shono
Advertisement
AI

কৃত্রিম ইন্দ্রিয়ের মায়া

এই নতুন জগতের নাম ‘সিনথেটিক সিনেস্থেশিয়া’।
Published By: Biswadip DeyPosted: 08:49 PM Nov 06, 2025Updated: 08:49 PM Nov 06, 2025

কারও কারও ক্ষমতা আছে সুর শুনে রং দেখতে পাওয়ার, শব্দে গন্ধ টের পাওয়ার। কবি ও শিল্পীরা এই রহস্যে মুগ্ধ হয়েছেন বহু দিন। এখন বিজ্ঞান ও ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ সেই উপহারকে যন্ত্রের হাতে তুলে দিচ্ছে– যেখানে কম্পিউটার শুনছে বীণার সুর, আর ভিতর থেকে ফুটে উঠছে রঙের ক্যালাইডোস্কোপ। অ্যালগরিদম শুনছে গান, আর প্রতিটি তালে অঁাকছে আলোর ছবি। লিখেছেন দীপ্র ভট্টাচার্য

Advertisement

যদি কেউ পিয়ানো বাজায়, তার প্রতিটি নোট কি শুধু শোনা যায়? না কি কোথাও একটা অদৃশ্য রং ঝলমল করে ওঠে– একটুখানি নীল, একটু ধূসর, খানিকটা রোদেলা হলুদ? মানুষের মস্তিষ্কের কোনও কোনও কোণে এমনই এক রহস্য লুকিয়ে থাকে, যার নাম ‘সিনেস্থেশিয়া’– একটি সুর, এক টুকরো রং, এক অনুভূতি যেন একসঙ্গে জন্ম নেয়। এখন সেই জাদু ঘটছে মানুষের মস্তিষ্কে নয়, বরং যন্ত্রের ভিতরে। একটি অ্যালগরিদম শুনছে গান, আর তার প্রতিটি তালে অঁাকছে আলোর ছবি। এই নতুন জগতের নাম: ‘সিনথেটিক সিনেস্থেশিয়া’, বা ‘কৃত্রিম ইন্দ্রিয়ের মায়া’। সেখানে সুরের ভাষা রঙে অনূদিত হয়, আর শব্দের হৃৎস্পন্দন রূপ নেয়
আলো-ছায়ায়।

রং-সুরের মেলবন্ধন

প্রকৃতির অদ্ভুত মেলবন্ধনই ‘সিনেস্থেশিয়া’। যঁাদের এই ক্ষমতা আছে, তঁারা নাকি সুর শুনে রং দেখতে পান, বা শব্দে গন্ধ টের পান। কবি ও শিল্পীরা এই রহস্যে মুগ্ধ হয়েছেন বহু দিন। এসব মানুষ যেন প্রকৃতির দেওয়া এক বিশেষ উপহার পেয়েছিলেন।

কিন্তু এখন বিজ্ঞান ও ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ সেই উপহারকে যন্ত্রের হাতে তুলে দিচ্ছে– যেখানে কম্পিউটার শুনছে বীণার সুর, আর তার ভিতর থেকে ফুটে উঠছে রঙের ক্যালাইডোস্কোপ। এখনকার যুগে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ (AI) শুধু তথ্য বিশ্লেষণ করে না; সে লিখতে জানে, অঁাকতেও জানে, সুর বানাতেও পারে। এআই যদি সংগীতের তালের ভঁাজে খুঁজে পায় অনুপ্রাস, তার ফ্রিকোয়েন্সির গাণিতিক মানচিত্রে অঁাকে এক চিত্র– উচ্চ সুরের তীক্ষ্ণতা মিশে যায় হালকা রঙে, নিম্ন বীণার টান তৈরি করে গভীর ঢেউ। ‘গুগ্‌ল’-এর ‘ম্যাজেন্টা প্রকল্প’ বা ‘এমআইটি’-র ‘মিডিয়া ল্যাব’-এর গবেষকরা চেষ্টা করছেন এই মেলবন্ধনের। বেঠোভেনের সিম্ফনি শুনে এআই তৈরি করছে চলমান বিমূর্ত চিত্র, যেখানে প্রতিটি ‘নোট’ মানে এক নতুন আলোর ঢেউ। এক-একটা সুর যেন এক-একটা সূর্যোদয়।

