প্রথম মহাকাশযাত্রী হনুমান! অনুরাগ ঠাকুরের এমন মন্তব্য পুরাণ ও বিজ্ঞানের চর্চাকে বিকৃত করে। সেই সঙ্গে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বিষয় হয়ে ওঠে সমগ্র দেশ।
দেশের কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপির নেতাদের মধ্যে বারবার এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, তাঁরা আধুনিক বিজ্ঞান, গবেষণা কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারকে ছুঁয়ে দেখার বদলে তা জোর করে পুরাণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। জাতীয় বিজ্ঞানচর্চার মঞ্চে কিংবা স্কুলের শ্রেণিকক্ষে যখন ইতিহাস ও বিজ্ঞানচচর্চাকে পুষ্ট করার বদলে পৌরাণিক কল্পকাহিনি শিশু-মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন তা নিছক হাস্যকরই নয়, গভীরভাবে ক্ষতিকরও বটে।
হিমাচল প্রদেশে জাতীয় মহাকাশ দিবসের অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের মন্তব্য এই অস্বাস্থ্যকর প্রবণতারই নতুন উদাহরণ। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যখন প্রথম মহাকাশযাত্রী হিসাবে নীল আর্মস্ট্রংয়ের নাম বলে, তখন তিনি তাদের বলেন, প্রথম মহাকাশযাত্রী নাকি ছিলেন হনুমান! এমন মন্তব্য হয়তো রাজনৈতিক সভায় জনতাকে তুষ্ট করতে কাজে আসে, কিন্তু তা যদি শ্রেণিকক্ষে ঘটে, তবে তা ভয়াবহ। ছাত্রছাত্রীদের সামনে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে পুরাণকল্পকে ‘বিজ্ঞান’ রূপে দঁাড় করানো মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কৌতূহল, অনুসন্ধানী মন আর যুক্তিবোধকে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা।
যে-সংবিধান আমাদের বৈজ্ঞানিক মানসিকতা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছে, তার প্রতি এটি চরম অবমাননা। বিজ্ঞান– পুরাণ নয়। বলছেন বিরোধীরা। তবে এটি শুধু বিরোধী দলের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং গণতান্ত্রিক যুক্তিবাদী ভারতের পক্ষ থেকেও সতর্কবার্তা। এখন যখন ভারত মহাকাশ গবেষণায় বিশ্বে শীর্ষে পৌঁছনোর চেষ্টা করছে, যখন ‘চন্দ্রযান’ ও ‘আদিত্য-এল ওয়ান’ আমাদের গর্বের প্রতীক হয়ে উঠছে, তখন শাসক দলের একজন নেতা যদি ছাত্রদের বলেন– হনুমানই প্রথম মহাকাশ অভিযাত্রী, তাহলে সে-মন্তব্য দেশকে প্রগাঢ়
ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মুখে ঠেলে দেয়।
বিজেপি দীর্ঘ দিন ধরে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বকেও এভাবেই বিকৃত করতে চেয়েছে। কখনও দাবি করা হয়েছে বিমান আবিষ্কারের কৃতিত্ব ভারতীয় ঋষিদের, কখনও প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে গণেশের মাথায়। এই প্রবণতা একদিকে যেমন ভারতের বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে খাটো করে, তেমনই আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে। যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে কুসংস্কারকে শিক্ষা ব্যবস্থায় ঢুকিয়ে দিলে তরুণ প্রজন্ম পিছিয়ে পড়বে, এগবে না। বিজেপি বারবার রাজনৈতিক স্বার্থে পুরাণকে বিজ্ঞানের জায়গায় বসিয়ে দিয়ে অগ্রগতির পথকেই বন্ধ করতে চাইছে।
এটি শুধু এক রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি ভারতের ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর বিপদ। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে, কিন্তু ইতিহাসকে ‘বিকৃত’ করা বা পুরাণকে বিজ্ঞান হিসাবে দঁাড় করানো মানে কল্পনার উপর ভর করে বাস্তবকে অস্বীকার করা। বিজেপিকে বুঝতে হবে, ভারতীয় সংস্কৃতির গৌরব কেবল পুরাণে নয়, বরং সেই সমৃদ্ধ বৌদ্ধিক ঐতিহ্যে, যা চিন্তার বহুমুখিতা উন্মোচিত করেছিল।
