সংসদে সম্প্রতি বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী হিন্দু ধর্মের ঠেকা নিয়ে থাকা বিজেপির ধর্মভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। উগ্র-হিন্দুত্বর বদলে প্রগতিশীল, বহুত্ববাদী, সহিষ্ণু, পরমত গ্রহণে সক্ষম হিন্দু দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করা-ই তাঁর উদ্দেশ্য। বৈচিত্র ও উদারতা হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য, কাজেই এটাই কি বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের শাসক দলের মাথায় রাখা উচিত নয়? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
‘ইউ আর নট আ হিন্দু’। বিরোধী দলনেতা হয়ে রাহুল গান্ধী লোকসভায় তাঁর প্রথম বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদির দিকে তাকিয়ে এ-কথা বললেন। ইংরেজি ভাষায় ‘ইউ’ বহুবচন-ও বটে। অতএব, শুধু ‘তুমি’ নয়, ‘তোমরা হিন্দু নও’। এই ‘তোমরা’ মানে এখানে এ-দেশের হিন্দু সমাজ নয়, ‘তোমরা’ মানে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি। তার মানে? মানেটাও বলে দেন বিরোধী দলনেতা। বিজেপি হিন্দু ধর্মের ঠেকা নিতে পারে না। মহাদেবের ছবি দেখিয়ে রাহুল বললেন, আমি হিন্দু। আমরা হিন্দু। তখন আমার মনে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আমি কি হিন্দু? কে হিন্দু? জন্মসূত্রে বিজেপি নেতারা যাঁরা হিন্দু, তাঁরা হিন্দু হয়েও ‘হিন্দু’ নন কেন? এ তো একটা মস্ত ধাঁধা!
না, আসলে বিষয়টি জলবৎ তরলং। আমি জয়ন্ত ঘোষাল, জন্মসূত্রে হিন্দু। ব্রাহ্মণ। বাৎস্য গোত্র। কিন্তু আমি যদি মুসলমান-বিরোধী হই? আমার মধ্যে যদি ইসলামোফোবিয়া থাকে? তাহলেই কি আমি হিন্দু? আমার ব্লাড গ্রুপ ‘ও’ পজিটিভ। আমি যে কোনও ব্লাড গ্রুপের মানুষকে রক্ত দিতে পারি। কিন্তু যদি আমি মুসলিমদের পছন্দ না করি, এবং কোনও চূড়ান্ত সংকটাপন্ন মুসলিম মানুষকেও আমি যদি রক্ত দিতে না চাই? না দিই? তবেও কি আমি হিন্দু? আমার মনে হয়, তাহলে আমি হিন্দু নই। ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণর ভক্ত যদি হই, ক্ষিতিমোহন সেনের হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা যদি মানি, তাহলে কি আমার মুসলিম-বিরোধী হয়েও হিন্দু হওয়া সম্ভব? পারি না। ‘যত মত তত পথ’ জগতের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণর সাধনালব্ধ বাণী। আবার কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়-গানে, ‘মন্দিরে মসজিদে গীর্জায়, পূজিলে ব্রহ্মে সমশ্রদ্ধায়।’
গদাধরের তখন বয়স নয়। ইদের দিন কামারপুকুরের মাঠে ঠাকুর ইদে শামিল হতে যাচ্ছিলেন। সেখানে এক অশ্বত্থের তলে তিনি মূর্ছিত হন। লেখক সত্যচরণ মিত্র ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস’ বইয়ে জানাচ্ছেন, সেদিন ঠাকুর-কে হজরত মহম্মদকে দর্শন করেন। তিনি দেখলেন, পর্বতের উপর থেকে আকাশে সেই ব্রহ্মশক্তির প্রকাশ হচ্ছে। রামকৃষ্ণদেব ইসলাম-সহ প্রতিটি ধর্মের সাধন পদ্ধতি অবলম্বন করেন, এবং সব পথে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন।
হিন্দু ধর্মকে রাজনৈতিক হিন্দুত্বর এক মোনোলিথিক কাঠামো দেওয়াই কি তাহলে প্রকৃত হিন্দুর কাজ?
হিন্দু ধর্মে ভয়, অসহিষ্ণুতা, অনুদার মনোভাব থাকবে না। আর তাই তো একজন মানুষ নাস্তিক হয়েও ‘হিন্দু’ হতে পারে। নকশাল নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য জন্মসূত্রে হিন্দু ব্রাহ্মণ, অসীম চট্টোপাধ্যায়ও তা-ই। এই চট্টোপাধ্যায়-ভট্টাচার্যরা নাস্তিক। বিদেশ গেলে পাসপোর্টের ফর্মে, ‘ধর্ম কী?’ এ প্রশ্নের জবাবে ‘হিন্দু’-ই তো লিখতে হয়!
[আরও পড়ুন: ‘অযোধ্যার মতো গুজরাটেও বিজেপিকে হারাব’, আহমেদাবাদে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ রাহুলের]
হিন্দু ধর্ম মানে আচারসর্বস্বতা নয়। হিন্দু ধর্ম এক জীবন পদ্ধতি। ‘ওয়ে অফ লাইফ’। হিন্দু ধর্মে মৌলবাদের স্থান নেই। এমনকী হিন্দু মন্দিরে অ-হিন্দুদের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার ইতিহাস যা-ই থাকুক, তা আমি সমর্থন করি না। যেমন, ঋতুমতী নারীর মন্দিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা মানি না। হিন্দু ধর্মও তো অন্য যে কোনও ধর্মের মতো গতিশীল ধারণা। সময়ের হাত ধরে কত সংস্কার হয়েছে এ ধর্মে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভে আরও কট্টরবাদী ‘লাইন’ নিয়েছে। রামমন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলোপ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইন এনে মুসলিমদের ভারতছাড়া করা। ধীরে ধীরে সংবিধান সংশোধন করে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠনের প্রত্যাশা। ৩ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের দেশ নেপাল যেমন, তেমনভাবে ১৪৩ কোটি মানুষের ভারতও হোক ‘হিন্দু রাষ্ট্র’– এটাই বিজেপির উদ্দেশ্য। তবে ওই যে, ‘সর্বম অত্যন্তম গর্হিতম’– বাড়াবাড়ির ফল অনিবার্যভাবেই উলটো হয়ে যায়। বিজেপি হিন্দু ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক বাড়াবাড়ি করলেও ২০২৪ সালের নির্বাচনে নিজেদের ‘গড়’ অযোধ্যা-ফৈজাবাদেই পরাস্ত হয়েছে। বারাণসী শহরে খোদ নরেন্দ্র মোদির
ভোট ব্যাপকভাবে কমেছে।
ভবী অবশ্য তাতেও ভোলার নয়। এবারও সংসদে নতুন সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে একজন শপথ
নিতে গিয়ে চিৎকার করে ‘জয় হিন্দু রাষ্ট্র’ বলায় স্পিকারের কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। অথচ আরেকজন ‘জয় বাংলা’ বলায় স্পিকার সরব হয়েছেন। জানিয়েছেন, শপথবাক্যে যা সাংবিধানিক, সেটি ছাড়া অর্থাৎ প্রোটোকলের অধিক অতিরিক্ত একটি বাক্যও বলা যাবে না।
তবে এখন নয়, আরএসএস-জনসংঘ-বিজেপি বহুকাল ধরে বলে আসছে– নেহরু ও কংগ্রেস মুসলিম সমাজকে স্বাধীনতা ও দেশভাগের আগে থাকতেই ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসাবে ব্যবহার করেছে। এই ‘ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি’-র আমিও সমালোচক। ‘সাচার কমিটি’-র রিপোর্টেও তো জানা গিয়েছে, এ-দেশে মুসলিমদের উন্নয়নের হার কত কম। বিজেপি এই মুসলিম তোষণকে বলে ‘মেকি ধর্মনিরপেক্ষতা’। এখন তো ‘সেকুলারিস্ট’ শব্দটাই বিজেপি নেতাদের কাছে গালিগালাজ হিসাবে প্রতিপন্ন। তারা নিজেদের ‘সেকুলার’ বলে না। আবার প্রতিপক্ষ বিজেপিকে বলে ‘কমিউনাল’।