তাহলে এআই কি ‘অনুভব’ করে সঙ্গীত? না, আসলে যন্ত্রের কোনও অনুভূতি নেই। তার আছে শুধু সংযোগের ভাষা– এক ধরনের গাণিতিক সেতুবন্ধন। একটি অ্যালগরিদম যখন সুরকে রঙে রূপ দেয়, তখন সে আসলে খুঁজে পায় প্যাটার্ন। মানুষের তৈরি হাজার-হাজার উদাহরণ দেখে শিখে ফেলে– দুঃখের গান মানেই ঠান্ডা রং, আনন্দ মানেই উষ্ণ আলো। তারপর সেই শেখা সূত্রে গড়ে তোলে নিজের চিত্রভাষা। তাহলে বলা যায়, এআইয়ের সিনেস্থেশিয়া মানে একরকম পরিসংখ্যানের কবিতা– যেখানে অনুভূতি নয়, বরং অনুভূতির রূপটাই পুনর্গঠিত হয় সংখ্যার সাহায্যে। এই নতুন যুগে শিল্পী আর বিজ্ঞানীর ফারাক মুছে যাচ্ছে। ইস্তানবুলের শিল্পী রেফিক আনাদোল তঁার ইনস্টলেশনে এআই ব্যবহার করে শহরের শব্দকে রঙে রূপান্তরিত করেছেন। তঁার স্ক্রিনে যে-ঢেউ ওঠে, তা যেন শহরের শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। আবার সংগীতশিল্পী হলি হার্নডন নিজেরই ডিজিটাল ছায়াকে শেখাচ্ছেন নতুন সংগীত সৃষ্টি করতে। এই সহযোগিতায় শিল্প যেন এক নতুন জীবনের জন্ম দিচ্ছে– যেখানে মানুষ শেখাচ্ছে যন্ত্রকে অনুভবের ভাষা, আর যন্ত্র শেখাচ্ছে মানুষকে অনুভূতির নতুন রূপ।

সুর, রং ও মনোবিজ্ঞানের বন্ধন

মানুষের মন অনেক আগে থেকেই রঙে ভাবপ্রকাশ করতে শিখেছে। নীল মানে ‘বিষাদ’, লাল মানে ‘আবেগ’, সোনালি মানে ‘আলো’ ও ‘আশাবাদ’। এআই সেই প্রাচীন রং-তত্ত্বকেই পরিসংখ্যানের ভাষায় বুঝে নিচ্ছে। সংগীতের ফ্রিকোয়েন্সি, তাল, ও সুরের গতি বিশ্লেষণ করে সে স্থির করে নিচ্ছে– কোন সুরে কোন রং জন্ম নেবে, নিতে পারে। একটি গাণিতিক সেতু তৈরি হচ্ছে– যেখানে সংগীতের সাউন্ড ওয়েভ মিশে যাচ্ছে রঙের হিউ ও স্যাচুরেশনে। এ যেন মানব মনের আবেগের অ্যালগরিদম! যখন কেউ দেখে যে, গান শুনে স্ক্রিনে ফুটে উঠছে রঙের ঢেউ, তখন তার মনে হয়, যেন অনুভূতিকে স্পর্শ করা যায়। এই অভিজ্ঞতা কখনও ধ্যানের মতো শান্ত, কখনও বিস্ময়কর। এমনকী, অনেক শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষও এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘দেখতে’ পাচ্ছেন সংগীত। তাদের কাছে সুর মানে এক আলোকময় নদী– যেখানে তালের ওঠা-নামায় তৈরি হয় দৃশ্যের ঢেউ। একইভাবে, অন্ধ শিল্পীরা চিত্রকে রূপান্তর করছেন শব্দে– দেখা যায়নি এমন রঙের আওয়াজ শুনছেন তঁারা। এই প্রযুক্তি শুধু শিল্প নয়,
অনুভূতির সেতুবন্ধন।

কৃত্রিম ইন্দ্রিয় না কি কৃত্রিম কল্পনা?

