শিশু-হন্তারক সন্দেহে গণপ্রহারে মৃত দম্পতি। ঘটনা হাড়হিম, নিঃসন্দেহে। তবে জনতা নিজে জনার্দন হলে বিচারব্যবস্থার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?
সুজি জ্যাক-কে দেখতে পেয়েছে। জ্যাক, অর্থাৎ, তার বাবা। মেয়েকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে সে। খুঁজছে, কারণ বেশ কয়েক ঘণ্টা হল মেয়ে নিরুদ্দেশ। স্কুল থেকে তো এতক্ষণে ফিরে আসার কথা! স্ত্রী অ্যাবিগেইল পুলিশে খবর দিয়েছে ইতোমধ্যে। সুজি বাবাকে তারস্বরে ডেকে চলে। বাবা দশ মিটারের নাগালে। অথচ, সে বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না! বাবা তাকে শুনতেই পায়নি, দেখা তো দূরের কথা!
বছর চোদ্দোর সুজি ডেকে যায় তবু, অসহায় আর্তি। ডাকতে ডাকতেই মনে পড়ে তার– এই তো কিছুক্ষণ আগে, স্কুলফেরত প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করে ভুট্টাখেত ধরে ফিরছিল সে। পড়শি জর্জ হার্ভি তাকে ডেকে নিয়ে যায়। জোর করে নিজের খোঁড়া গর্তে, যা তার মতে “কিড’স হাইড আউট”, ফেলে দেয় সুজিকে। সে পালাতে চেষ্টা করে, প্রাণপণ। হার্ভি তাকে টেনে এনে ফের আছড়ে ফেলে গর্তে। আর তারপর সুজি দৌড়ে গিয়ে হার্ভির বাড়ি ঢোকে। একটা বাথটবে ভিজে শরীরে হার্ভি। বাথরুমের মেঝে ভাসছে সুজির দেহের চাপ-চাপ রক্তে। সিঙ্ক ফসেটে ঝুলছে, ওইত্তো, সুজিরই ব্রেসলেট! এই কিছুক্ষণ আগে হার্ভির হাতে খুন হয়েছে সে।
সুজি আটকেছিল স্বর্গ ও মর্তের ‘ইন-বিটুইন’-এ। আর দর্শকের চোখ ‘দ্য লাভলি বোন্স’ (২০১০) ছবির টানটান উত্তেজনায়। এমন অলীক সুযোগ অবশ্য পায়নি তেহট্টর স্বর্ণাভ বিশ্বাস। শুক্রবার খেলতে বেরিয়ে বাড়িই ফেরেনি নদিয়ার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রটি। গ্রামসুদ্ধ খেঁাজাখঁুজির পর তেহট্ট থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করার পাশাপাশি তার ছবি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা চালানো হয়। শুক্রবার গোটা দিন স্বর্ণাভ অন্তর্ধানের সুরাহা মেলেনি। শনিবার তার প্লাস্টিকে মোড়া মৃতদেহ স্থানীয় বাঁশবাগানের ডোবায় আবিষ্কার করেন আত্মীয় বাবলু মণ্ডল। খুনি সন্দেহে গ্রামের উন্মত্ত জনতা পড়শি উৎপল মণ্ডল ও স্ত্রী সোমা মণ্ডলের বাড়ি ভাঙচুর করে, তাতে আগুন লাগিয়ে গণপ্রহারে মেরে ফেলে দু’জনকে।
তেহট্ট থানার পুলিশ জনতার বাধায় প্রথমে ঢুকতে পারেনি গ্রামে। ধস্তাধস্তির পর কোনওক্রমে ঢুকে জখম মণ্ডল দম্পতি ও তাঁদের পুত্রবধূকে তেহট্ট মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে প্রথম দু’জনকে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। গ্রামবাসীদের অভিযোগ: মানসিক রোগী উৎপল শিশুপাচার চক্রে জড়িত ছিল। এর আগেও দুই শিশু-সহ পলাশিতে ধরা পড়ে মার খায়। তাই এবার আর রেয়াত করেনি স্থানীয়রা। আইন নিজে হাতে তুলে কেবলমাত্র সন্দেহের বশে হত্যা করে দু’জনকে। স্বর্ণাভর বাবা সত্যেন অবশ্য ‘বন্ধু’ উৎপল এহেন কাজ করতে পারেন তা বিশ্বাসে নিমরাজি। স্বর্ণাভহত্যা, অতএব, তদন্তাধীনই।
জনরোষের কি অধিকার আছে স্রেফ সন্দেহের বশে নিজ উদ্যোগে মানুষ মারার? কে দোষী-কে নির্দোষ তা বিচারে জনতাই যদি জনার্দন হবে, তবে গণতান্ত্রিক দেশে বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব কতটা প্রাসঙ্গিক? তারও আগে, কতটাই বা প্রাসঙ্গিক ‘রোষ’-এর পরাকাষ্ঠা যেখানে আদতে কোনও ঠোস প্রমাণ নেই? নিশ্চিন্তপুরের বাতাস তুলে দিল অনিশ্চিন্দির ধেঁায়াশা জড়ানো সওয়াল-সারি।
