অনুরাগ রায়: অব কি বার, ২০০ পার। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বঙ্গে সুর তুলেছিল বিজেপি। একুশের সেই স্বপ্ন পঁচিশে গিয়ে পূরণ হল। তবে বাংলায় নয়, বিহারে। নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে এনডিএ বিহারে ২০০ পার করল। বিহারের সেই জয়ে নাকি বাংলায় বিজেপিকে বিরাট ডিভিডেন্ট দেবে। এবার বাংলা দখল সময়ের অপেক্ষা, সেই স্বপ্নে মশগুল বঙ্গ বিজেপি। বাংলার গেরুয়া নেতারা মনে করছেন, বিহারে যেমন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এনডিএ ক্ষমতায় এল, তেমনই বাংলায় আপনাআপনি ক্ষমতা দখল করে নেবে বিজেপি। ঠিক এই ভুলটাই ২০২১-এ করেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী-দিলীপ ঘোষরা। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন, অন্য রাজ্যের মতো বঙ্গেও বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতাদের হাত ধরে আপনাআপনি জিতে যাবে।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না বিহার আর বাংলা কোনওভাবেই এক নয়। সে রাজ্যের ভোটারদের মন-মানসিকতা বাংলার ভোটারদের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। কয়েকটি কমন ফ্যাক্টর ছাড়া দুই রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণেও বিশেষ মিল নেই। ফলে বিহারের মতো বঙ্গেও বিজেপি ভালো করবে ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ সম্ভবত নেই। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে বিহারের এই জয় চাঙ্গা করবে বঙ্গ বিজেপির নেতাকর্মীদের। বাংলায় ন্যারেটিভ তৈরির ক্ষেত্রেও কিছুটা কাজে লাগবে বিহারের ফল। ব্যস ওইটুকুই, তার চেয়ে বেশি নয়। বরং বিহারের ফলাফলের দু'একটি ট্রেন্ড খানিক চিন্তারই কারণ বঙ্গ বিজেপির জন্য।
এক, বিহারে নীতীশ কুমারের জয়ের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর মহিলা ভোট। সেই ২০০০ সালে ক্ষমতায় এসেই মহিলা ভোটারদের মন পেতে মন দেন নীতীশ। প্রথম কাজ রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা। যে বিহারে একটা সময় মেয়েদের সন্ধের পর বাড়ির বাইরে বেরনো আতঙ্কের কারণ ছিল, সেখানেই তিনি ধীরে ধীরে দুষ্কৃতীরাজ দমন করার চেষ্টা করলেন। অনেকাংশে সফলও হলেন। সেই সঙ্গে শুরু হল মহিলা শিক্ষায় জোর, মেয়েদের প্রগতির জন্য সাইকেল দেওয়া। টুকটাক সরকারি প্রকল্পে মহিলাদের সাহায্য করা। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলিকে উৎসাহিত করা, ‘জীবিকা দিদি’ তৈরি করা। ভোটের আগে নীতীশের মাস্টারস্ট্রোক মহিলাদের অ্যাকাউন্টে সোজা ১০ হাজার টাকা করে পাঠানো। যে মহিলা ভোটব্যাঙ্ককে তিনি দীর্ঘদিন ধরে লালন-পালন করে এসেছিলেন, সেটাকে আরও চাঙ্গা করে দেওয়া। একবার ভেবে দেখলেই দেখা যাবে, ঠিক এই কাজগুলিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় করেছেন। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজ সাথী এবং সর্বোপরি লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পে বাংলার মহিলা ভোটারদের একাত্ম করে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি যতই দুর্নীতি, অনুপ্রবেশ, তোষণের মতো ইস্যু তুলে মমতাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করুক না কেন, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি মহিলা ভোটারদের সমর্থন ভাঙতে না পারলে লাভের লাভ হবে না। কারণ বৃহত্তর রাজনৈতিক ইস্যুর চেয়ে নিজের এবং পরিবারের আর্থিক-সামাজিক নিরাপত্তাই মহিলাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই মমতার নানা প্রকল্প আজও সমানভাবে প্রভাবশালী।