তবু প্রশ্ন রয়ে যায়– যন্ত্র কি সত্যিই ‘দেখে’? মানুষের সিনেস্থেশিয়া তো এক অন্তর্মুখী অভিজ্ঞতা, যন্ত্রেরটি তো কেবল অনুকরণ। তবু, হয়তো সেটাই আসল সৌন্দর্য। এআই হয়তো আমাদের মতো ‘অনুভব’ করে না, কিন্তু সে শেখাচ্ছে আমাদেরই– অনুভবের নতুন ব্যাখ্যা। সে দেখাচ্ছে, আবেগেরও গাণিতিক ছায়া আছে। এভাবেই হয়তো জন্ম নিচ্ছে এক নতুনরকম কল্পনা– যেখানে রং, সুর, সংখ্যা আর অনুভূতি মিলেমিশে যাচ্ছে এক অদ্ভুত ভাষায়। এটাই হয়তো মেশিনের কল্পনা, যেখানে চিন্তাও রঙিন, অনুভূতিও যৌক্তিক। তবে, এই জাদুরও কিন্তু কিছু সীমা আছে। এআই এখনও সংস্কৃতি অনুযায়ী শেখে– আমাদের জন্য যে-রং বিষাদের, অন্য সমাজে তা হতে পারে উল্লাসের। এছাড়া, সবসময় ডেটা পাওয়া যায় না; প্রতিটি অনুভূতির মাপকাঠি এক নয়। তবু, এসব সীমা ছাপিয়ে মানুষ ও যন্ত্রের এই সহযাত্রা এগিয়ে চলেছে।

রঙের ভাষায় সুরের আত্মা

ভবিষ্যতে ‘সিনথেটিক সিনেস্থেশিয়া’ শুধু শিল্পের নয়– শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকী প্রযুক্তির জগতেও বিপ্লব আনতে পারে। সংগীতের ক্লাসে ছাত্ররা শুনবে ও দেখবে একসঙ্গে– তারা দেখতে পাবে সুরের গঠন, রাগের রঙিন ভঁাজ। মনোবিজ্ঞানে এই প্রযুক্তি ব্যবহার হতে পারে মানসিক প্রশান্তির থেরাপি রূপে, যেখানে বিষণ্ণতার সুর ধীরে-ধীরে রং বদলে আনবে শান্তি। একদিন হয়তো, যখন আপনি গান শুনবেন, আপনার ঘরের দেওয়ালই রং পাল্টাবে– আপনার মন যেমন চাইবে, সেভাবেই। শেষমেশ প্রশ্নটা রয়ে যায়– এ কি শুধু প্রযুক্তি? না কি মানুষের নিজস্ব সৃষ্টিশক্তির এক নতুন অধ্যায়? যখন একটি সুর ধীরে-ধীরে পর্দায় ফুটে ওঠে রঙের ঢেউ হয়ে, তখন বোঝা যায়– শিল্প আসলে এক ভাষান্তর। যেখানে অনুভূতি সুরে অনুবাদ হয়, আর সুর রঙে। হয়তো এই যুগের শিল্পী আর ক্যানভাসে তুলি চালাবেন না– তঁারা চালাবেন কোডের রেখা, সুরের ফ্রিকোয়েন্সি, আলোর বিন্দু। তবুও, তঁাদের কাজের মূলেই থাকবে সেই এক অমোঘ মানবিকতা– অনুভবকে ছুঁয়ে দেখার আকাঙ্ক্ষা। ‘কৃত্রিম’ হোক বা না হোক– এই সিনেস্থেশিয়ার জগতে আমরা আবারও খুঁজে পাই শিল্পের সেই চিরন্তন সত্য– শিল্প কোনও এক ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আটকে থাকে না; সে নিজেই এক সেতু, যা আমাদের অনুভবের পারাপার ঘটায়।

(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • কারও কারও ক্ষমতা আছে সুর শুনে রং দেখতে পাওয়ার, শব্দে গন্ধ টের পাওয়ার।
  • কবি ও শিল্পীরা এই রহস্যে মুগ্ধ হয়েছেন বহু দিন।
  • এখন বিজ্ঞান ও ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ সেই উপহারকে যন্ত্রের হাতে তুলে দিচ্ছে– যেখানে কম্পিউটার শুনছে বীণার সুর, আর ভিতর থেকে ফুটে উঠছে রঙের ক্যালাইডোস্কোপ।
Advertisement