shono
Advertisement

সম্পাদকীয়: রায় হোক আরও শিশুবান্ধব

নাবালিকার যৌন নির্যাতন মামলায় বম্বে হাই কোর্টের রায় নিয়ে তুঙ্গে বিতর্ক।
Posted: 03:36 PM Jan 28, 2021Updated: 03:36 PM Jan 28, 2021

শতাব্দী দাশ: বছর দুই আগে শিশুসুরক্ষার স্বার্থে এবং সচেতনতার প্রসার ঘটাতে শিশু-যৌন নির্যাতন বিষয়ক ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছিল একটি শিশুবান্ধব মঞ্চ। প্রশিক্ষণ শুরুর আগে ‘চাইল্ডলাইন’-এর অ্যানিমেশন ‘কোমল’ দেখানো হল। দেখা গেল, বেশিরভাগ মা-বাবা ছবিটি শুরু হতে অস্বস্তিতে ভুগছেন, অথচ শিশুরা দিব্য বিভিন্ন ‘ব্যক্তিগত’ অঙ্গ চিনে নিচ্ছে। তাই নয় শুধু, সেগুলির নামও আওড়াচ্ছে অ্যানিমেশন চলার সঙ্গে সঙ্গে। বাচ্চাদের মধ্যে কোনও জড়তা ছিল না, যা ছিল অভিভাবকদের মধ্যে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: চাকরি পেলেন ও খোয়ালেন সাংবাদিক নিধি রাজদান]

এ তো গেল নাগরিক পরিসরের চিত্র! এর বাইরে আছে বৃহত্তর ভারতের শিশুরা- ফুটপাথের শিশুরা, কাগজকুড়ুনি শিশুরা, শিশুশ্রমিকরা, গ্রামের শিশুরা, দারিদ্রসীমার নিচে থাকা শিশুরা- যাদের মধ্যে সচেতনতার হার আরও কম, যাদের যৌন নির্যাতন পরিসংখ্যানেও প্রতিফলিত হয় না। এই প্রেক্ষিতে বম্বে হাই কোর্টের নাগপুর বেঞ্চের সাম্প্রতিক রায়টিকে আমাদের বিচার করতে হবে। যেখানে অধিকাংশ পরিবার শিশুকে যৌন নির্যাতন সম্পর্কে সচেতন-ই করে না নিজস্ব অস্বস্তির কারণে, যেখানে শিশুর উপর যৌন অত্যাচার হলে তা থানায় নথিভুক্ত করে আরও কম পরিবার, সেখানে পুণের একটি পরিবার যথাবিহিত কন্যার নিগ্রহের পর থানায় কেস করল। স্পেশাল কোর্ট ‘পকসো’ অনুসারে শাস্তিবিধানও করল। অথচ উচ্চ আদালত পকসো খারিজ করে বলল, পোশাক না সরিয়ে স্তন মন্থন পকসোর ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী যৌন নিগ্রহ কি না, তা অস্পষ্ট। তাই পকসো-র ৮ নম্বর ধারা অনুয়ায়ী শাস্তিও হতে পারে না। শ্লীলতাহানির ধারা (৩৫৪, আইপিসি) রেখে দেওয়া হল অবশ্য, যা অপেক্ষাকৃত লঘু শাস্তি দাবি করে। তবে শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ে স্থগিতাদেশ জারি করেছে।

’১৬ সালের ডিসেম্বরের ১৪ তারিখের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাগপুরের গিত্তিখাদান থানায় এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এফআইআর করেন এক মা। ব্যক্তিটি তাঁর বারো বছরের মেয়েকে পেয়ারার লোভ দেখিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যৌন উৎপীড়ন করেছিল বলে অভিযোগ। বুকে হাত দেওয়া, স্তন মন্থন করা, সালোয়ার খোলার চেষ্টা ইত্যাদির কথা এফআইআরে লেখা ছিল। এর ভিত্তিতে পকসোর ৮ ধারায় এবং তৎসহ ভারতীয় আইনের ৩৫৪ (শ্লীলতাহানি), ৩৬৩ (অপহরণ), ৩৪২ (জোর করে আটকে রাখা) ইত্যাদি ধারায় মামলা রুজু হয়। নাগপুরের বিশেষ কোর্টের অতিরিক্ত যুগ্ম সেশন বিচারপতি পকসো-সহ বাকি ধারাগুলির যাথার্থ্য মেনে নেন ও সেই মর্মে রায় দেন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অভিযুক্তের তিন বছর জেল ও জরিমানা ধার্য হয়। রায়ের পুনর্বিবেচনার আপিল করা হয়েছিল অপরাধীর পক্ষ থেকে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বম্বে হাই কোর্টের নাগপুর বেঞ্চ বর্তমানে আলোচ্য রায়টি দেয়। এমনই কাকতাল, পকসো খারিজ হওয়ার খবরটি সংবাদপত্রে শোভা পেল জাতীয় কন্যাশিশু দিবসে।

পকসো-র ৭ বা ৮ ধারায় কোথাও লেখা নেই, ‘ত্বক স্পর্শ’ করাকেই (‘স্কিন টু স্কিন কনট্যাক্ট’) শুধু ‘স্পর্শ’ বলা হবে। একটি অপরাধকে পকসোর ৭ ধারায় পড়তে গেলে দু’টি শর্ত পূরণ করতে হয়। এক, যৌন উদ্দেশ্য থাকতে হবে। দুই, নির্দিষ্ট কিছু ‘ব্যক্তিগত অঙ্গ’-কে (স্তন, পায়ু, যোনি, পুরুষাঙ্গ) স্পর্শ করার ঘটনা ঘটে থাকতে হবে। ‘যৌন উদ্দেশ্য’ সম্পর্কে আদালত নিশ্চিত বলেই তো ৩৫৪ ধারা বজায় রেখেছে! তবে সাধারণ মানুষের অনেকেরই এখানে ‘স্পর্শ’ শব্দটির ব্যাখ্যা ‘সংকীর্ণ’ বলে মনে হচ্ছে।

