‘এসআইআর’ মানে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সমীক্ষা। খুব ভাল কথা। হোক না। সেটা নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে! ২০০২ সালেও ‘এসআইআর’ হয়েছিল। কাকপক্ষী জানতে পারেনি। রাজনৈতিক নেতাদের মতো ছটপুজোর অভিনন্দন জানিয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার প্রেস কনফারেন্স করেননি। সেবার ‘স্পেশাল’ কথাটাও ছিল না। এবার যুক্ত হয়েছে। ফারাক এটুকুই। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
নিজেকে অবিশ্বাস করব ভাবিনি। সাবধানের মার নেই। তাই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে। অফিসে সাংবাদিক সহকর্মী সাইটটি খুলে আমার লোকসভা, বিধানসভা, পুর ওয়ার্ড পেরিয়ে পাড়ার বুথ পর্যন্ত পৌঁছে দিল।
সামনে ২০০২ সালের ভোটার তালিকা। ভয়ে ভয়ে ক্লিক করলাম। ওই তো আমার নাম, পরিবারের সবার নাম। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর চলে গেল। তাহলে ‘অনাগরিক’ হয়ে যাইনি!
আমাদের সময়ে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টকে ‘গেজেট’ বলা হত। ফলপ্রকাশের পর যিনি সেটি হাতে নিয়ে স্কুলের কাছে আসতেন, তাঁকে সবাই ঘিরে ধরত। অাগে ফল জানতে হুড়োহুড়ি। পরীক্ষাথর্থীদের মুখে চাপা টেনশন। তাদের বাবা-মায়ের চোখে উৎকণ্ঠা। কী হয়, কী হয়! শেষ পর্যন্ত রেজাল্ট শুনে স্বস্তি। যে যেমন ডিভিশন পেত তেমনই দক্ষিণা চাইত গেজেট বাহক। খুশি মনে সবাই দিয়ে দিত।
অামিও তেমন স্বস্তি পেলাম তালিকায় নিজের নাম দেখে। ‘বন্ধু’ সাংবাদিকটি এক কাপ চায়েই খুশি। নাম অাছে দেখে যেন যুদ্ধজয়। এও মনে হল, নাম থাকবে নাই বা কেন, নিজের প্রতি এত অবিশ্বাসী কেন হয়ে পড়েছিলাম। এ-দেশীয় আমরা। সাতপুরুষের ভিটে। বললেই হবে আমার ভোটের অধিকার নেই! মামদোবাজি নাকি!
মনের আর দোষ কী! সাধারণ মানুষকে কনফিউজ করেই চলছে কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক পদক্ষেপ। একটি সুস্থ সরকারের কাজ কী? ন্যূনতম লক্ষ্য, মানুষের অধিকার সুরক্ষিত রাখা। নাগরিক পরিষেবার সুযোগ সবাইকে দেওয়া। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান নিশ্চিত করা। স্কুল-কলেজ ঠিকঠাক চলার ব্যবস্থা করা। চাকরি, কমর্সংস্থানের পথ তৈরি রাখা। এবং অাইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। দুভার্গ্য আমাদের, দেশের সরকার মাঝে মাঝেই সাধারণ মানুষের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। বিগত সাত-আট বছর ধরে ঘুরেফিরে সেই এক লাইন। কে নাগরিক আর কে নয়। নাগরিকত্ব প্রমাণে বারংবার নোটিসে আমজনতার ওষ্ঠাগত প্রাণ।
নানা মোড়কে শুধু অধিকার কাড়ার চোখরাঙানি। বাবার বাবার বার্থ সাটিফিকেট অাছে কি না, আমি জানব কী করে! বলতে তো পারবে ব্রিটিশ ভারতের সরকার! কে বোঝাবে তাদের।
‘নাগরিকত্ব’ সংক্রান্ত খঁাড়া ঝুলেই অাছে। কখনও এনআরসি, কখনও সিএএ, এখন এল এসআইআর। লক্ষ করে দেখুন, সব আসে ঠিক ভোটের আগে। উদ্দেশ্য: ভোট আর ভোট। বহু মানুষ ভয় পেয়ে যায়। এই বুঝি ভোটার লিস্ট থেকে নাম কেটে গেল! আধার কার্ড বাতিল হয়ে গেল! রেশন কার্ড কেড়ে নেওয়া হল!
