গ্রামের দেওয়ালজুড়ে শিশু-কিশোরদের জন্য আঁকা শিক্ষামূলক ছবি ও ইতিহাসের পাঠ। মোল্লাহাটি নিজেই হয়ে উঠেছে আস্ত ‘ইশকুল’!
উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর মোল্লাহাটি গ্রাম। একেবারে ‘খুদে গ্রাম’ বলতে যা বোঝায়, মোল্লাহাটি তাই। বড়জোর শ’তিনেক পরিবার রয়েছে। গরিব পরিবার। বেশিরভাগ আদিবাসী। খুপরি ঘরের মাটির বাড়িতে বাস। কোনওটির মাথায় টিনের চাল, কোনওটির চাল টালির। বাড়ি বলতে মাটি-লেপা পাটকাঠির ফঁাকফোকরওলা মাথা গোঁজার জায়গা। গ্রামের সম্বল বলতে কিছু ঝোপজঙ্গল, কয়েকটা পুকুর আর ডোবা। বাসিন্দারা অধিকাংশই দিনমজুর, খেতমজুর। কেউ-কেউ আবার খুপরি-খুপরি দোকানের মালিক। তবে এসব দিনমজুর, খেতমজুর, দোকানদারের মাঝে জনাদশেক সরকারি চাকুরেও আছেন।
এঁরা দেখেছেন শহর ও শিক্ষার আলো। এঁদের পরিবারের তরুণ-তরুণীরা শহরে লেখাপড়া করে মোল্লারহাটিতে ফিরে এসে তঁাদের ছোট্ট গ্রামে শিক্ষার আলো জ্বালতে চাইছেন এক অভিনব উপায়ে। দশ-বারোজন শিক্ষিত তরুণ-তরুণী রং-তুলি সম্বল করে গ্রামজুড়ে মাটির বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে এঁকে চলেছেন বিচিত্র শিক্ষার বার্তাবাহী ছবি। সুদক্ষ সৃজন। ফলে ছোট দরিদ্র গ্রাম মোল্লাহাটি এখন চোখভোলানো ছবিগ্রাম। ছবিগুলি বোঝে ছোটদের মন, জানে ছোটদের ভাষা, আর খেঁাজ রাখে ছোটদের কী জানা-শেখা প্রয়োজন। ফলে সমস্ত মোল্লাহাটিই ক্রমশ হয়ে উঠেছে ‘ছোটদের ইশকুল’। দেওয়াল হয়ে উঠেছে মাস্টারমশাই। ফঁাকি দেওয়ার উপায় নেই। এই বর্ণময় শিক্ষাব্যবস্থায় নেই কোনও জবরদস্তি, শাসন-শাস্তি। পথ চলতে-চলতেই কত নতুন জিনিস জানতে পারা যায়! একপয়সাও খরচ নেই।
এমন লেখাপড়ার নেশায় ক্রমশ মজছে মোল্লাহাটির খুদেরা। বড়রাও খুশি। লেখাপড়ায় রুচি নেই বলে এত দিন বদনাম ছিল গ্রামটির। দেওয়াল ছবি সেই বদনাম মুছে দিচ্ছে ক্রমশ। ধরা যাক, একটা দেওয়ালে একটা ভারি সুদর্শন গাছের ছবি। কাছে গেলেই পাওয়া যাবে গাছটার সম্যক পরিচয়। কোনটা গাছের কাণ্ড গাছের মূল-ডাল, পাতা-ফুল– আলাদা আলাদা করে চিনিয়ে দিচ্ছে ছবি। খুদেদের বলে দিচ্ছে কতরকমের ফুল-ফল, পশু-পাখির নাম, তাদের পরিচয় জানাচ্ছে।
যারা একেবারে খুদে নয়, একটু বড় হয়েছে, তাদের মোল্লাহাটির ইতিহাস চেনাচ্ছে ছবি। নীলচাষের ইতিহাসের সঙ্গে কীভাবে মিশে আছে মোল্লাহাটির অতীত ও যন্ত্রণা, সব তুলে ধরেছে এই গ্রামের দেওয়াল-অঙ্কন। দেওয়াল ছবির ফঁাকে-ফঁাকে গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মহাপুরুষদের বাণী। যারা পড়তে জানে তারা পড়ে, যারা স্বাক্ষর নয়, তাদের জানিয়ে দিচ্ছে মহাপুরুষদের উপদেশ। বাণীগুলো এমনভাবে বাছা হয়েছে যাতে মনের অন্ধকার কাটে, মানুষ পেতে পারে পথ ও দিশা।
একটি ছবি সম্ভবত হয়ে উঠেছে সবথেকে প্রাণ ও প্রেরণাময়। ছবিতে স্বয়ং বিদ্যাসাগর একটি স্লেটের গায়ে ‘অ-আ-ই-ঈ’ লিখে গ্রামের বাচ্চা এবং বউদের করাচ্ছেন বর্ণপরিচয়। বনগঁা পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি জাফর আলি এবং বিডিও কৃষ্ণেন্দু বোস বলেছেন, মোল্লাহাটিতে শিক্ষা-প্রসারের এই প্রচেষ্টা অনবদ্য!