ফেসবুকে একটি নতুন ফিচার যোগ হতে চলেছে ‘থাম্বস ডাউন’। ফেসবুক কিন্তু এই থাম্বস ডাউন বাটনটিকে ‘অপছন্দের সূচক’ বলে দেগে দিতে নারাজ। কেন? লিখলেন অনুভা নাথ।
‘দুই ভাই’ সিনেমায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গানটি মনে পড়ে? ‘তারে বলে দিও, সে যেন আসে না আমার দ্বারে’। এই গানটিতে অদ্ভুত বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। আপাতদৃষ্টিতে এ গানের সুর আনন্দময় হলেও– লিরিক্স কিন্তু বেশ গম্ভীর। হেসে-হেসে শক্ত কথাগুলো বলা হয়ে চলেছে। অনেকটা যেন সোশাল মিডিয়ার ‘লাইক’, ‘ডিসলাইক’ বা ‘থাম্বস আপ’, ‘থাম্বস ডাউন’ বাটনের মতো। কারও প্রোফাইলের কোনও কিছু পোস্ট ‘পছন্দ’ বা ‘অপছন্দ’ হলেই ‘লাইক’, ‘ডিসলাইক’-এর মাধ্যমে মুখে কিছু না-বলে এভাবে নিজের মতামত জাহির করা, বা বলা ভালো, সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিটিকে অবলীলায় জানিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের ‘সেডিস্টিক প্লেজার’ আছে।
সম্প্রতি ফেসবুকে একটি নতুন ফিচার যোগ হতে চলেছে। সেটি হল ‘থাম্বস ডাউন’। ফেসবুক কিন্তু এই থাম্বস ডাউন বাটনটিকে ‘অপছন্দের সূচক’ বলে দেগে দিতে নারাজ। মার্ক জুকারবার্গের কথায়, এই থাম্বস ডাউনের সাহায্যে ফেসবুক স্প্যাম পোস্ট বা মেসেজ সহজে চিহ্নিত করতে পারবে। অর্থাৎ, কোনও একটি ‘কমেন্ট’ বা পোস্টে যদি বেশি মানুষ ‘উলটো কাঁচকলা’ দেখায়, তবে সেটিকে ফেসবুক সহজেই শনাক্ত করতে পারবে। কিন্তু ফেসবুক কর্তৃপক্ষ যা বলছে সেটাই কি নেটিজেনরা মানছেন, মানবেন? নাকি তাঁদের চিন্তাভাবনা ভিন্ন?
২০২৫ সালে আমাদের দেশে প্রায় ৪৯১ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন = ১০ লক্ষ) সক্রিয় সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারী অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৪ শতাংশ। দেশের তরুণ তুর্কিরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় ব্যয় করে! এত সুবৃহৎ জনসংখ্যা এবং তাদের এত-এত ভিন্ন মতামতকে এককথার সরলীকরণ করা সম্ভব নয়। মানুষের মনের তল পাওয়াও তো অসম্ভব!
আমার যে-বন্ধুটি একটু আগেই আমার সঙ্গে হেসে কথা বলে গেল, সে-ই একটু পরে ফেসবুকে আমার কোনও একটি পোস্টে থাম্বস ডাউন দিল! আবার উল্টোটাও সত্যি। অপরিচিত মানুষটি আমাকে রোজ দেখে, আমি হয়তো তাকে লক্ষ করি, কিংবা করি না। সে আমার সামনে এমন একটা ভান করে যেন আমাকে চেনে না, বা আমাকে তার চেনার গরজ নেই। কিন্তু ফেসবুক খুললে দেখা যাবে সেই মানুষটাই ঠিক উল্টো কাজ করছে! আমার প্রতিটি পোস্টে তার তীক্ষ্ণ নজর, এবং শুধু তাই নয়, সে হয়তো আমার অজান্তেই আমার পোস্টে ‘লাইক’ দিয়ে চলেছে! ফেক প্রোফাইল হলে তো কোনও কথাই নেই। এই যে বাস্তবের জমিনে ছদ্মবেশ, এই যে নিজেকে গোপন করা, সামনের মানুষটির কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখা, বা যা নয় সেটির অভিনয় করা– এটার কিন্তু লুকনো মজা আছে, আছে গোপন আনন্দ।