সর্বোপরি, পকসো-র প্রাণ হল ২৯ নম্বর ধারা, যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে, পকসো-র ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে অপরাধী ধরেই এগতে হবে, কারণ পকসো শিশুদের কল্যাণের সঙ্গে জড়িত। শিশুর স্বার্থ সর্বাগ্রে দেখা হবে। সাধারণ যৌন হেনস্তা, নির্যাতন বা ধর্ষণের ধারাগুলি আদালতে শিশুদের বাড়তি নির্যাতনের কারণ হয় বলেই ২০১২ সালে POCSO আইন এসেছিল। আবার, শিশুদের ‘মডেস্টি অফ উইমেন’ (৩৫৪ ধারা অনুযায়ী যা হানি করা অপরাধ) গোত্রীয় বিমূর্ত ধারণা বুঝতে অসুবিধা হয় বলেই পকসো-তে স্থান-নির্দিষ্টভাবে যৌন স্পর্শ (অর্থাৎ ব্যক্তিগত অঙ্গ-স্পর্শ) চেনানো হয়। ওয়ার্কশপে বা স্কুলেও বাচ্চাকে ‘ব্যাড টাচ’ বা ‘মন্দ স্পর্শ’ শেখানোর সময় পকসোতে উল্লিখিত অঙ্গগুলিই চেনানো হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এবার প্রশিক্ষকরা কী শেখাবেন শিশুদের? যোনি, লিঙ্গ, পায়ু, বুকে হাত দেওয়াটা ‘মন্দ স্পর্শ’ নয় যতক্ষণ না পোশাক সরানো হচ্ছে? গণ পরিবহণ বা রাস্তায় অলক্ষে শিশুদের উপর যে যৌন অপরাধগুলি ঘটে, সেখানে পোশাক সরানোর অবকাশ থাকে না, হয়তো তার প্রয়োজনও পড়ে না। তাহলে সেগুলিও যৌন নির্যাতন নয়? অপ্রাপ্তবয়স্ক নির্যাতিতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যদি ভাবা হয়, তাহলে কি সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার অভিপ্রায়টি কোথাও না কোথাও ফিকে হয়ে যাচ্ছে না? নাগপুরের বালিকাটির মতো প্রত্যেক বালিকার কাছে এই বার্তাই কি গেল না যে, সম্মতি ছাড়া তাকে স্পর্শ করাই যায়, যতক্ষণ না তার পোশাক অনাবৃত হচ্ছে? শারীরিক স্বশাসন ও সীমানার ধারণাকে, সম্মতি বা কনসেন্টের ধারণাকে যেন কোথাও খণ্ডিত করল বম্বে হাই কোর্টের এই রায়! বিচারপতি নিজেও বলেছেন রায়ের চোদ্দোতম পাতায় যে, পকসো-র তুলনায় ৩৫৪ ধারা ‘মাইনর ক্রাইম’। পকসো-র ফাঁক গলে বেরনো অপেক্ষাকৃত কঠিন। অথচ রায় যেন মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতে হাঁটছে!

২০১৮ সালের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’-র তথ্য অনুযায়ী, ভারতে দৈনিক শিশু-যৌন নির্যাতন বা অন্তত নথিভুক্ত শিশু-যৌন নির্যাতন আগের বছরের চেয়ে ২২% বেড়েছিল। প্রতি বছরেই এই সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। মহারাষ্ট্র কিন্তু তখনও শিশু-যৌন নিগ্রহের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছিল। উত্তরপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু ছিল যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে। সেই মহারাষ্ট্রেই আবার উক্ত রায়দানটি ঘটল। তথ্য আরও বলে, শিশুরা নিরাপদ নয় আপন গৃহেও। আর, ছেলেদের শৈশবও যৌন-হেনস্তা মুক্ত নয়।

আশার কথা, ‘বচপন বচাও আন্দোলন’ এনজিও থেকে শুরু করে ‘জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশন’ (NCPCR)-এর চেয়ারপার্সন প্রিয়ঙ্ক কানুনগো– অনেকেই এই রায়কে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করতে আগ্রহী ছিলেন। একযোগে প্রতিবাদ জানিয়েছে ‘অল ইন্ডিয়া প্রোগ্রেসিভ উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন’, ‘পিপল এগেন্সট রেপ ইন ইন্ডিয়া’, ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ প্রভৃতি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। তার মধ্যেই জানা গেল, সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদের সামনে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল বেণুগোপাল ও সর্বোচ্চ আদালত বম্বে হাই কোর্টের নাগপুর বেঞ্চের ওই রায়ের উপর আপাতত স্থগিতাদেশ জারি করেছে। এই রায় আশু পরিবর্তিত হওয়া প্রয়োজন। নাহলে ‘প্রিসিডেন্ট’ বা অতীত উদাহরণ হিসাবে তা আগামীতে নিঃসন্দেহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ভারতীয় বিচারব্যবস্থায়।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক স্কুলশিক্ষিকা ও সমাজকর্মী
satabdiwrites@gmail.com

[আরও পড়ুন: হার-জিত অন্য বিষয়, এই ভারতীয় দল নিয়ে আলোচনা হবে ভবিষ্যতেও]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement