‘মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক’ বা ‘ধাতব জৈব কাঠামো’ আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন ধরনের আণবিক স্থাপত্যের বিকাশের জন্য এ বছরের রসায়নে নোবেল পেয়েছেন
তিন বিজ্ঞানী। সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর এম. ইয়াগি। নোবেল কমিটির ভাষায়, তঁাদের কাজ রসায়নের ব্যাকরণ ‘নতুন করে লেখার’ সমতুল্য। লিখছেন অর্ণব হালদার।
গত দু’-বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসের মধ্যে। এ যুদ্ধ নতুন নয়, রয়েছে এর এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৪৯ সালে প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের শেষে লাখ-লাখ প্যালেস্তাইনি নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল, বা তাদের উৎখাত করা হয়েছিল। এই সময়ে একটি প্যালেস্তানি পরিবার গাজা জেলার মাসমিয়া গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে বড় কষ্টে রামাল্লা হয়ে জর্ডনের আম্মানে রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। তারও ১৭ বছর পরে ১৯৬৫ সালে সেই পরিবারে একটি ছেলের জন্ম হয়।
ঘর মাত্র একটি। অনেকের সঙ্গে শিশুটাও থাকে সেই ঘরে– আর সঙ্গী হল পরিবারের গৃহপালিত পশুরা! বিদ্যুৎ নেই, পরিষ্কার খাওয়ার জলও সামান্য। একটু বড় হতে স্কুলই হয়ে উঠল এই জীবন থেকে বঁাচার একমাত্র আশ্রয়স্থল। মাত্র ১০ বছর বয়সে সে একদিন লুকিয়ে ঢুকে পড়ে লাইব্রেরিতে, এলোমেলোভাবে তাক থেকে তুলে নেয় একটা বই। বইটা আসলে অণু নিয়ে লেখা। ছবিগুলো মনকে নাড়া দেয়– আণবিক কাঠামোর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়, সেখান থেকেই শুরু তার আজীবনের রসায়নপ্রেম।
তারপর মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবার উৎসাহে ছেলেটা আমেরিকায় যায়, সম্ভবত ইউনিসেফের শিশুশিক্ষা প্রকল্পের কারও হাত ধরে। তখন ইংরেজিও তেমন জানত না। শুরু হয় জীবনের এক নতুন অধ্যায়। এরপর বহু পথ পাড়ি দিয়ে ২০১২ সালে বিখ্যাত বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক। যেন এক রূপকথার গল্প। যদিও গল্পের শেষ এখানেই নয়। ২০২৫ সালে রসায়নে তিন নোবেল পুরস্কারপ্রাপকের একজন সেদিনের সেই ছেলেটা– ওমর মোয়ান্নিস ইয়াগি। তঁার নিজের কথায়– ‘একজন শরণার্থী পরিবারের সন্তান হিসাবে আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষেরই সাফল্যের সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকে। আমি সেই ক্ষীণ সম্ভাবনারই ফল, আর সেই কষ্টকর জীবনের প্রতিফলন, যেখানে শুরুটা ছিল একেবারে শূন্য থেকে– শুধু ছিল নতুন করে জীবন গড়ার দৃঢ় সংকল্প।’ আর, নোবেল কমিটির সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এ এক অসাধারণ যাত্রা, আর বিজ্ঞানই আমাকে সেই পথ দেখিয়েছে... কারণ, বিজ্ঞান বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট সমতারক্ষাকারী শক্তি।’
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের এই শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকৃতি দিতেই ১৯ শতকের একেবারে শেষদিকে একটা ‘উইল’ করে যান আলফ্রেড নোবেল। উইলে একটি ফাউন্ডেশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। নোবেল ফাউন্ডেশন। তার কাজ হবে প্রতি বছর পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্য আর শান্তির জন্য সেই বিষয়ের সেরা মানুষটাকে পুরস্কৃত করা। ১৯০০ সালের ২৯ জুন সুইডেনের রাজা দ্বিতীয় অস্কার ও তঁার মন্ত্রিসভা নোবেল ফাউন্ডেশনকে মান্যতা দিল। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হল। আলফ্রেড নোবেলের নিজের কাজের মূল ভিত্তি ছিল রসায়ন। প্রতি বছর নোবেলের মৃত্যু তারিখ ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম থেকে রসায়নে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৯৫ জন বিজ্ঞানী রসায়নে নোবেল পেয়েছেন।
‘মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক’ বা ‘ধাতব জৈব কাঠামো’ আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন ধরনের আণবিক স্থাপত্যের বিকাশের জন্য এ বছরের রসায়নে নোবেল পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী। গত বুধবার, ৯ অক্টোবর ‘রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’ এই পুরস্কারের জন্য জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুসুমু কিতাগাওয়া, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্নের অধ্যাপক রিচার্ড রবসন, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের ওমর এম. ইয়াগির নাম ঘোষণা করে। তঁারা এমন এক ধরনের আণবিক কাঠামো তৈরি করেছেন, যার ভিতরে রয়েছে বিশাল ফঁাকা স্থান, যেখান দিয়ে গ্যাস ও অন্যান্য রাসায়নিক প্রবাহিত হতে পারে। নোবেল কমিটির ভাষায়, তঁাদের কাজ রসায়নের ব্যাকরণ ‘নতুন করে লেখার’ সমতুল্য। বলা হচ্ছে তঁারা রসায়নের জন্য নতুন কক্ষ তৈরি করেছেন!
