২০১৫ সালের ঐতিহাসিক জয়ের পর থেকে দলকে ছাপিয়ে নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বহুত্ববাদ বিসর্জন দিয়ে দল হয়ে ওঠে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। একে একে ছেঁটে ফেলেন তাঁদের, যাঁদের বাড়ানো হাত ধরে, তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে নেমেছিলেন– গড়ে তুলেছিলেন ‘আম আদমি পার্টি’। পরিণতি এবারের ভোটে লজ্জাজনক হার।
হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের পরে দিল্লি দখল বিজেপির অন্ধ ভক্তদের কাছে ‘নরেন্দ্র মোদির জয়’ বলে আখ্যায়িত হচ্ছে। কিন্তু সত্যি হল, এবারের নির্বাচন অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তাঁরও রাজনীতির পক্ষে অথবা বিপক্ষে গণভোটের রূপ নিয়েছিল। আবগারি (মদ) মামলায় জামিন পেয়ে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর কেজরিওয়াল নিজেই সেই গণভোটের রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জনতার রায় নিয়ে ফের মুখ্যমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবেন। এই রায় তাই যতটা মোদির আবাহন, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি কেজরিওয়ালের বিসর্জন বলে চিহ্নিত থাকবে।
দিল্লিবাসী কেজরিওয়ালকে পরিত্যাগ করেছে, অথচ পাঁচ বছর আগেও তাঁর জন্য ঘরে ঘরে সাজানো ছিল বরণডালা। জনপ্রিয়তার এই নিম্নগামিতাই প্রমাণ, ব্যক্তি কখনও দল, সংগঠন ও আদর্শের চেয়ে বড় নয়। এই বিপর্যয় থেকে তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কারণ, পরাজয় সত্ত্বেও আম আদমি পার্টি (আপ) ৪৩.৫৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বিজেপির তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ কম। এর অর্থ এখনও তিনি প্রাসঙ্গিক। কেজরিওয়ালের বয়স মাত্র ৫৬। অন্তত আরও ২০ বছরের রাজনীতি তঁার অপেক্ষায় থাকছে। কাজেই তাঁর রাজনৈতিক শোকবার্তা লেখা শুধু অর্থহীন নয়, বোকামিও।
দিল্লির ভোটে অনেক কিছুই ঝলমল করছে। যেমন– টানা ২৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা সত্ত্বেও বিজেপির সমর্থন কখনও ৩২ শতাংশের নিচে নামেনি। ২০০৩ ও ’০৮ সালের নির্বাচনে তাদের ভোট শতাংশ ৩৫-এর উপরে ছিল। ২০১৫ সালে তা ৩২ শতাংশে নামে। পঁাচ বছর পর বেড়ে হয় সাড়ে ৩৮ শতাংশ। এবার ৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪৫.৮। ভোটের এই হার প্রমাণ করে রাজধানীতে তাদের সমর্থন সমীহ করার মতো।
তুলনায় কংগ্রেসের গ্রাফ? ২০০৩ সালের ৪৮ শতাংশ ২০০৮ সালে ৪০-এ নেমে এসেছিল। ২০১৩-এ আপের দৌলতে তা অর্ধেক হয়ে যায় ও ২০১৫-এ কমে দঁাড়ায় ১০ শতাংশের কম। ২০২০-এ মাত্র ৪.২৬ শতাংশ। সেখান থেকে এবার ২ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি আপের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে। ১৩টি আসনে তাদের প্রাপ্য ভোট আপের পরাজয়ের ব্যবধানের থেকে বেশি। একটি আসনে, কস্তুরবা নগরে, তারা দ্বিতীয় হয়েছে। সেখানে আপের ভোট তাদের কাছে এলে তৃতীয়বারের মতো শূন্য পেতে হত না। সহজ কথায়, পাটিগণিতের হিসাবে ‘হাত’ ও ‘ঝাড়ু’
