১৯১১ সালের ১১ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জনগণমন’ রচনা করেন। এমন একটি গান যাতে স্তুতি জ্ঞাপিত হয়েছিল ভারতাত্মার চিরকালীন নিয়ন্ত্রী শক্তির– যাকে সে-অর্থে ‘ঈশ্বর’ও বলা যেতে পারে। ১৯১২ সালে, ব্রাহ্ম সমাজের যে পত্রিকা, সেখানে গানটিকে ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ হিসাবে ছাপা হয়। বিজেপির মুশকিল, তারা হয় ইতিহাস জানে না, বা জেনেই ঝঞ্ঝাট পাকাতে চায়। ‘জনগণমন’-র সঙ্গে ‘বন্দে মাতরম’কে লড়িয়ে দিতে চায়। রবীন্দ্রনাথ নিয়েও বিজেপির খুব অস্বস্তি। লিখছেন পবিত্র সরকার।
গল্পটা শুরু হয় ১৯১১ সালে। ১৯১২-তে দিল্লির দরবার বসবে, তখন অামাদের যিনি সম্রাট, পঞ্চম জর্জ, তিনি আসবেন। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের (নিজে নাম করেননি) এক উচ্চপদস্থ সরকারি বন্ধু, তঁাকে এসে অনুরোধ করেন– রাজার অভ্যর্থনা বা সংবর্ধনার জন্য গান লিখে দিতে হবে। এহেন অনুরোধে তঁার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এটা অবশ্য আমরা জানছি অনেক পরে।
এই প্রতিক্রিয়ায় ১৯১১ সালে ১১ ডিসেম্বর কবি ‘জনগণমন’ রচনা করেন। এমন একটি গান যাতে স্তুতি জ্ঞাপিত হল ভারত তথা ভারতাত্মার চিরকালীন নিয়ন্ত্রী শক্তির– যাকে সে-অর্থে ‘ঈশ্বর’-ও বলা যেতে পারে, আবার যা ‘ইতিহাস’ তথা ‘কাল’ হিসাবেও ধরে নেওয়া যেতে পারে। ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।/ হে চিরসারথী, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।’ এই ‘চিরসারথি’ কখনওই নির্দিষ্ট কোনও একটা সময়ের সম্রাট নন। বরং অজস্র সময়কাল ধরে নানা উত্থান-পতন, নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভারতকে চালিত করেছে যে বিশেষ শক্তি, রবীন্দ্রনাথ তঁাকেই ‘চিরসারথি’ বলতে চেয়েছেন। তিনি পরে তাকে ‘ব্রহ্ম’-র সঙ্গে এক করেও দেখেছেন। কারণ পরবর্তীতে, ১৯১২ সালে, ব্রাহ্মসমাজের যে পত্রিকা, সেখানে এটিকে ‘ব্রহ্মসংগীত’ হিসাবে ছাপা হয়।
১৯১১ সালেরই ২৭ ডিসেম্বর কলকাতায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে গানটি গাওয়া হয়। কিন্তু কংগ্রেসের অধিবেশনে, রাজাকে আবার বন্দনা করেও দক্ষিণাচরণ সেন নামে অন্য একজনের গানও গাওয়া হয়। এইটি থেকেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি। সুরেন্দ্রনাথ বন্দে্যাপাধ্যায়ের ইংরেজি দৈনিক ‘বেঙ্গলি’-তে ঠিকঠাক তথ্য-সহ খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু কলকাতার ‘দ্য ইংলিশম্যান’ ও ‘দ্য স্টেটসম্যান’– এই দু’টি সংবাদপত্রে– রবীন্দ্রনাথের রাজভক্তিমূলক গান গাওয়া হল বলে প্রতিবেদন বেরয়। সেটি অাবার বিদেশেও প্রচারিত হয়। ইংল্যান্ডের ‘ইন্ডিয়া’ নামে একটি দৈনিকেও প্রচারিত হয় একই তথ্য। রবীন্দ্রনাথ– এই বিভ্রান্তিমূলক তথে্যর সম্প্রসারণ রুখতেই– ব্রাহ্ম সমাজ আয়োজিত মাঘোৎসবে এটিকে ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ হিসাবে পরিবেশন করেন। এই নিয়ে বিতর্কের শুরু।
১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে যখন ভারতের জাতীয় সংগীত কী হবে এইটে নিয়ে তর্ক শুরু হয়– তখন সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, গান্ধীজি– এঁরা প্রত্যেকে ‘জনগণমন’-র প্রতি আপন-আপন সমর্থন জানিয়েছিলেন। কোন গানের বিরুদ্ধে? না, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’-এর বিরুদ্ধে। তার কারণ আর কিছুই না, ‘বন্দে মাতরম্’-এ দুর্গার চিত্রকল্প আছে। সেটা ভারতের যাঁরা অ-হিন্দু, তাঁদের মনে আঘাত দিতে পারে। এই কথা মাথায় রেখেই ‘বন্দে মাতরম্’-কে কংগ্রেস তখন ‘জাতীয় সংগীত’ হিসাবে গ্রহণ করেনি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র পরে, ১৯৪১ সালে যখন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করছেন, তখনও কিন্তু ‘জনগণমন’-কেই আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর সংগীত হিসাবে গ্রহণ করেছেন– ‘শুভ সুখ চৈন বরখা বরষে ভারত ভাগ হ্যায় জাগা’। ‘আজাদ হিন্দ রেডিও’-র মুমতাজ হুসেইন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্নেল আবিদ সাফরানিকে দিয়ে নেতাজি মূল গানের এই অনুবাদ করিয়েছিলেন।
