shono
Advertisement
BLO

‘দায়িত্ব’ ও তা ‘নির্বাহ’ করার মাঝের ফাঁক

রাজ্যের ৮১ হাজার ‘বিএলও’-র মধ্যে রয়েছেন আইসিডিএস কর্মী, পার্শ্বশিক্ষকরা।
Published By: Kishore GhoshPosted: 09:45 PM Nov 25, 2025Updated: 09:45 PM Nov 25, 2025

রাজ্যের ৮১ হাজার ‘বিএলও’-র মধ্যে রয়েছেন আইসিডিএস কর্মী, পার্শ্বশিক্ষকরা। যাঁদের ‘সরকারি চাকুরে’ বলা যায় না। তাঁরা সরকারি চাকুরির অন‌্যান‌্য সুযোগ-সুবিধা পান না। কেন তাহলে এই চাপের কাজ করবেন? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী। 

Advertisement

‘এসআইআর’ আবহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সদ্য ভোটে জয়ী নিউ ইয়র্কের ভারতীয় বংশোদ্ভূত তরুণ হবু মেয়র জোহরান মামদানির সাক্ষাৎকারটি বেশ নজর কাড়ল। কে বলবে, মাত্র কয়েক দিন আগে এই মুসলিম যুবককে ‘জিহাদি কমিউনিস্ট’ তকমা দিয়ে ট্রাম্প দেশছাড়া করার হুমকি দিয়েছিলেন! ভোটে জেতার পর ট্রাম্পকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিতেও ছাড়েননি মামদানি। প্রচারে বারবার তিনি ট্রাম্পকে ‘স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিয়েছেন। অথচ হোয়াইট হাউসে দু’জনকে দেখে মনে হল যেন শিক্ষক ও ছাত্র। বসে থাকা ট্রাম্পের পাশে বিনীত শিষ্যের মতো দঁাড়িয়ে আছেন মামদানি। এর চেয়েও দেখার মতো হল– দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য। যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভাইরাল’। সাংবাদিকরা মামদানির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি ট্রাম্পকে এখনও ‘ফ্যাসিস্ট’ মনে করেন কি না। কী উত্তর দেবেন ভাবছিলেন অস্বস্তিতে পড়ে যাওয়া মামদানি। ট্রাম্প অবলীলায় দূর করলেন মামদানির অস্বস্তি। তঁাকে বললেন, “সমস্যা নেই, আপনি ‘হ্যঁা’ বলতে পারেন। কোনও কিছু ব্যাখ্যা দেওয়ার চেয়ে এটা বলা সহজ।”

আমেরিকার পথেঘাটে এখন ট্রাম্পের গায়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ তকমা লাগিয়ে সমালোচনা চলছে। মামদানি নিজেই এই ট্রাম্প-বিরোধী প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছেন। সেই মামদানিকে পাশে দঁাড় করিয়ে ট্রাম্প যেভাবে রাজনৈতিক বিরোধকে নিয়ে রসিকতা করতে পারলেন, তা কিন্তু গণতন্ত্রের সহনশীলতার পরিচয়কেই তুলে ধরল। যে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে এই সহনশীল মনোভাবই দাবি করে, সেটাই বুঝিয়ে দিল ছোট্ট এই ঘটনাটি। আমাদের মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছেও এই সহনশীলতা শিক্ষণীয়। এই মনোভাব শুধু নেতাদের পোষণ করার বিষয় নয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে গেলে সাধারণ মানুষকেও এই সহনশীল মানসিকতার অনুশীলন করতে হবে। সমাজমাধ্যমের দৌলতে এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক ইসু‌্যতে সাধারণ মানুষের সহনশীলতার অভাব প্রকট হয়ে যায়।

এসআইআর-এর প্রেক্ষিতে ‘বিএলও’দের সংকট নিয়ে সমাজের একটা অংশ যে-মনোভাব প্রকাশ করছে, তা এই সহনশীলতার অভাবের একটি বড় দৃষ্টান্ত। বিএলওদের ‘অাত্মঘাতী’ হওয়া বা ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়া নিয়ে কাউকে-কাউকে কটাক্ষ করতে দেখা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে এইটুকু কাজের চাপ কেন বিএলও-রা নিতে পারবেন না! অাসলে যঁারা এই নিয়ে পাল্টা অাক্রমণে নামছেন, তঁারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সমস‌্যাটিকে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছেন। ভোটের অাগে কেন মাত্র তিন মাস সময় হাতে নিয়ে নির্বাচন কমিশন এই বিশাল অভিযানে নামল– সেই মৌলিক প্রশ্নটির উত্তর অাগে তঁারা দাবি করতে চাইছেন না।

‘নোটবন্দি’ বা ‌‘লকডাউন’-এর মতোই ‘এসঅাইঅার’ একটা অভিজ্ঞতা। এর অাগে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন হলেও এইরকম এসঅাইঅার অতীতে কখনও দেখা যায়নি। ২০০২ সালের যে এসঅাইঅার-এর কথা প্রতি মুহূর্তে উল্লেখ করা হচ্ছে, তা যখন হয়েছিল, তখন কেউ টেরই পায়নি। সেবার এনুমারেটররা জাবদা খাতা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাম নথিভুক্ত করেছিলেন। যেভাবে জনগণনার কাজ হয়ে থাকে অনেকটা সেই পদ্ধতিতে। এবার একদিকে যেমন ভোটারদের জটিল ফর্ম পূরণ, ছবি তোলার বিষয় রয়েছে– তেমন অাছে প্রযুক্তির ব‌্যবহার। অতীতের কাজের সঙ্গে যে কোনও তুলনাই চলে না তা বলা বাহুল‌্য। অথচ ২০০২ সালে কাজটা হয়েছিল কার্যত দু’-বছর ধরে। ধীরে-সুস্থে। সে-সময় দুয়ারে কোনও ভোটও ছিল না।