এক হয়ে লড়লে ৩৬ আসন পেয়ে তারা সরকার গড়তে পারত। টিকিয়ে রাখতে পারত কি না সে প্রশ্ন অবশ্য ভিন্ন।
পাটিগণিতের অঙ্ক আরও একটা আছে। জোটবদ্ধ হয়ে লড়লে এই দুই দলের প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় বিজেপির ভোট ৫ শতাংশ কম হত। সেক্ষেত্রে সেটা হতে পারত মোদির হারের হ্যাটট্রিক। কিন্তু রাজনীতিতে পাটিগণিতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব রসায়নের। জনগণ ও আপের সেই রসায়ন গত দু’-আড়াই বছর ধরে একেবারে ঘেঁটে গিয়েছে। তার দায় কেজরিওয়ালকেই নিতে হবে। কেননা, ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক জয়ের পর থেকেই দলকে ছাপিয়ে তিনি নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করেন। একে একে ছেঁটে ফেলেন তঁাদের, আন্না হাজারের আপত্তি সত্ত্বেও, যঁাদের বাড়ানো হাত ধরে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে নেমেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন ‘আম আদমি পার্টি’।
দশ বছর পর সেই তালিকায় চোখ বোলালে বিস্মিত হতে হয়! এ দেশের গরিবদের উড়োজাহাজে চাপার শখ যিনি পূর্ণ করেছিলেন, সেই ‘লো কস্ট’ এয়ারলাইন্সের জনক ক্যাপ্টেন গোপীনাথ দলে টিকতে পারেননি। তঁারই মতো বিরক্তি নিয়ে দল ছেড়েছেন পরমাণু আন্দোলন কর্মী এস. পি. উদয়কুমার, পরিবেশ আন্দোলন-কর্মী মেধা পাটেকর, দিল্লি বিধানসভার স্পিকার এম. এস. ধীর, কার্গিলের শহিদ বিক্রম বাত্রার মা কমলকান্তা বাত্রা, আপের ন্যাশনাল কাউন্সিল সদস্য মৌলানা কাজমি। মহিলাদের সম্মানের প্রশ্নে দল ছাড়তে বাধ্য হন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মধু ভান্ডারি, শাজিয়া ইলমি, স্বাতী মালিওয়াল, অঞ্জলি ডালমিয়া, কিরণ বেদীরা।
শুদ্ধ, স্বচ্ছ ও পরিশীলিত রাজনীতি করবেন বলে কেজরিওয়ালকে সঙ্গ দিয়েছিলেন প্রবীন আইনজ্ঞ শান্তিভূষণ ও তঁার আইনজীবী পুত্র প্রশান্ত ভূষণ, যোগেন্দ্র যাদব, কবি ও বাগ্মী কুমার বিশ্বাস, সাংবাদিক আশুতোষ, মায়াঙ্ক গান্ধী, আশিস খৈতান, অশোক আগরওয়াল, অশ্বিনী উপাধ্যায়-রা। বহুত্ববাদ বিসর্জন দিয়ে দল দ্রুত হয়ে ওঠে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তই হয়ে দঁাড়ায় প্রথম ও শেষ কথা। নীতি, নৈতিকতা, সততা ও বিশ্বাসের যে চার খিলানের উপর দলটা গড়ে উঠেছিল, ক্রমেই তা চুরচুর ভেঙে পড়ায় আপের প্রতি সাধারণ মানুষের আশা ও ভরসাও টাল খেল। পরিণতি ৮ ফেব্রুয়ারির ফল।
রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘পারসেপশন ও ইম্প্রেশন’। জনতার উপলব্ধি ও ধারণার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে নেতানেত্রীর সাফল্য-ব্যর্থতা। ২০২০ সালে তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর কেজরিওয়ালের আচরণগত পরিবর্তন তঁার ভাবমূর্তির পক্ষে বেমানান হয়ে পড়ে। আবগারি (মদ) নীতি নিয়ে হইচই শুরু হতেই তিনি তা পরিহার করে বুঝিয়ে দেন, নীতিতে গড়বড় কিছু একটা ছিল। দলের জন্য একশো কোটি ঘুষ তিনি নিয়েছিলেন কি না তা আদালতে বিচার্য ঠিকই, কিন্তু জনমনে তা প্রশ্ন তুলে দিল। তবে কি তিনিও আর পঁাচজনের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত? এর চেয়েও মারাত্মক হয়ে ওঠে ৪০ কোটি টাকা খরচ করে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি আবাসনের খোলনলচে বদলানোর সিদ্ধান্ত। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যিনি বলেছিলেন, থাকার জন্য দু’-তিন কামরার ফ্ল্যাটই যথেষ্ট, তিনি কেন ‘শিশমহল’ বানাতে আগ্রহী হলেন? ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কালীঘাটে দিদির বাড়ি দেখা ভাইয়ের বোঝা উচিত ছিল, পারসেপশন তৈরি করা সহজ, ধরে রাখা খুব কঠিন।
কেজরিওয়ালের তৈরি করে দেওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার বিজেপি আঠারো আনা করেছে। ভাবমূর্তিতে ইচ্ছামতো কালি লেপেছে। বুঝিয়ে দিয়েছে ওই দলটাও আর পঁাচটা দলেরই মতো। ভিন্ন নয়। নীতির বড়াই করলেও নৈতিকতাহীন। গত দু’-আড়াই বছর ধরে বিজেপির আক্রমণের মুখে কেজরিওয়াল যত দিশাহারা হয়েছেন ততই তঁাকে কোণঠাসা করেছে কেন্দ্রের শাসক দল। আইন করে উপ-রাজ্যপালকে সর্বশক্তিমান বানিয়েছে। কেজরিওয়ালও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে গিয়েছেন।
অথচ তঁার সামনে উদাহরণ হিসাবে ছিলেন শীলা দিক্ষিত। কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় দিল্লির প্রয়োজন মেটাতে শীলা সবকিছু করেছেন। বেসরকারি বাস তুলে দিয়ে সরকারি বাসগুলোকে ডিজেল থেকে গ্যাসে রূপান্তরিত করতে বারবার আলোচনা করেছেন তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসমন্ত্রী রাম নায়েকের সঙ্গে। তঁার সাহায্য নিয়েছেন। বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার বেসরকারিকরণে পরামর্শ নিয়েছেন কেন্দ্রের বিদ্যুৎমন্ত্রী সুরেশ প্রভু ও অনন্ত গীতের সঙ্গে। কমনওয়েলথ গেমসের আগে পরিকাঠামো নির্মাণে পরামর্শ করেছেন উপ-রাজ্যপালদের সঙ্গে।
অথচ সহযোগিতার রাস্তায় না-হেঁটে কেজরিওয়াল শেষ দু’-বছর উপ-রাজ্যপালের সঙ্গে শুধু ‘তুই থুলি-মুই থুলি’ করে গেলেন। ফলে বিরক্তি বাড়ল জনমনে। অবহেলিত হল নাগরিক পরিষেবা। রাস্তাঘাট বেহাল রইল। বায়ু ও শব্দদূষণ বেড়ে চলল। যমুনার দূষণ বেড়ে গেল দিন-দিন। যা ছিল তঁার ‘সিগনেচার’, সেই ‘মহল্লা ক্লিনিক’ বঞ্চিত হল পর্যাপ্ত ওষুধ থেকে। ভরসায় থাকল ফ্রি বিজ্লি, পানি, মহিলাদের বাস ভাড়া ছাড় ও মাসিক ১১০০ টাকা ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর দিল্লি সংস্করণ। সেই সুযোগে একের পর এক গোল দিয়ে গেলেন নরেন্দ্র মোদি। দান-খয়রাতের পাল্লায় তিনিও হয়ে উঠলেন দাতা কর্ণ।
আত্মকেন্দ্রিক কেজরিওয়াল দশ বছরেও সাংগঠনিক দিক দিয়ে দলকে তৈরি করেননি। ভরসা করেছেন ভাবমূর্তির উপর। তাতে কালি লেপে দিল্লি দখলের পর বিজেপি আরও আগ্রাসী হবে। ছাড়বে না কংগ্রেসও। তাদের ধ্বংস করেই তো আপের উত্থান। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পরমায়ু নিয়ে এই জল্পনার মাঝেই রাজনীতির নজরে চলে আসছে পাঞ্জাব। কংগ্রেস কোমর কষছে। কেজরিওয়ালের বিপদ বাড়বে বই কমবে না।