পরে, ১৯৫০ সালে যখন ভারতের সংবিধান রচিত হল, তখন জনগণমনকে পাকাপোক্তভাবে দেশের ‘জাতীয় সংগীত’ রূপে গ্রহণ করা হল। অার ‘বন্দে মাতরম্’ হয়ে উঠল জাতীয় স্তোত্র। একটি ‘ন্যাশনাল অ্যান্থেম’, অপরটি ‘ন্যাশনাল সং। ১৯৩৭ সালে, যখন ‘জনগণমন’ ও ‘বন্দে মাতরম’ দু’টির মধে্য কোনটিকে ‘জাতীয় সংগীত’ করা হবে বলে তর্ক চলছে, তখন কংগ্রেসের হয়ে আলোচনার সময়, রবীন্দ্রনাথের কাছে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক পুলিনবিহারী সেন এ বিষয়ে তঁার ভাবনাচিন্তা জানতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সে-সময় একটি তীব্র চিঠি লেখেন তঁাকে। সেখানে তিনি জানাচ্ছেন: যখন আমার সেই বন্ধু, (আশুতোষ চৌধুরী না প্রদে্যাৎ নারায়ণ ঠাকুর, এই নিয়ে বিতর্ক আছে, হয়তো দ্বিতীয়জনই) আমাকে অনুরোধ করলেন, তখন আমি শুধু বিস্মিতই হইনি, আমার মনের মধে্য একটা উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছিল। সেই উত্তাপের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ওই গানটি রচনা করি। গানের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। নিজে সেই টেক্সট থেকে উদাহরণ দেন ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা...’ পঙ্ক্তিগুলি তুলে ধরে। বলেন সেখানে উল্লিখিত ‘চিরসারথি’ কখনও ব্রিটেনের রাজা হতে পারেন না। রাজা আসেন খণ্ড সময়ের জন্য। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, চিঠিতে: ভারতের চিরকালের অধিদেবতাকে বন্দনা করে আমি এই গানটা লিখেছি।
এখন বিজেপির নেতা ও প্রবক্তারা এগুলি জানেন না, বা জানতে চান না, বা পুরনো বিতর্ক তুলে ধরতে উৎসুক। সেই কারণে থেকে-থেকে উসকে দিতে চান আগুন। সুরের দিক থেকে তো বেটেই– যাকে বলা হয় ‘সিঙ্গেবিলিটি’– তদুপরি গানের যোগ্যতার দিক থেকেও সারা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন’, তাতে সন্দেহ নেই, বিদেশিরাও স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে বিজেপি তর্ক তুলতেই থাকবে। তার কারণ, তারা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে খুব একটা স্বচ্ছন্দ নয়। তঁার হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য, জাতপাত-ধর্মহীন মানবিকতার দাবি, তারা পছন্দ করে না বিশেষ। রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষার ভাবনাচিন্তার উচ্চতা অনুভব করার কথা বাদই দিলাম। তাই বিজেপি ব্রিগেড এই গানটিকে বদলানোর কথা প্রায়ই বলে। সংশোধনের কথা বলে। এতে কাশ্মীর নেই কেন, অসম নেই কেন, সিন্ধু আছে কেন– এসব নিয়ে অপরিণত, অপরিপক্ব ওজর তোলে। ছত্তিশগড় ঢোকাতে হবে, উত্তরাখণ্ড ঢোকাতে হবে, এমন সব হাস্যকর দাবি করে। কিন্তু একটা ধ্রুপদী গান তো আর ওভাবে সংশোধন করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথকে তারা না পারে গিলতে, না পারে ওগরাতে। এখানে এসে ‘আমার সোনার বাংলা’ বলে– অার ‘গুর্দেব গুর্দেব’ করে। কিন্তু অাসলে মানুষটাকে নিয়ে বিজেপি চিরকালই অস্বস্তিতে। তার ফলে এই ধরনের কথাগুলো চলতেই থাকবে। সম্প্রতি ‘আমার সোনার বাংলা’ নিয়ে যে-ঘটনাটি ঘটল সেটা অামাদের মনে আছে। আবার ‘বন্দে মাতরম্’-এর ১৫০ বছর পূর্তিতে এটাও দেখছি যে, কাশ্মীরে তা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কার্যত ফ্যাসিস্ট চেষ্টা, যে, ‘আমরা’ বলছি, অতএব ‘তোমাদের’ গাইতেই হবে। গাওয়ার ইচ্ছে না-থাকলেও। বিজেপি পুরো হিন্দুত্বের কাঠামো তৈরি করতে চায় দেশে। হিন্দু দেবীবন্দনা আছে ‘বন্দে মাতরম্’-এ। দেশকে দেবীর সঙ্গে, দুর্গার সঙ্গে তুলনা করা যেতেই পারে। রবীন্দ্রনাথ সেটা করেছেনও: ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!/ ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!...’ কিন্তু যে-গানটি সব সম্প্রদায় মিলে গাইবে, তাতে হিন্দু দেবী, রূপক হিসাবে থাকলেও, অ-হিন্দুদের আঘাত লাগতেই পারে। তারা প্রশ্ন তুলতে পারে– দেবীবন্দনার গান অামরা কেন গাইব? কাজেই গান নিয়ে জোরাজুরির অর্থ হয় না। এটা লড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কাম্য নয়।
শেষপাতে আবারও বলছি, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বিজেপির নানারকম সংশয়, সন্দেহ ছিল-আছে-থাকবে। ফলে এসব অপরিণতমনস্ক দাবিদাওয়া যে তাদের রয়েই যাবে আগামীতেও, তা নিয়ে আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আবার, এটিকে লড়িয়ে দেওয়ার মনোবিকার বলে অব্যর্থ চিনতে পারলেই– ভয়ের কিছু নেই।
(অনুলিখন: সোহিনী সেন)
(মতামত নিজস্ব)