হোয়াটসঅ্যাপ তুলনায় অনেকটাই স্বচ্ছ। এখানে মেসেজ ফরওয়ার্ড হলে লেখা থাকবে। কে কে আপনার ‘স্টেটাস’ দেখল জানা যাবে। আবার মেসেজ ডিলিট করলেও লেখা থাকবে। কিন্তু এখানেও কবি কেঁদেছেন! এত স্বচ্ছতাও আবার কখনও কখনও কোন্দলের কারণ হয়। মেসেজ ‘সিন’ করার পর ‘ডিলিট’ কেন হল? আর মেসেজ ‘সিন’ করার আগেই ‘ডিলিট’ করা হল কেন? এই দুই জিজ্ঞাসার মধ্যে পড়ে মনের দোলাচল জাগেনি, আর সেই দোলাচল থেকে কম-বেশি রাগের সৃষ্টি হয়নি, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
এবার একটু ইউটিউব নিয়ে ভাবা যাক। ইউটিউব কিন্তু সরাসরি বলছে, তারা ‘ডিসলাইক বাটন’ চালু করেছে। এর উদ্দেশ্য জলের মতো পরিষ্কার। যে-ভিডিও ভালো লাগবে না সেটিকে সোজা ‘উলটো কাঁচকলা’ দেখিয়ে দাও! এর জন্য কোথাও জবাবদিহি করতে হবে না। অনেকটা ভোটবাক্সে ভোট দেওয়ার মতো ব্যাপার। আঙুলের একটা হালকা চাপ, ব্যস! তাতেই খুব সহজেই আমার ‘পছন্দ’ বা ‘অপছন্দ’ বলে দেওয়া গেল। তবে এত সহজেই ইউটিউবকে ক্লিনচিট দেবেন না। একটু ভাল করে লক্ষ করলে দেখবেন, ২০২১ সালের পর থেকে ইউটিউবে ‘ডিসলাইক’-এর সংখ্যা আর দেখানো হয় না। এটি সেন্সর করা হয়েছে। তবে ভিডিও-নির্মাতারা, ইউটিউবের কেন্দ্রীয় চ্যানেল পরিচালনা কেন্দ্র, ক্রিয়েটর স্টুডিওর সঙ্গে ডেটা অ্যাক্সেস করে জানতে পারে, তাদের ভিডিওয় ঠিক কতগুলো ‘লাইক’ বা ‘ডিসলাইক’ এল।
কিন্তু তাতে কী? আমি ‘ডিসলাইক’ দিলাম, অথচ সেটি এই কনটেন্টটিকে কী পরিমাণ আঘাত করল তার ফলাফল জানতে পারলাম না! বহুত না ইনসাফি হ্যায়। হিউম্যান সাইকলজি বলে, এই না জানতে পারার দুঃখে মানুষ ইউটিউবে কম প্রতিক্রিয়াশীল হয়, ‘ডিসলাইক’ দেওয়ার চেয়ে কোনও মতামতই না দেওয়া শ্রেয় মনে করে!
এত কথা যখন লিখলামই তখন ‘এক্স’ বাদ যায় কেন? ২০২৫ সালের পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর জনসংখ্যার ৭ শতাংশ মানুষ ‘এক্স’ ব্যবহার করে। ‘এক্স’-এর নিজস্ব অ্যালগরিদম আছে। সেটা বিশেষভাবে কতগুলো বিশেষত্বের উপর কাজ করে। কার্যকলাপ, অবস্থান, সর্বোপরি একজনের পরিচিত কাদের-কাদের অনুসরণ করছে তার উপর ভিত্তি করে অ্যাকাউন্ট ইন্টার্যাকশনের জন্য সাজেশন দেয়। ফলে ‘এক্স’ ব্যবহারকারী মনে করে যে সে ‘টার্গেটেড ইনডিভিজুয়াল’। কখনও কখনও এক্সকে শুধুমাত্র ‘ডিজিটাল কমপ্লেন’ নথিভুক্ত করার জন্যও নেটিজেনরা ব্যবহার করে থাকে। তাদের সাফ সাফাই, অফিসিয়াল ‘এক্স’ প্রোফাইলে অভিযোগ করলে কাজ হয় অবিশ্বাস্য গতিতে!
অর্থাৎ, সেই গোড়ার কথাতেই ফিরে যেতে হল, ‘তারে বলে দিও’ গানটির মতোই মানুষ এক্সেও স্ক্রল করছে অন্য কারণে, ভাবছে অন্য কথা এবং করছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজ! এই ‘ডিজিটাল ডিসগাইজ’ চলছে, চলবে। গোপন পছন্দ, অপছন্দের ধারাও বোধহয় মানুষের প্রয়োজন। এই অদ্ভুত মনস্তত্ত্বের মধ্য দিয়েই হয়তো মানুষ কোনও একদিন সৃষ্টি করবে নিজের ভিতরের অন্য কোনও সত্তাকে।
(মতামত নিজস্ব)