এই তিন নোবেলজয়ীর যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর রসায়নবিদরা হাজার হাজার ভিন্ন ধরনের মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছেন।
এগুলো মানব জাতির বড় কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নোবেল পুরস্কারের সাংবাদিক সম্মেলন থেকে যোগাযোগ করা হলে সুসুমু কিতাগাওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমার স্বপ্ন, বাতাসকে ধরে তা থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, অক্সিজেন বা জলের মতো উপাদান আলাদা করা এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করে সেগুলোকে কাজে লাগানো যায়– এমন উপাদানে রূপান্তর করা।’ এছাড়াও নোবেল কমিটি মনে করছে ধাতব জৈব কাঠামোর অতিরিক্ত কিছু ব্যবহার রয়েছে, যেমন– জল থেকে ক্ষতিকর ‘পিএফএএস’ বা ‘চিরস্থায়ী রাসায়নিক’ পদার্থ আলাদা করা, মরুভূমির বাতাস থেকে জল সংগ্রহ করা, অ্যান্টিবায়োটিককে ভেঙে ফেলতে পারে এমন এনজাইমকে আবদ্ধ করা এবং পরিবেশে থাকা ওষুধজাত পদার্থের অবশিষ্টাংশ ভেঙে ফেলা।
নোবেল কমিটির সদস্য ওল্ফ মস্ট্রম নতুন আণবিক স্থাপত্যের রূপকে তুলনা করেছেন হ্যারি পটার সিরিজের হেরমায়োনির সেই ছোট্ট হ্যান্ডব্যাগের সঙ্গে– যা বাইরে থেকে তুচ্ছ, ভিতরে এক মহাবিশ্ব। অগণিত বই, তাঁবু, ওষুধ, পোশাক– সব ঢুকে যায় তার ভিতরে, যেন জাদু দিয়ে ভঁাজ করে রাখা এক পৃথিবী। ধাতব জৈব কাঠামো যেন ঠিক সেই ব্যাগটার মতো– বাইরে এক ছোট ধারণা, কিন্তু ভিতরে বিশাল সম্ভাবনা। নতুন ওষুধ, টেকসই শক্তি, পরিবেশবান্ধব উপকরণ– সব যেন লুকিয়ে সেই জাদু ব্যাগে। হেরমায়োনি যেমন জানত, কোন মুহূর্তে কোন জিনিস দরকার, বিজ্ঞানীরাও জানেন, কোন অণু কোথায় রাখলে কী ফল হবে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে ধাতব জৈব কাঠামো আসলে কী? উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ৫০ বছর। ১৯৭৪ সাল। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন পড়ান রিচার্ড রবসন। রবসন ব্রিটেনে জন্মগ্রহণ করলেও পরে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। ছাত্রদের আণবিক কাঠামো শেখানোর জন্য কাঠের রড আর বল তৈরি করানোর দায়িত্ব পান। এই সময় তঁার মনে হয়েছিল– যদি পরমাণুর পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের অণুকে একত্র করার জন্য পরমাণুর ধর্ম ব্যবহার করেন তবে কী হবে? তিনি কি নতুন ধরনের আণবিক গঠন তৈরি করতে পারবেন? এক দশকেরও বেশি সময় পরে তিনি পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি হীরের গঠনের অনুকরণে একটা খুব সহজ মডেল দিয়ে শুরু করেছিলেন। তবে, হীরের বিপরীতে রবসনের মডেলে বিশাল সংখ্যক গহ্বর ছিল।
১৯৮৯ সালে, রবসন ‘জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি’-তে তঁার গবেষণার ফল প্রকাশ করেন। গবেষণাপত্রে তিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমান করেন এবং পরামর্শ দেন এভাবে নতুন আণবিক কাঠামো সম্পন্ন পদার্থ তৈরি করা যেতে পারে। তিনি আসলে ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।
কিন্তু রবসনের নির্মাণগুলোর ভেঙে পড়ার প্রবণতা ছিল। অনেক রসায়নবিদ ভেবেছিলেন যে, সেগুলি অকেজো, কিন্তু কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তঁার ধারণাগুলো এক নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছে। এই নতুন পথে এগিয়ে এসেছিলেন সুসুমু কিতাগাওয়া এবং ওমর ইয়াগি। ১৯৯২ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে তঁারা আলাদাভাবে একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছিলেন। কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সুসুমু কিতাগাওয়া সমগ্র কর্মজীবন জুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি অনুসরণ করেছেন: ‘অকেজোর উপযোগিতা দেখার চেষ্টা করা।’ একজন তরুণ ছাত্র হিসাবে, তিনি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিদেকি ইউকাওয়ার একটি বই পড়েছিলেন। এতে, ইউকাওয়া একজন প্রাচীন চিনা দার্শনিক ঝুয়াংজির কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি বলেছেন যে, আমাদের অবশ্যই প্রশ্ন করা উচিত যে, আমরা কী দরকারি বলে বিশ্বাস করি। এমনকী, যদি কোনও কিছু তাৎক্ষণিকভাবে উপকার নাও আনে, তবুও এটি মূল্যবান হতে পারে। এ যেন সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তির অনুরণন– ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।’
প্রায় ছ’-সাত বছর ধরে এক নাগাড়ে লেগে থাকার পর কিতাগাওয়া সাফল্য পেলেন। ১৯৯৭ সালে তঁার গবেষণা দল ত্রিমাত্রিক স্থিতিশীল ধাতব জৈব কাঠামো তৈরি করে। ১৯৯৮ সালে, জাপানের কেমিক্যাল সোসাইটির বুলেটিনে তিনি ধাতব জৈব কাঠামোর প্রচুর সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন।
এরপর ওমর ইয়াগি। ১৯৯২ সালে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা দলের নেতা হিসাবে ইয়াগি ধাতব জৈব কাঠামো তৈরির আরও নিয়ন্ত্রিত উপায় খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন। তিন বছর পর ইয়াগি দু’টি ভিন্ন দ্বিমাত্রিক পদার্থের গঠন প্রকাশ করেন। ‘নেচার’ জার্নালে ইয়াগি এই উপাদানটির বর্ণনা দিতে দিয়ে ‘ধাতব জৈব কাঠামো’ শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন। ১৯৯৯ সালে ইয়াগি ধাতব-জৈব কাঠামোর উন্নয়নে পরবর্তী মাইলফলক তৈরি করেন। তঁার তৈরি আণবিক গঠন ছিল অত্যন্ত স্থিতিশীল। ৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলেও এটা ভেঙে পড়ে না! এর ভিতরে লুকিয়ে থাকে বিশাল স্পেস– কয়েক গ্রাম পদার্থের মধ্যে রয়েছে একটা ফুটবল মাঠের সমান এলাকা!
২০০২ এবং ২০০৩ সালে ওমর ইয়াগি ‘সায়েন্স’ ও ‘নেচার’-এ দু’টি প্রবন্ধে দেখান, যুক্তিসংগতভাবে উপাদান পরিবর্তনের মাধ্যমে এসব ধাতব-জৈব কাঠামোর ধর্ম বদলানো সম্ভব এবং ফলে তাদের নানাভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে, ধাতব-জৈব কাঠামোর এত বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে যে, তারা একবিংশ শতাব্দীর উপাদান হয়ে উঠবে। সময়ই বলবে, কিন্তু ধাতব-জৈব কাঠামোর বিকাশের মাধ্যমে, সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর ইয়াগি মানবজাতির বহু চ্যালেঞ্জ সমাধানের জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছেন।
‘রয়্যাল সোসাইটি অফ কেমিস্ট্রি’-র সভাপতি অ্যানেট ডোহার্টের কথায়– ‘রসায়নের কাজ বিশ্বকে আরও ভালর জন্য পরিবর্তন করা।.... ধাতব জৈব কাঠামোর মধ্যে সেই অসাধারণ সম্ভাবনা রয়েছে... প্রতি বছর এমন রসায়নবিদদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় যঁারা আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে বের করার চ্যালেঞ্জকে স্বাগত জানান– উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ সুরক্ষা, পরিবেশবান্ধব শক্তি এবং সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য ও জল... এই বছরের বিজয়ীরা সেই প্রচেষ্টার একটি দুর্দান্ত উদাহরণ।’ এটাই বোধহয় আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছাপত্রের যথাযথ প্রতিফলন।
(মতামত নিজস্ব)
