shono
Advertisement

মিথ্যে বেচার কৌশল! ক্রেমলিনে ড্রোন আক্রমণের নেপথ্য কাহিনি কী?

রুশ জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে ‘রাশিয়ার গডফাদার’ হতে চাইছেন পুতিন।
Posted: 11:48 AM May 06, 2023Updated: 11:48 AM May 06, 2023

ভ্লাদিমির পুতিন রুশ জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগিয়ে ‘রাশিয়ার গডফাদার’ হতে চাইছেন। ঠারে-ঠোরে বোঝাচ্ছেন, রুশ জাতীয়তাবাদ আক্রান্ত। রুশ সত্তা-সংস্কৃতি রক্ষার্থেই তাঁর লড়াই। ফলে, রাশিয়ায় পুতিন জনপ্রিয় হবেন, দুনিয়ার কাছে তিনি যতই যুদ্ধবাজ হন না কেন- এটাই রণকৌশল। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement

 

ক্রেমলিনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রাসাদের উপর ইউক্রেন দু’-দু’টি ড্রোন আক্রমণ করেছে। পুতিনকে হত‌্যা করাই নাকি ছিল ইউক্রেনের লক্ষ‌্য। রুশ কর্তৃপক্ষ ৩ মে সরকারিভাবে এই দাবি করেছে। রুশ সরকারি টেলিগ্রাম চ‌্যানেল ‘বাজা’ (Baza) একটি ভিডিও পোস্ট করেছে যাতে দেখা যাচ্ছে উড়ন্ত ড্রোন এগিয়ে আসছে ক্রেমলিনের দিকে। এর আগেও চার-পাঁচবার পুতিনকে হত‌্যা করার চেষ্টা হয়েছে।

আবার, অন‌্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো মিখাইলোভিচ পোডোলিয়াক জানিয়েছেন, এই ড্রোন আক্রমণে ইউক্রেনের ভূমিকা-ই নেই। কারণ, এটা কোনও সামরিক কর্মসূচির মধ্যেই পড়ে না। শুধু তাই নয়, ইউক্রেন আরও বলছে এসবই রাশিয়ার ষড়যন্ত্র। বানানো ঘটনা। আসলে, এই আক্রমণ কাহিনি শুনিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনে বড় ধরনের কোনও আক্রমণে যেতে চাইছে।

রাশিয়া বলছে রেড স্কোয়ারে বিজয় দিবস পালন উপলক্ষে রুশ সেনার কুচকাওয়াজ চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিকে পরাস্ত করার স্মৃতিতে বিজয়োৎসব। সেখানে পুতিনের আসার কথা ঘোষণা হয়। সেজন‌্যই ইউক্রেনে ড্রোন হামলা।

[আরও পড়ুন: ডাবল ইঞ্জিনের দাক্ষিণাত্য! কর্ণাটকে শেষ হাসি হাসবে কে?]

এক্ষেত্রে কে সত্যি বলছে আর কে মিথ্যে বলছে, তা নিয়ে পৃথিবীর নানা গোয়েন্দা বাহিনী তদন্ত করবে। আপাতত যেটা বলা যায়- দু’দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি এই ঘটনার ফলে আরক্ত তিক্ততায় পর্যবসিত হয়ে গেল। সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লিতে ‘জি-২০’ সম্মেলনের আগে এই আক্রমণ কি শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী বিবৃতির ঐকমত‌্য রচনার প্রচেষ্টাতেও জল ঢেলে দিল?

যেদিন ক্রেমলিনে ড্রোন আক্রমণের ঘটনা নিয়ে দুনিয়ায় শোরগোল শুরু হল, ঘটনাচক্রে সেদিনই আমি একটা বই পড়ছিলাম, অসাধারণ লাগছে বইটি পড়তে। বইটির নাম, ‘মাই রাশিয়া ওয়ার অর পিস?’ লেখক মিখাইল শিশকিন।