এক বছর আগে লোকসভা নির্বাচন হয়ে গেল। ৬৪ কোটি মানুষ ভোট দিল। আমিও দিলাম। আমার ভোটে একজন সাংসদ নিবাচিত হলেন। ৫৪৩ জন সাংসদ জিতে এলেন। সরকারি দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হলেন। বিরোধী দলের বেঞ্চ তৈরি হল। গঠিত হল ভারতীয় গণতন্ত্রের স্তম্ভ লোকসভা। এক অনিন্দ্যসুন্দর বৈচিত্র। ভারতই পারে। সবই এক একটি ভোটের অবদান।
যারা ভোট দিয়েছিল, তাদের সবার নাম ভোটার লিস্টে ছিল। অথচ এখন বিধানসভা ভোটের মুখে বলা হচ্ছে, সেই ভোটার তালিকাই শেষ কথা নয়। ২০০২ সালের তালিকায় যদি নাম না-থাকে তা হলে তুমি ‘ভোটার’ নও। তাহলে তো দিল্লির সরকারটাই বৈধ নয়।
আপনি ভোটের অধিকারী কি না তা প্রমাণ করতে হবে কমিশনের নয়া ফরমানে। মানুষের কি কাজ নেই? জীবনসংগ্রামে সবাই ব্যস্ত। তার মধ্যে প্রতিদিন ভোটার কি না তার পরীক্ষায় বসতে হবে। ঠান্ডা ঘরে বসে হুকুম জারি করলেই হল! মানুষের নতুন করে ভয়, ভোটার যখন নও তখন বলা হতেই পারে, নাগরিকও নও! হাতে যতই থাক ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, কিচ্ছু যায় আসে না, তুমি ভারতীয়ই নও। ক্রেনে করে তুলে ফেলে দেওয়া হতে পারে বাংলাদেশে।
মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা না করেই ঠান্ডা ঘরে বসে ঘোষণা করে দেওয়া হল। প্রতিদিন জীবনযুদ্ধে যারা লড়াই করছে, তাদের খবর রাখে কি নির্বাচন কমিশন? যে-মানুষটি ট্রেনে বাদাম বিক্রি করে সংসার চালায়, যে পেটের জ্বালা মেটাতে ভোররাত থেকে পঁাচটা বাড়িতে বাসন মাজে, যাকে সংসার চালাতে মুম্বইয়ে গিয়ে সোনার কাজ করতে হয়, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য যাকে মহাজনের কাছ থেকে ধার করতে হয় অথবা যার ঘর হড়পা বানে তলিয়ে গিয়েছে, তার কাছে রাষ্ট্র নাগরিকত্ব প্রমাণের কাগজ চায় কোন লজ্জায়? কেন প্রান্তিক মানুষকে প্রতিদিন প্রমাণ করতে হবে সে নাগরিক। মনে রাখা উচিত– এদের কারও ঘরে কমিশনকে খুশি করার মতো ডকুমেন্ট সংরক্ষিত থাকে না। থাকা সম্ভব নয়।
অামাদেরই থাকে না। এমনিতেই পকেটে জমেছে কার্ডের পাহাড়। রেশন কার্ড, এপিক কার্ড, আধার কার্ড, প্যানকার্ড। জীবনের নানা ধাপে এই কার্ডগুলি পেয়েছি। কোনওটা শিশুকালে, কোনওটা ১৮ বছর বয়স হওয়া ইস্তক, কোনওটা আবার যৌবনে। একটু বেশি বয়সে পেলাম পাসপোর্ট। তাতে আবার আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবি সংরক্ষিত। এটি হাতে পাওয়ার পর ভেবেছিলাম– বিদেশে গেলে যখন ‘ভারতীয়’ বলে এটিই একমাত্র পরিচয়পত্র, তখন সব কার্ডের সেরা সেটা। বাস্তবে তাও নয়। ফলে জানি না আর কী-কী কার্ড এখনও চালু হওয়া বাকি অাছে। কী ধরনের কার্ড করতে হবে ভবিষ্যতে। আসলে রাষ্ট্র নিজেই জানে না আমাকে ‘নাগরিক’ দেখতে কোন কার্ডটি উপযুক্ত। এই কার্ডগুলি যেদিন হাতে দেওয়া হয়েছিল, বলা হয়েছিল এটা আছে মানেই তুমি ভারতীয়, ভোট দিতে গেলে দেখালেই হবে। কালক্রমে কার্ড বাড়তে থাকে। যেমন: ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড। এই সব কিন্তু মিলেছে ভারতীয় নাগরিক প্রমাণপত্র দাখিল করে। মানে অাধার কার্ড, প্যানকার্ড দেখিয়েই।
