পাঁচ বছরের শিশুকে ‘শিক্ষা’ দিতে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হল পিঁপড়ের ঢিপির উপর। শিশু-নির্যাতনের ভয়াল রূপ নদিয়ার শান্তিপুরে।
সারা পৃথিবীতে লক্ষ-লক্ষ শিশু প্রত্যহ নির্যাতিত হচ্ছে কোনও-না-কোনওভাবে। এবং এসব নির্যাতিত শিশুকে নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন’-এর (হু) ভাবনাচিন্তারও শেষ নেই। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। জগৎজুড়ে শিশু নির্যাতন যেন বেড়েই চলেছে। সত্যি বলতে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কোনও সময় বা কাল নেই, যে-সময়, যে-কালে নানাভাবে শিশু-অত্যাচার সমাজ-সংসারে ছাপ ফেলেনি, নিদর্শন রেখে যায়নি।
গ্রিক সভ্যতায় শিশুদের উপর যৌন-অত্যাচার দেখা দিয়েছিল পুরুষ-আভিজাত্যের রূপ নিয়ে। স্বয়ং প্লেটো অভিজাত ধনী পুরুষদের উপদেশ দিয়েছিলেন সেবাদাস করে বালকভৃত্য পালন করার। যেসব সভ্য দেশে ক্রীতদাস প্রথা চালু ছিল, সেই সমাজে ক্রীতদাস-দাসীর শিশুসন্তানদের উপর কী অনাচার-অত্যাচার চালু ছিল, তা এখন আমরা ভাবতেও পারি না। যেমন, আমরা অনেক সময় ভাবতে পারি না, বা ভাবতে চাই না, অনেক অনাথ আশ্রমেই কত অবহেলায়, অযত্নে, অপমানে এবং কতরকমের অত্যাচার সহ্য করতে-করতে শিশুরা বড় হচ্ছে। ‘ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন’ কতভাবে শিশুরা অত্যাচারিত হয় সভ্য সমাজে, তার দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেছে। শিশুদের উপর কোনও অত্যাচার শারীরিক, তো কোনও নির্যাতন মানসিক। অযত্নের অত্যাচারও শিশুর মনের উপর রেখে যায় চিরকালীন ছাপ।
অবহেলাও শিশু-নির্যাতনের আরেক নিদর্শন। চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ডেভিড কপারফিল্ড’-এ ডিকেন্স ফুটিয়ে তুলেছেন অনাথাশ্রমে বড় হয়ে ওঠা শিশুদের উপর বিচিত্র মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের বাস্তব ছবি। ধনীগৃহে অভিজাত অবহেলায় বড় হয়ে ওঠার গল্প প্রায় সবাই পড়েছি রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থে– স্মৃতিচারণে শিশু রবীন্দ্রনাথের মা থেকেও নেই, তিনি বড় হচ্ছেন মাতৃস্নেহ থেকে অনেক দূরে, দাস-দাসীদের মহলে। যাঁরা বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক ইয়ান ম্যাকুয়ান-এর ‘চিলড্রেন অ্যাক্ট’ উপন্যাসটি পড়েছেন, তাঁরা আন্দাজ করতে পারবেন– আধুনিক পৃথিবীতে শিশু-নির্যাতন এবং সেই নিয়ে আইনি সমস্যা কোন জটিল পথে সমাজ-সংসারের নিত্য পরিসরে ছড়িয়ে পড়ছে।
একটি সাম্প্রতিক ঘটনার সূত্রে শিশু-নির্যাতনের প্রাত্যহিক বাস্তব ভয়ংকর রূপে দেখা দিল। এবং আমাদের শিউরে উঠতে হল। ঘটনাটি এই: খেলতে-খেলতে একটি পাঁচ বছরের গরিব ঘরের শিশু পাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। শিশুটি নাকি মশকরা করেছিল প্রতিবেশী যুবকের সঙ্গে। তারই ‘শাস্তি’ হিসাবে হাত-পা বেঁধে শিশুটিকে পিঁপড়ের ঢিপির উপর ফেলে আসে ওই যুবক। শিশুটিকে তার মা খুঁজে পায় সন্ধেবেলা। নদিয়ার শান্তিপুরে ঘটে এই ভয়াবহ ঘটনা। শিশুটির চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে। একটি পাঁচ বছরের শিশুকে এইভাবে নির্যাতন করতে পারে যে বিকৃত-মানসিকতার যুবক, তার উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণ করতে শিশু-রক্ষার কোন আইন, কোন বিচারক, কোন বিচারালয়– কে দাঁড়াবে ওই গরিব শিশুর পাশে?