৬২ বছরের রুশ-সুইস এই লেখক ‘রাশিয়ান বুকার’ (২০০০) পুরস্কার পেয়েছেন। এই বইতে তিনি সাম্প্রতিক রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কাহিনি বলতে গিয়ে অতীত রাশিয়ার রাজনীতিতে স্বৈরতন্ত্র ও মিথ‌্যাচারের শিকড় খুঁজেছেন। শিশকিন লিখছেন, আমার বাবা রুশ, আর মা ইউক্রেনীয়। এই যুদ্ধটা আজ শুরু হয়েছে এমন নয়, ২০১৪ সাল থেকে শুরু।

শিশকিন ২০১৪ সাল থেকে লিখছেন, টিভিতে নানা অনুষ্ঠানে বলেছেন এই মর্মে। তখন থেকে রাশিয়া সক্রিয় হলেও ইউরোপ তথা পশ্চিম বিশ্বাস করেনি- সত্যি সত্যিই রাশিয়া আক্রমণে যাবে। এখন ‘ন্যাটো-ও পালটা যুদ্ধে অবতীর্ণ, কিন্তু এই যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা তো আগেই করা উচিত ছিল। বাবা রাশিয়ার, মা ইউক্রেনের। তাই লেখক বলছেন, যুদ্ধটা করছে রাজনেতারা, অথচ সাধারণ মানুষের মধ্যে এর ফলে সাংস্কৃতিক বিরোধ তৈরি হচ্ছে, যা আসলে নেই। উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখক বলছেন, আমার বাবার বয়স তখন ১৮। আমার কাকা নিহত হন জার্মানের হাতে, বিশ্বযুদ্ধর সময়।

তারপর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাবা জার্মান-বিরোধী ছিলেন। জার্মানদের তিনি ক্ষমা করতে পারেননি। আমি বাবাকে বলেছিলাম, জার্মানদের সাহিত‌্য, শিল্প, সংস্কৃতি কত শক্তিশালী! কিন্তু আমার কথায় বাবার মনে কোনও প্রভাবে পড়েনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরও সেই একই সংকট। ইউক্রেনে সাধারণ মানুষের বাড়ি ধ্বংস করছে রুশ সেনা, এ অবস্থায় ইউক্রেনবাসী তো তলস্তয়-গোর্কি-চেকভ পর্যন্ত প্রত্যেককে শত্রু ঠাওরাচ্ছে।

শিশকিন বলছেন, পুতিন (Vladimir Putin) রুশ জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগিয়ে ‘রাশিয়ার গডফাদার’ হতে চাইছেন। ভাবটা এমন যে, রুশ জাতি আক্রান্ত, রুশ সত্তা-সংস্কৃতি রক্ষার্থেই লড়াই। ইউক্রেনে রুশদের উপরও অত‌্যাচার হচ্ছে। এর ফলে রাশিয়ায় পুতিন জনপ্রিয় হবেন, দুনিয়ার কাছে তিনি যতই যুদ্ধবাজ হন না কেন, এটাই ছিল রণকৌশল।

লেখক বলছেন, রাশিয়ায় মিথ্যে বেচা নতুন নয়। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনের সংবিধানে বলা হয়েছিল, এটি হল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক সংবিধান। এই সংবিধানটি লেখেন নিকোলাই বুখারিন। ১৯৩৭ মার্চ মাসে এই সংবিধান গৃহীত হওয়ার তিনমাস পরই তাঁকে ষড়যন্ত্রর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। বুখারিনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও ছিল তিনি স্তালিনকে হত‌্যা করতে চেয়েছেন।

ক্রেমলিনের ‘মিথ্যে’ বলা নতুন নয়। শিশকিন বলছেন, ক্রাইমিয়ায় (Crimea) কোনও রুশ সেনা নেই। ২০১৪ সালের বসন্তে পুতিন এ-কথা বলেন। পরে সেই পুতিনই বলেন, ক্রিমিয়াতে
রুশসেনা সক্রিয়। পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়া আদৌ সক্রিয় নয়, প্রথমে ক্রেমলিন এ কথা বলে। এদিকে পুতিন সেখানে তখন সেনা পাঠাচ্ছেন। লেখকের ভাষায়, When Putin lies in his own country, everyone knows he’s lying and he knows that everyone knows but his voters consent to his lies. Russian truth is a never ending lie. কী ভয়ংকর কথা!