দুই, সামাজিক প্রকল্প। শেষবেলায় নীতীশ কুমার একের পর এক সামাজিক প্রকল্প ঘোষণা করে গিয়েছেন। সেটা যুবসমাজের জন্য ভাতা হোক, মহিলাদের আলাদা ভাতা, বেকারদের প্রশিক্ষণ শিবির কিংবা বিনামূল্যে বিদ্যুৎ হোক। যার প্রভাব ভোটের ফলে স্পষ্ট। বিজেপি যাকে খয়রাতির রাজনীতি বলে কটাক্ষ করে, বিহারে কিন্তু সেই খয়রাতির রাজনীতিরই জয় হয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না বাংলাতেও এমন পঞ্চাশের বেশি সামাজিক প্রকল্প মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার চালাচ্ছে, যার সুবিধা সরাসরি সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন।
তিন, বিজেপি নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন, SIR-এর সুবাদে বিহারে বড় সাফল্য পাওয়ার পথে তাঁরা। কিন্তু বাস্তব হল বাংলায় SIR বিজেপির জন্য হীতে বিপরীত কাণ্ড ঘটাতে পারে। প্রথমত SIR ভীতি রাজ্যের সংখ্যালঘুদের ফের একজোট করে দিতে পারে, যেমনটা সিএএ-এনআরসি ২০২১-এ করেছিল। দ্বিতীয়ত বঙ্গে বিজেপির যে মূল দুই ভোটব্যাঙ্ক সেই মতুয়া এবং রাজবংশী, তাঁরাও কিন্তু SIR-এ ত্রস্ত। আবার উদ্বাস্তু বাঙালি ভোটাররাও রীতিমতো হয়রানির শিকার। ফলে আশঙ্কা থাকছে, বিজেপি যে পরিমাণ মুসলিম ভোট বাদ পড়বে বলে প্রত্যাশা করছে, তার চেয়ে বেশি হিন্দু বাঙালি ভোট হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা হয়েছে।
চার, সংখ্যালঘু ভোট। বিহারের কিছু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত আসনে এনডিএ জোট জিতলেও বাংলায় সে সম্ভাবনা কম। কারণ বিহারের সংখ্যালঘুরা কংগ্রেস-আরজেডির উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তাঁদের একটা বড় অংশ ভোট দিয়েছে আসাদউদ্দিন ওয়েইসির পক্ষে। কিন্তু বঙ্গের সংখ্যালঘুদের ভরসা এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি অটুট। বিহারের এই ফলাফল হয়তো বাংলার সংখ্যালঘুদের আরও একজোট করবে। কারণ কংগ্রেস এবং সিপিএমের যে তৃতীয় শক্তি, তারা যে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারবে না, সেটা বিহারেও দেখা গেল। এই সংখ্যালঘু ভোট কিন্তু বাংলায় প্রায় ৭০ বিধানসভা কেন্দ্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে।
পাঁচ, বিহারে এনডিএ এবং ইন্ডিয়া জোটের বাইরেও একটা বিরাট ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। প্রায় ১৫ শতাংশ ভোটার এমন রয়েছেন যাঁরা এনডিএ বা ইন্ডিয়া কোনও শিবিরেই ভোট দেননি। এর মধ্যে মিম রয়েছে, জন সুরাজ রয়েছে, বিএসপি রয়েছে। কিন্তু বাংলার ভোটে এই ছোটোখাটো দলের তেমন প্রভাব নেই। আর সরাসরি দুই বা তিন শিবিরের লড়াই হলে তাতে মমতাকে হারানো বিজেপির পক্ষে বেশ কঠিন কাজ।
ছয়, বিহারের ভোটে এনডিএর জয়ে বিরাট ভূমিকা নিয়েছে জাতপাতের সমীকরণ। যাদব-মুসলিমদের বাড়াবাড়ির আশঙ্কায়, দলিত-মহাদলিত, ওবিসি, ইবিসি, স্ববর্ণ, একযোগে ভোট দিয়েছে এনডিএর পক্ষে। কিন্তু বাংলার রাজনীতিতে জাতপাত এতটা প্রকট নয়। ফলে এই ধরনের কোনও সামাজিক জোট তৈরি বিজেপির পক্ষে কার্যত অসম্ভব।
সাত, বিহারের ফল দেখালো গ্রহণযোগ্য বিরোধী মুখ না তৈরি হলে ক্ষমতাসীন দাপুটে মুখ্যমন্ত্রীদের হারানো অসম্ভব। একই কথা কিন্তু বাংলায় বিজেপি এবং জেডিইউর জন্যও খেটে যায়। বাংলাতেও মমতার মতো মুখের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো জায়গায় বিজেপির কোনও মুখই নেই। তাছাড়া বিহারের ফলে বিজেপির অন্দরে অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি তৈরি হওয়ার সবরকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যা ২০২১-এ তাঁদের হারের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একই কাণ্ড কিন্তু ছাব্বিশেও হতেই পারে।
সর্বোপরি, যে কোনও রাজ্যে ভোটে জিততে প্রয়োজন সংগঠন। যা বঙ্গ বিজেপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। বাংলার সব বুথে বিএলএ দেওয়ার সামর্থ্যও নেই বিজেপির। এ কথা ঠিক যে বিহারের জয় খানিকটা হলেও চাঙ্গা করবে বঙ্গ বিজেপিকে। কিন্তু সেটা রাতারাতি জিতিয়ে দেবে বিজেপিকে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। বাংলা এবং বিহার যে আলাদা সেটা আগেও প্রমাণিত হয়েছে।
