'সঞ্চার সাথী' সরকারি অ্যাপটি 'ফোন ফাইন্ডার' হিসাবে কাজ করতে গিয়ে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তার ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে— এমনই মত সিংহভাগের।অ্যাপ-সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কেন্দ্র। যে-প্রতিশ্রুতি তাহলে দেওয়া হচ্ছিল, অধরা রয়ে যাবে সেটি? লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
বিপদ এড়াতে, না কি বিপদ বাড়াতে হাতের মুঠোয় আনা হচ্ছে নতুন কোনও ‘সাথী’-কে? সম্প্রতি দেশজুড়ে ‘সঞ্চার সাথী’ নামক অ্যাপটিকে ঘিরে এই ধন্দ যেন মাথা চাড়া দিয়েছে। ২৮ নভেম্বর সরকারি আদেশের মাধ্যমে জানানো হয়– সকল স্মার্টফোন নির্মাতাদের প্রতিটি নতুন ডিভাইসে ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপটি আগে থেকে ইনস্টল করতে হবে। এই অর্ডারের ৯০ দিন পরে তৈরি বা আমদানি করা সমস্ত ফোনে যেন অ্যাপটি আগে থেকে লোড করা থাকে।
২০২৩ সালে আত্মপ্রকাশ করে সরকার পরিচালিত অ্যাপটি। সরকারের যুক্তি, নকল আইএমইআই নম্বরের মাধ্যমে যে বিপুল টেলিকম জালিয়াতি চলছে, তা রুখতে ‘সঞ্চার সাথী’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অ্যাপটি মূলত ‘সিইআইআর’ বা ‘সেন্ট্রাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার’-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কাজ করে। ‘সিইআইআর’ হল এমন এক ডেটাবেস যেখানে ভারতের সমস্ত বৈধ মোবাইল ফোনের তথ্য জমা থাকে। অ্যাপটি ইনস্টল করার পর এটি ফোনের আইএমইআই নম্বরকে এই ডেটাবেসের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। সেক্ষেত্রে যদি কোনও ব্যবহারকারী মোবাইল ফোন হারিয়ে যাওয়ার রিপোর্ট করে, তবে সিইআইআর সমস্ত নেটওয়ার্কে ওই ফোনের আইএমইআই ব্লক করে দেয়। ফলে চোর বা অন্য কেউ সেই ফোনে নতুন সিম কার্ড ঢোকালেও ফোনটি আর কাজ করবে না।
আর, অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের জানিয়ে দেয় তার আইডি ব্যবহার করে অন্য কেউ অবৈধভাবে সিম কার্ড তুলেছে বা ব্যবহার করছে কি না। সেহেতু দেশে ফোন চুরি, আইএমইআই পরিবর্তন, নকল ফোন এবং সাইবার প্রতারণা মতো ঘটনা উত্তরোত্তর বাড়ছে, তা মোকাবিলা করতেই এই সঞ্চার সাথী অ্যাপ বড় ভূমিকা নেবে বলে দাবি করে কেন্দ্র। অর্থাৎ, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার চেয়েছে এই অ্যাপটিকে একটি ‘সুরক্ষাকবচ’ হিসাবে তুলে ধরতে। তবে টেলিকম দফতরের এহেন আদেশের ফলে গোপনীয়তা, ডেটা অ্যাক্সেস এবং ব্যবহারকারীদের অ্যাপটির ব্যাপারে কোনও বাস্তবসম্মত পছন্দের সুযোগ থাকবে কি না তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়।
অর্থাৎ, বেশ কয়েকটি কারণে এই ‘সঞ্চার সাথী’ ঘিরে ভয়ের সঞ্চার অমূলক নয়। ফলস্বরূপ সরকারের এমন নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেল বিরোধী দলের নেতাদের পাশাপাশি নাগরিক স্বাধীনতার দাবিদার গোষ্ঠী। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের অভিযোগ, জনগণের কণ্ঠস্বর দমন করতে এটি বিজেপির আর-একটি প্রচেষ্টা। পাশাপাশি, তঁার মতে, নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনা না-করে মোদির এই অ্যাপটি ইনস্টল করার একতরফা নির্দেশ দেওয়া একনায়কতন্ত্র আচরণের রূপ। একই সঙ্গে তঁার প্রশ্ন, সরকার কেন জানতে চাইবে নাগরিক তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে কী কথা বলছে। ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপে যেন ‘পেগাসাস’-এর ছায়া দেখতে পেয়েছেন বিরোধীরা, আর তাদের সেই আতঙ্ক দেশজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মোদি-জমানায় এর আগেও ফোনে আড়িপাতা নিয়ে অভিযোগের ঝড় উঠেছিল। সেই সময় অভিযোগ ছিল, পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে রাহুল গান্ধী থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিরোধী নেতা কিংবা ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর-সহ, বিচারক, সাংবাদিক, এমনকী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদেরও ফোনে নজরদারি চালানো হয়েছিল। তারই ফলস্বরূপ কংগ্রেস সাংসদ কার্তি চিদম্বরম, সিপিএম সাংসদ জন ব্রিট্টাস, আপ নেতা মনীশ সিসোদিয়া প্রত্যেকেই একই সুরে কথা বলেছেন।