‘এসঅাইঅার’-এর কাজটা বাংলার ভোটের মুখে দ্রুত সেরে ফেলার নেপথ্যে যে বিজেপির ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ‌্য’ রয়েছে, তা নিয়ে এত দিন বাদে বিতর্ক করার কোনও অবকাশই নেই। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি সরকারের সাধারণ কর্মীদের এভাবে বিপাকে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে তা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই। প্রায় ৮১ হাজার ‘বিএলও’-র মধে‌্য রয়েছেন অাইসিডিএস কর্মী ও পার্শ্বশিক্ষকরাও, যঁাদের কোনওভাবে ‘সরকারি চাকুরে’ বলা যায় না। কৃষ্ণনগরের অাত্মঘাতী বিএএলও তঁার মর্মস্পর্শী সুইসাইড নোটে জানিয়েছেন, তিনি সামান‌্য বেতনের পার্শ্বশিক্ষকের কাজ করেন। বিএলও-র দায়িত্ব তঁার ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যঁারা পুরোদস্তুর সরকারি কর্মী নন, সরকারি চাকুরেদের মতো বেতন ও অন‌্যান‌্য সুযোগ-সুবিধা পান না, তঁাদের কেন এই চাপের কাজ করতে হবে? ‘জব হ‌্যাজার্ড’ বলে যেমন একটি শব্দ অভিধানে রয়েছে– তেমন সরকারি বিধিতে এটাও বলা রয়েছে– চাকরির সমস‌্যার দিকগুলি তঁারা-ই বহন করবেন, যঁারা এর সুযোগ-সুবিধাগুলোও ভোগ করেন। মালবাজারে যে বিএলও অাত্মঘাতী হয়েছেন তিনিও পুরোদস্তুর সরকারি চাকুরে নন। তিনিও একজন অাইসিডিএস কর্মী।

এক-একজন বিএলও-র গড়ে ৩০০টি বাড়িতে দু’বার করে ঘোরা, বিডিও অফিস থেকে ফর্ম নিয়ে এসে তা বিলি করা, যাচাই করে জমা নেওয়া, তারপর সেই ফর্ম মোবাইল অ‌্যাপের মাধ‌্যমে অাপলোড করা– সবমিলিয়ে মাত্র ৩০ দিনের পক্ষে এই কাজ যথেষ্ট বেশি। এর সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে রয়েছে রাজনৈতিক সমস‌্যা। ভুল হলে অাধিকারিকের বকাঝকা রয়েছে। শোকজের চিঠি অাছে। সর্বোপরি জেলে ঢোকানো হবে লাগাতার ভয় দেখানো হচ্ছে। এরপরেও বিএলও-রা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন অ‌্যাপ নিয়ে। যার দায়িত্ব পুরোপরি নির্বাচন কমিশনের। অধিকাংশ সময়ে নাকি সেই অ‌্যাপ ঠিকমতো চলছে না। এই অবস্থ‌্ায় যদি কোনও বিএলও-র প্রেশার বা ব্লাড সুগার বেড়ে যায় কিংবা ‘প‌্যানিক অ‌্যাটাক’ হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই ধরনের কাজে যেমন সবার দক্ষতা সমান হয় না, তেমনই সবার স্নায়ুশক্তিও একরকম হয় না। কার, কীরকম শারীরিক অবস্থা তা বিচার করে যেমন কাজ দেওয়া সম্ভব নয়– তেমনই যঁারা সমস‌্যায় পড়ছেন– তঁাদের নিয়ে কটাক্ষ করারও সুযোগ নেই। সেই কাজ যঁারা করছেন, চরম অসংবেদনশীলতা ও নির্মমতার
পরিচয় দিচ্ছেন।

বিএলও-দের দুর্দশা দেখে দলমত নির্বিশেষে সবারই উচিত ছিল নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রশ্ন করা, কেন এত অল্প সময়ে এই বিপুল পরিমাণ কাজ হবে? কেন অারও প্রস্তুতি এবং পরিকাঠামো নিয়ে এই কাজ করা হবে না? শুধু বাংলা নয়, অন‌্যান‌্য রাজে‌্যও এসঅাইঅার-এর চাপে বিএলও-র মৃতু‌্যর ঘটনা ঘটেছে। কেন একটিও মৃতু‌্যর ঘটনা ঘটবে? কে এই প্রাণের দাম দেবে? অথচ সেটা হচ্ছে না। এটা খুবই দুর্ভাগে‌্যর। এই রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাবই অামাদের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • আমেরিকার পথেঘাটে এখন ট্রাম্পের গায়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ তকমা লাগিয়ে সমালোচনা চলছে।
  • অধিকাংশ সময়ে নাকি সেই অ্যাপ ঠিকমতো চলছে না।
Advertisement