে পারেন– তঁাকে নিয়ে গল্প হতে বাধ্য। এখন প্রশ্ন হল– তিনি কি বিহারের উৎসাহী, লড়াকু যুবনেতা (ঠিক যেমনটা এখন কংগ্রেসের প্রয়োজন) হয়ে রয়ে যাবেন, না কি প্রথমবার পরাজয়ের শোকে বিধস্ত হয়েই ময়দান ছাড়বেন!
পুনশ্চ: প্রচারের সময় কিশোরকে একটি প্রশ্ন তাড়া করে ফিরছিল: সন্দেহভাজনরা কি ভাবছেন তিনি কি বিজেপির ‘বি টিম’? এই প্রসঙ্গে আমি ওঁকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে, রাজনৈতিক পরামর্শের মতো নগদ অর্থ-সমৃদ্ধ ব্যবসায় থাকা সত্ত্বেও কখনও কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তের মুখোমুখি হলেন না কেন! এমন অসাধ্যসাধন করেলন কী করে? বেশ লড়াকু মেজাজে জবাব আসে– ‘আপনাকেও তো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আপনিও কি ‘বিজেপির বি’ টিম নাকি?” বাহবা!