শুধু তা-ই নয়, ‘ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন’ একইরকম আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তবে বিরোধীদের এই আশঙ্কা কি পুরোপুরি রাজনৈতিক কারণে না কি অন্য কিছু? প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘পেগাসাস’ ও ‘সঞ্চার সাথী’-কে এক সারিতে রাখা ঠিক নয়। পেগাসাস হল, নজরদারির উদ্দেশ্যে তৈরি বিশেষ স্পাইওয়্যার, যা ‘টার্গেটেড’ ফোনের প্রায় সব তথ্যরেকর্ড করতে পারে। আর ‘সঞ্চার সাথী’ হল, মূলত ফোন-ট্র্যাকিং ও নকল ডিভাইস শনাক্ত করার অ্যাপ। যদিও উদ্বেগ পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, যেহেতু অ্যাপটি ফোনে ইনস্টল করলে এটি ক্যামেরা অ্যাক্সেস, কল ও মেসেজ মনিটরিং, নেটওয়ার্ক স্টেটাস, লোকেশন অ্যাক্সেস– অত্যন্ত সংবেদনশীল দিকগুলিতে ঢোকার অনুমতি চাইবে।
‘ফোন ফাইন্ডার’ হিসাবে কাজ করতে এসব প্রয়োজন হলেও সেক্ষেত্রে তা ব্যবহারকারীর গোপনীয়তার জন্যও রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। যুক্তির পাল্টা যুক্তি হয়তো আছে।
তাই বিশেষজ্ঞদের একাংশ এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। যেমন ‘বিএসএনএল’-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান অনুপম শ্রীবাস্তব হ্যান্ডসেট জালিয়াতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং জাতীয় টেলিকম নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য এটিকে একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। স্বদেশি স্মার্টফোন নির্মাতা ‘লাভা ইন্টারন্যাশনাল’ প্রকাশ্যে এই আদেশকে সমর্থন করেছে। যদিও ‘অ্যাপল’, ‘স্যামসাং-এর মতো সংস্থা সরকারি আদেশ মানার ক্ষেত্রে বেঁকে বসে। তারাও বিষয়টির পর্যালোচনা চায়।
তবে নানা দিক থেকে আসা চাপের মুখে ক্রমশ ব্যাকফুটে যেতে দেখা যায় মোদি সরকারকে। লোকসভায় কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ঘোষণা করেছিলেন, ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ নিয়ে যে-প্রতিক্রিয়া মিলছে, তার ভিত্তিতে সরকার নির্দেশিকায় বদল করতে পারে। সিন্ধিয়া জানিয়েছিলেন, যদি কেউ অ্যাপটি মুছে ফেলতে চাইলে, মুছে ফেলুন। কেউ ব্যবহার করতে না চাইলে করবেন না। ‘নিবন্ধন’ না করা হলে এটি ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকবে। তবে ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ মুছে ফেলার বিষয়ের প্রযুক্তি নিয়েও বিশেষজ্ঞরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন– কারণ বহু অ্যাপ হোমস্ক্রিন থেকে সরানো হলেও, ব্যাকগ্রাউন্ডে থেকে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জটিলতা বাড়ায় অবশেষে ওই অ্যাপ-সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্র। অস্বীকার করার উপায় নেই– নাগরিকের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা রক্ষা ইত্যাদি সমাজের এলিট শ্রেণির মাথাব্যথা। রাজনৈতিক উদ্দেশে্য আড়িপাতা উচ্চপদস্থ ও ক্ষমতার সন্নিকটস্থ ব্যক্তিবর্গে বিবেচ্য। কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরয় এমন মানুষের কাছে বাক্স্বাধীনতা, গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার অনেকাংশেই বাতুলতা। এলিট শ্রেণির বাইরে যে বৃহত্তর জনসমাজ রয়েছে, তাদের কাছে এসব নিয়ে ভাবার অবসর কোথায়! অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে বলে মনে হয় না।
বরং ‘জামতাড়া গ্যাং’ বা নানাবিধ সাইবার প্রযুক্তি যুক্ত প্রতারণার শিকার হওয়া স্মার্টফোন ব্যবহারকারী আমজনতা রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তার আশ্বাস পেলেই বর্তে যায়। তাই ‘সঞ্চার সাথী’ নিয়ে উচ্চকোটির আশঙ্কা বা দুশ্চিন্তা ওই বৃহত্তর সমাজের কাছে অবান্তর। তাছাড়া সম্প্রতি মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে ‘সঞ্চার সাথী’ ইনস্টল করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে। যেখানে দিনে ৬০ হাজার ইনস্টল হত, সেটাই দশগুণ বেড়ে গিয়ে ছয় লক্ষ হয়েছিল। কিন্তু সরকার পিছু হঠায় অ্যাপটি সম্পর্কে সন্দেহ জাগছে যে প্রতিশ্রুতি সাধারণ জনগণকে দেওয়া হচ্ছিল ‘সঞ্চার সাথী’ তা আদৌ দিতে সক্ষম কি না? সাইবার অপরাধ এতে আদৌ আটকানো যাবে তো, না কি অপরাধীরা অপরাধ চালিয়ে যাবে?
আগামী দিনে ‘সঞ্চার সাথী’-ও নোটবন্দির মতোই একগুচ্ছ ফঁাকা প্রতিশ্রুতি হয়ে উঠবে না তো? না কি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-থাকায় আত্মবিশ্বাসের অভাবে পিছু হঠে মোদি সরকার তাদের দুর্বলতার প্রমাণ দিল?
(মতামত নিজস্ব) লেখক সাংবাদিক