এখানেই শেষ নয়, আরও অজস্র কার্ড আছে। মেট্রোয় উঠতে কার্ড, শপিং মলের কার্ড, অফিসে প্রবেশে কার্ড ইত্যাদি। সাংবাদিক হিসাবে আমার একটি মোক্ষম সরকারি কার্ডও আছে। সেটিকে বলে ‘গভর্নমেন্ট অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড’। এটি দেখালে এয়ারপোর্টে সিআইএসএফ জওয়ানরা এককথায় ঢুকতে দেন ভিতরে। তার মানে এই পরিচয়পত্রের গুরুত্ব অাছে।
তাহলে কী দাঁড়াল, আমার পরিচয়পত্র ক’টি? সোজা কথায়, অগুনতি। তবু আমাকে ‘এসআইআর’-এর গুঁতোয় ২০০২ সালের ভোটার তালিকা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হল। অনেক দুশ্চিন্তা করতে হল। শেষে নামটি দেখার পর স্বস্তি পেলাম। মনে হল, এই যে বলা হয় ‘এক দেশ এক ভোট’, ‘এক দেশ এক রেশন’, তা হলে কেন ‘এক দেশ এক কার্ড’ বলা হবে না? মানুষ একটু রেহাই পায়।
‘এসআইআর’ বা ‘স্পেশাল আইডেনটিটি রিভিশন’ আসলে কী? অনেকেই কিন্তু বুঝতে পারছে না। প্রচুর ফোন পেয়েছি। ঠিক কী করতে হবে, সেই নিয়ে। একজন বললেন, আমি তো বিদেশে, ফিরতে দেরি হবে। কমিশনের লোক এসে দেখবে ঘরে তালা। তাহলে কী হবে! অামার নাম থাকবে তো? উত্তর দিতে পারিনি। যারা ভোট দেয়, তারা বুঝতে পারছে না কেন অাবার নাম আছে কি না দেখতে হবে।
বস্তুত, ভোটার তালিকায় সংশোধন-পরিমার্জন একটি নিবিড় প্রক্রিয়া। সবসময় চলতে থাকে। নির্বাচনের আগে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়। সেই তালিকা অনুয়ায়ী ভোট হয়। ‘এসআইআর’ মানে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সমীক্ষা। খুব ভাল কথা। হোক না। সেটা নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে! ২০০২ সালেও ‘এসআইআর’ হয়েছিল। কাকপক্ষী জানতে পারেনি। রাজনৈতিক নেতাদের মতো ছটপুজোর অভিনন্দন জানিয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার প্রেস কনফারেন্স করেননি। সেবার ‘স্পেশাল’ কথাটাও ছিল না। এবার যুক্ত হয়েছে। ফারাক এটুকুই। ভুয়া ভোটার বাদ যাক, ‘অনুপ্রবেশকারী’-র নাম থাকলে বাদ যাক। কে বাধা দিয়েছে!
অযথা আতঙ্ক ছড়ানো কেন? বিহারে লক্ষ-লক্ষ নাম বাদ যাওয়ার পর মানুষের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছে। এবার বাংলায় দু’মাসে এই কাজ শেষ হবে। কত দূর হবে কে জানে। ঝাড়াই-বাছাই চলছে। স্বাধীনতার ৮৮ বছর পরও মানুষের নাগরিক হওয়ার যন্ত্রণা থেকে সতি্যই মুক্তি নেই।