লেখক বলছেন, তিনি একদা এক শিশুকাহিনি পড়েন। বইটির নাম, ‘Gelsomiro in the land of Liars’, লেখক গিয়ানি রোভারি। স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা এ বইয়ে গল্প ছিল একদল দস্যুর, যারা একটা দেশ লুঠ করে। হাইজ‌্যাক হয়ে যাওয়া সে-দেশে এক বালক পৌঁছে দেখে সেখানে সবাই মিথ্যে বলে। মিথ্যে বলা বাধ‌্যতামূলক। বিড়ালদের বলা হয় তারা ‘ঘেউ ঘেউ’ করে আর কুকুর ‘মিউ মিউ’ করে। সব টাকা সেখানে জাল। সব খবরের কাগজের তথ‌্যসূত্র হতে হবে ‘মডেল মিথ্যেবাদী’ রাষ্ট্রের পরীক্ষায় পাস করা মিথ্যুক সম্পাদক।

লেখক মনে করেন, রাশিয়া চিরকাল এ পথেই চলেছে। আসলে স্তালিন কোনও দিনই বিদায় নেননি। প্রকৃত ‘ডিস্ট‌্যালিনাইজেশন’ হয়নি, তাই শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের জন‌্য স্তালিনকে ফিরিয়ে আনার কোনও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। স্তালিনের একনায়কতন্ত্র চিরকাল রাশিয়ায় ছিল। রাশিয়ার বাচ্চারা বরফের পাহাড় বানিয়ে ‘মাউন্টেন জার’ খেলা খেলে। একসঙ্গে সবাই দৌড়বে। যে আগে গিয়ে বরফের চূড়োয় গিয়ে দাঁড়াতে পারবে, সে হবে পাহাড়ের ‘জার’ (Tsar)।

প্রাক্তন কেজিবি-কর্তা পুতিন এভাবেই রাশিয়া ও বাইরে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। লেখক বলছেন, একবার বিদেশে এক ট‌্যাক্সিচালক রুশ ভাষা শুনে সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলেন- পুতিন! তারপরই থাম্বস আপ দেখান। এই ট‌্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে পুতিন যেন এক দেবতা, গডফাদার!

লেখক যদিও বলছেন, এখন এই দীর্ঘ যুদ্ধের পর শুধু পশ্চিমেই নয়, রাশিয়াতেও পুতিন খলনায়ক হয়ে উঠেছেন। তিনি খ্রিস্টান নৈতিকতা, রক্ষণশীল সংস্কৃতির পক্ষে, শক্তিশালী রুশ জাতীয়তাবাদের পক্ষে। তারপর পৃথিবীতে একের-পর-এক দেশ দখল করে বিশ্বে আরও বড় এক ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে উঠবেন এমন ছিল প্রত‌্যাশা। কিন্তু এখনও পুতিন ইউক্রেনের উপর চূড়ান্ত বিজয়প্রাপ্তি ঘটাতে পারেননি। উলটে ছোট দেশ হয়েও ইউক্রেন ছলে-বলে-কৌশলে বিশ্বের জনমত প্রাপ্ত করছে। দেশের ভিতর যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে। তাই রাশিয়ায় পুতিনের কর্তৃত্বের অবক্ষয় ঘটছে।

[আরও পড়ুন:  ‘গুগাবাবা’র হিন্দি করতে চেয়ে গুলজারকে ডেকেছিলেন সত্যজিৎ রায়]

তবে কি সেই কারণেই ড্রোন আক্রমণের কাহিনি? রাশিয়ার ‘ভিক্টিম স্টেটাস’ পাওয়ার চেষ্টা? মূল প্রশ্নটি অবশ্য সংস্কৃতি ও সভ‌্যতার সংকটের। রাশিয়া আর ইউক্রেনের মানুষের মধ্যে এই সাংস্কৃতিক বিভাজনে লাভ কার? আমাদের দেশেও যেমন ‘অহম’ বনাম ‘বাঙালি জাতি’ সংঘাত আসলে মানবিকতার বিরুদ্ধে। পৃথিবীর সর্বত্রই এই বিভাজনকে ‘মুর্দাবাদ’।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
redhat.jayanta@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement