‘এসআইআর’-এর ফর্ম ফিল আপের ভয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে কেউ কেউ। কিন্তু এই ফর্ম কি পারবে আত্মপরিচয়ের সংকট কাটাতে?
দেশ জুড়ে এই মুহূর্তে ‘এসআইআর’-এর ফর্ম ফিল আপের ব্যাপারটা ছড়িয়ে দিচ্ছে ত্রাস। এই ভয় এমনই ভয়ংকর যে, মানুষ এই ভয় থেকে পালাতে বা বঁাচতে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। অথচ এই সমাজ ও সভ্যতায় বেঁচে থাকতে কতরকমের ‘ফর্ম’-এর বুকজোড়া ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর আমরা আজীবন দিয়ে চলেছি! ফর্ম-ভরানোর গুরুত্ব, আবশ্যিকতা এবং অনিবার্যতা প্রসঙ্গে একটু গভীরভাবে যদি ভেবে দেখি, বুঝতে কি খুব অসুবিধে হয়, যত জটিল হচ্ছে আমাদের জীবন ও সভ্যতা, যত বহুস্তরী হচ্ছে আমাদের যাপন ও সামাজিক অস্তিত্ব, ততই যেন প্রয়োজনীয়তা বেড়ে চলেছে ফর্ম-ভর্তি করে যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য কখনও সরকার, কখনও দেশি-বিদেশি সংস্থা এবং আইনের হাতে তুলে দেওয়া।
যেই কোনও কারণে একটি ফর্ম এল আমাদের হাতে, সেই সঙ্গে এল এই কঠোর-কঠিন আজ্ঞাও– আপনার সম্বন্ধে ফর্মের প্রশ্নগুলির উত্তর লিখে জানান। এক-এক কাজের জন্য এক-এক ফর্ম। এবং ফর্মের আদেশ পালন করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। এবং ফর্ম ফিল আপের কাজটি কারও পক্ষেই খুব সুখকর নয়। সত্যি বলতে, যে কোনও রকমের ফর্ম ভরানোর কাজ কোনও না কোনওভাবে আমাদের মধ্যে তৈরি করে মানসিক চাপ। বেশিরভাগ ফর্মের সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর, যে-মানুষটিকে বলা হচ্ছে ফর্ম ভর্তি করতে, তার, একমাত্র তারই জানার কথা। তবু পৃথিবীতে এমন কোনও ফর্ম আছে কি, যা ভরতে মন আনন্দে উথলে ওঠে? বরং যে কোনও ফর্ম ভর্তির কাজ ভয় না-ডেকে আনুক, বিরক্তি তো ডেকে আনেই। অথচ প্রতিদিনের সব জরুরি কাজই যেন ফর্মের শিকলে আবদ্ধ। আমাদের সমস্ত অস্তিত্বটাই ফর্ম-নির্ভর।
এই ‘ফরম্যালিটি’-র বাইরে পা ফেলার উপায় নেই। এমনকী পৃথিবীতে আসা এবং পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া, তার জন্যও প্রয়োজন বার্থ এবং ডেথ রেজিস্ট্রেশনের কাগজ। এত যে ফর্ম আজীবন ভর্তি করে চলেছি, তার মোদ্দা কথাটা কী? আসল কথাটা হল, আমি কে– তা জানানো। আমি কে? অর্থাৎ আমার নাম কী? ঠিকানা কী? বাবা-মায়ের নাম কী? কোথায়, কোন তারিখে, কোন সালে জন্ম আমার? কোথায় আদি বাড়ি? অর্থাৎ শিকড় কোন মুলুকের? এভাবে ব্যক্তিগত খেঁাড়াখুঁড়ি করতে-করতে এক-এক ফর্ম এক-এক পথে কত গভীরে যে ঢুকতে পারে, তার কোনও শেষ নেই। বিদেশে যেতে গেলে দরকার ভিসা-র। ভিসা পেতে ব্যাঙ্কে কত টাকা, মাসে কত উপার্জন– তা-ও যেমন জানাতে হয়, জানাতে হয় জীবনের এমন কিছু খুঁটিনাটি, যা প্রকাশ করতে অস্বস্তি হতেই পারে! সব ফর্মের আজ্ঞা অবশ্য একটাই– জানাও তুমি কে?
এই আজ্ঞা পালন করার চাপ সবসময় সহ্য করা সহজ হয় না। ‘আমি কে?’ এ কি সহজ প্রশ্ন? এই প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণর একটি সার কথা মনে আসতে পারে: “হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি, এর কোনটা আমি? সেইরূপ বিচার করলে ‘আমি’ বলে কিছুই পাইনে” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ: ব্রহ্মানন্দ)। পৃথিবীর কোনও ‘ফর্ম’ আত্মপরিচয়ের এই সংকট ও ঘোষণা কি গ্রহণ করবে?
