পরিবেশের বড় বড় সংকটের মূলে নাকি মানুষের খাদ্যাভ্যাস! তাহলে মানুষ কি না খেয়ে বাঁচবে? পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার সমাধানই-বা কী?
মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ গভীর সংকটে। আর, সেই সংকটের কেন্দ্রেই রয়েছে আমাদের খাদ্যব্যবস্থা। সদ্যপ্রকাশিত ‘দ্য ইট-ল্যানসেট কমিশন অন হেলদি, সাসটেনেব্ল অ্যান্ড জাস্ট ফুড সিস্টেমস’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, মানব জাতির খাদ্য উৎপাদন ও ভোগের ধরনই পৃথিবীর ছ’টি পরিবেশগত সীমার মধ্যে পাঁচটি লঙ্ঘনের জন্য দায়ী। একই সঙ্গে, বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ক্ষেত্রে, এটিই প্রধান ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ খাদ্যই জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র ধ্বংস, জলের অভাব ও দূষণ-সহ নানাবিধ সংকটের একক প্রধান চালক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাণিজ খাদ্য থেকে আসে কৃষিক্ষেত্রের সবচেয়ে বেশি নির্গমন, আবার শস্যজাত খাদ্য উৎপাদন দখল করে রেখেছে জল, নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের বিপুল অংশ। পৃথিবীর জৈব রাসায়নিক চক্র এখন বিপর্যস্ত। বিশ্ব-কৃষিতে নাইট্রোজেনের ব্যবহার নিরাপদ সীমার দ্বিগুণেরও বেশি। উৎপাদন বৃদ্ধির নামে যে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা যদি সঠিক নীতিনির্ধারণের সঙ্গে না মেলে, তবে সেই দক্ষতাই আবার অতিরিক্ত উৎপাদনের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতিকে আরও ত্বরান্বিত করে।
কমিশনের একটি বাস্তবমুখী স্বীকারোক্তি গুরুত্বপূর্ণ। সব ধরনের পদক্ষেপ– যেমন: খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, নির্গমন হ্রাস, খাদ্য অপচয় রোধ মিলিয়েও পৃথিবীর খাদ্যব্যবস্থাকে নিরাপদ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এই শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সময় লাগবে। পুষ্টি ও জলের নিরাপত্তা তখনও চাপের মুখে থাকবে। তবুও প্রতিবেদনের একটি ধারণা বিতর্কিত– আগামী ৩০ বছরে বিশ্বজুড়ে জিডিপি ১২৭ শতাংশ বাড়বে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যদি পরিবেশের ক্ষতির বিনিময়ে হয়, তবে সেই বৃদ্ধি প্রকৃত অগ্রগতির লক্ষণ নয়, বরং আত্মঘাতী। ভারতের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটি আরও জটিল। আমাদের খাদ্যাভ্যাস প্রধানত চাল-গম নির্ভর। একঘেয়ে ও কার্বোহাইড্রেট-নির্ভর এই খাদ্য তালিকাকে বৈচিত্রময় করতে হলে ২০৫০ সালের মধ্যে বেশি পরিমাণে ফল, সবজি, ডাল ও বাদাম উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু এই পরিবর্তন বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করবে, বিশেষত যেসব এলাকায় এসব খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। ফলে কীভাবে স্বাস্থ্যকর খাদ্য সুলভ রেখে জনগণকে সেইরূপ খাদ্যাভ্যাসে আনা সম্ভব?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ন্যায্যতা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। প্রতিবেদন দেখিয়েছে, খাদ্যবাজারে কর্পোরেট সংস্থার একচেটিয়া প্রভাব, শ্রমিক ও ক্ষুদ্র উৎপাদকদের দরকষাকষির ক্ষমতার অভাব, এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, সবই স্থায়ী পরিবর্তনের পথে অন্তরায়। প্রকৃত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে শ্রমিক, কৃষক ও ভোক্তার সম্মিলিত প্রতিনিধিত্বকে প্রতিষ্ঠানগত রূপ দিতে হবে। খাদ্য কেবল পুষ্টি বা ভোগের বিষয় নয়, এটি এখন পৃথিবীর অস্তিত্বের প্রশ্ন। পৃথিবীকে ‘বাসযোগ্য’ রাখতে চাইলে খাদ্যব্যবস্থাকে ন্যায়নিষ্ঠ ও পরিবেশবান্ধব পথে রূপান্তর করাই এখন মানব জাতির প্রধান দায়িত্ব। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এখন না পাল্টালে, ভবিষ্যতে আমাদের জন্য থাকবে শুধু খাদ্যনির্ভর এক ‘মৃত’ পৃথিবী।