রাহুল গান্ধী ভারতের রাজনীতির এই দুই পাল্টা আখ্যানের বিরোধকে নতুন করে সামনে এনে দিয়েছেন। রাহুল এই তত্ত্ব গত দশ বছর ধরে বলছেন, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-তেও বলেছেন, কিন্তু সর্বভারতীয় মিডিয়াতে তা সেভাবে প্রচার পায়নি। এখন কংগ্রেস তথা বিরোধীদের আসন সংখ্যা বেড়েছে, রাহুল বিরোধী দলনেতা হয়েছেন। তাই উগ্র-হিন্দুত্বর বদলে পালটা প্রগতিশীল, বহুত্ববাদী, সহিষ্ণু, পরমত গ্রহণে সক্ষম হিন্দুধর্মীয় দর্শনকে প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছেন।
[আরও পড়ুন: ১৬ বার ‘স্পেসওয়াক’! মহাশূন্যে রেকর্ড গড়ল চিন]
একদা পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত কংগ্রেস নেতৃত্ব স্বাধীনতার আগে থাকতেই নাকি সনাতনী হিন্দুদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করত। মাথায় টিকি, খাটো ধুতি, খড়ম পরা মানুষদের গুরুত্ব না দিয়ে অভিজাত, ইংরেজিতে কথা বলতে পারা হিন্দুদের বিজয়রথ চালানো হত। তার প্রতিবাদেই বিজেপির সনাতনী হিন্দুত্ব নবজাগরণের চেষ্টা। যদিও এখন বিরোধী শিবির নরেন্দ্র মোদিকে বলার ও বোঝানোর চেষ্টা করছে– হিন্দু ধর্ম বহুত্ববাদী। সেখানে অস্পৃশ্যতা থাকার কথা নয়। ‘ইসলামোফোবিয়া’ থাকার কথা নয়। সেই হিন্দু ধর্ম স্বামী বিবেকানন্দর হিন্দু ধর্ম। সেই হিন্দু ধর্মে হিংসা নেই, আছে সমন্বয়।
ভারতীয় হিন্দু ধর্মে চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈনরা ‘বেদ’ মানত না। আবার ‘ন্যায়’, ‘বৈশেষিক’, ‘বেদান্ত’, ‘যোগ’, ‘সাংখ্য’, ‘পূর্ব মীমাংসা’, ‘উত্তর মীমাংসা’ কত শাখা! কেউ আস্তিক। কেউ নাস্তিক। কেউ ঈশ্বরবাদী, কেউ নিরীশ্বরবাদী। কত রকমের ভাষ্য। সবই হিন্দু ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্ম অবশ্য পরে দাবি করে তারা হিন্দু ধর্মের শাখা নয়। কিন্তু জৈন হয়েও এখনও হিন্দু হওয়া যায়।
ধর্মকে ইংরেজিতে বলে ‘রিলিজিয়ন’। সবশেষে এই দু’টি শব্দের আভিধানিক সংজ্ঞাটা জানাই। সংস্কৃত কলেজ থেকে প্রকাশিত এবং গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায় ও গোপিকামোহন ভট্টাচার্য কৃৎ-ত্রিভাষা (সংস্কৃত-বাংলা-ইংরেজি) অভিধানে বলা হয়েছে– ধর্মর (ধৃ-মন) অর্থ হল– শুভাদৃষ্ট, পুণ্য, শাস্ত্রাচার সৎকর্ম, যজ্ঞ, স্বভাব, গুণ, রীতি ইত্যাদি। কিন্তু রিলিজিয়ন কী? অক্সফোর্ড অভিধান সবচেয়ে প্রচলিত অর্থ: Action or
conduct indicating a belief in, reverence for and desire to please a divine ruling power; or the exercise or practice of rites or observances implying this. ফলে রিলিজিয়ন-এ তবু এক স্বর্গীয় শাসক শক্তির কথা বলা হলেও ধর্ম শব্দে তা নেই।
বিজেপি ক্ষমতাসীন হয়ে ভারতকে যে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছে, তাতে একজন মুসলিম নাগরিককেও বলতে হবে– আমার ধর্ম ইসলাম হলেও আমি হিন্দু। কারণ, আমি ভারতবাসী। এই হিন্দুত্ববাদী ধারণায় ‘গণতন্ত্র’ কোথায়? সনাতনী ভারতীয় হিন্দু ধর্ম কিন্তু গণতান্ত্রিক। বহুত্ববাদী ভিন্নমতের মানুষ হয়েও তাই হিন্দু ধর্মে মানুষ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করতে পারে। তাই তো হিন্দু ধর্ম মানুষের ধর্ম।