১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সি একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১৬ মিনিট সেল্ফি তোলে। সেল্ফির জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য আইফেল টাওয়ার। সেলফি তোলা কি রোগ? ‘সেলফিটিস’ শব্দটি কেন এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আকছার? লিখছেন অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

শুরুতেই প্রাচীন গ্রিসের একটা লোকপ্রিয় গল্প বলা যাক। এটা ওভিডের ‘মেটামরফোসিস’-এর তিন নম্বর খণ্ডে বলা ‘নার্সিসাস ও ইকো’-র কাহিনি। নার্সিসাস হল– নদীর দেবতা সিফিসাস ও লিরিওপে নামের এক পরির অত্যন্ত সুদর্শন ও রূপবান পুত্রসন্তান। যেদিন নার্সিসাসের জন্ম হয়, সেদিনই লিরিওপেকে এক অন্ধ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা তিরেসিয়াস জানিয়েছিল যে, নার্সিসাসের দীর্ঘজীবী হবে। এমনকী, সে বহুজনের প্রেমিক হতে পারবে, তবে একমাত্র যদি সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে না-ফেলে!
গ্রিক সমাজে এরকম কাহিনি প্রায় শোনা যেত। কেননা তখন নিজের প্রতিবিম্ব দেখা ভয়ানক ব্যাপার বলে কুসংস্কারের প্রচলন ছিল। অন্যদিকে, আর-এক পরি ইকোর কাহিনি হল কিছুটা এরকম: সে-ও ছিল ভারি অপরূপা এবং বসবাস করত সিথাইরন নামের এক পাহাড়ে। সেই পাহাড়ে জুপিটার (বা জিউস) মাঝেমধ্যেই চলে এসে পরীদের সঙ্গলাভ করত। এমনই একটা দিনে জুপিটারের স্ত্রী জুনো (বা হেরা) হাতেনাতে ধরার জন্য স্বয়ং পাহাড়ে চলে আসে। জুপিটার তা টের পেয়ে ইকোকে বলে ব্যাপারটা সামাল দিতে। সেইমতো ঠিক যখনই জুনোর কাছে জুপিটার ধরা পড়বে-পড়বে, তখনই ইকো এসে জুনোকে নানা কথাবার্তায় লিপ্ত করে– তাকে অন্যমনস্ক করে দেয়। পরে জুনো এটা বুঝতে পারে ও ভয়ংকর রেগে গিয়ে ইকোকে অভিশাপ দেয়– সে আর কোনও দিন কথা শুরু করতে পারবে না, তবে হ্যঁা, অবশ্যই শেষ করতে পারবে। এরপরে একদিন যুবক নার্সিসাস জঙ্গলে বন্ধুদের সঙ্গে শিকার করতে যায় ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বন্ধুদের অনুসন্ধানরত এই চমৎকার যুবকটিকে দেখা মাত্র প্রেমে পড়ে যায় ইকো। কিন্তু অভিশাপের কারণে কিছুতেই তাকে ডাক দিতে পারে না।
নার্সিসাস যখন নিজের বন্ধুদের ডাক দেয়, ‘কেউ কি আছ!’ বলে– তখন ইকোও বলে ওঠে ‘কেউ কি আছ!’ নার্সিসাস অবাক হয় ও বলে– ‘যদি কেউ থেকে থাকো, এদিকে এসো আমরা একসঙ্গে থাকি’। ইকো-ও বলে, ‘...এদিকে এসো আমরা একসঙ্গে থাকি’। ইকো এই কথা বলে নিজেই ছুটে চলে আসে নার্সিসাসের সামনে আর তাকে জড়িয়ে ধরতে যায়। কিন্তু নার্সিসাস রেগেমেগে বলে, ‘কে তুমি! আমাকে স্পর্শ করবে না, দূরে থাকো, বরং আমার মৃত্যুর পর আমার শরীর উপভোগ করো’। এই কথা শুনে ইকো অত্যন্ত দুঃখ পায় ও ‘আমার শরীরকে উপভোগ করো’ উচ্চারণ করতে-করতে জঙ্গলে হারিয়ে যায়। বেদনাহত ইকো অপমানে-ঘৃণায় ধীরে-ধীরে অবসাদে পাথর হয়ে যায়, শুধুমাত্র অবশিষ্ট থাকে তার অন্তিম শব্দ প্রতিফলনের ক্ষমতা। এই ঘটনায় নেমেসিস বিরক্ত হয় ও তৃষ্ণার্ত নার্সিসাসকে একদিন জলের মধ্যে তার প্রতিবিম্ব দেখিয়ে দেয়। যেই না-দেখা অমনি নার্সিসাস নিজের রূপে নিজে এমনই অভিভূত হয়ে পড়ে যে, কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারে না। কিন্তু এক সময় সে ধীরে-ধীরে বুঝতে পারে যে, এই প্রতিবিম্ব তাকে আর যাই হোক পাল্টা ভালবাসা দিতে পারবে না। সে এরপর অত্যন্ত যন্ত্রণা বোধ করতে থাকে এবং অবশেষে একদিন ওই জলের ধারেই মারা যায়।
আচমকা কেন বললাম এই কাহিনি? কারণ, নতুন একটি শব্দ ‘সেলফিটিস’ বেশ তেড়েফুঁড়ে উঠেছে। যদিও ‘সেলফি’ শব্দটি ২০১৩ সালেই ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি’-তে জায়গা করে নিয়েছিল ও ২০১৪ সালটিকে ‘ইয়ার অফ দ্য সেলফি’ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এমনকী, জুন মাসের ২১ তারিখটিকে ‘জাতীয় সেলফি দিবস’ হিসাবেও অনেকে পালন করে থাকে। তথ্য বলছে, দৈনিক তোলা সমস্ত ছবির মধ্যে সেলফিই থাকে প্রায় ৪ শতাংশ। বিশেষ করে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি তথ্য-সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সিরা যে ৩টি ছবি তোলে তার মধ্যে একটি হয় সেলফি, আবার কেউ-কেউ স্বীকার করেছে যে, তারা প্রতিদিন ৮টির বেশি সেলফি তোলে। সাধারণত ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সিরা সেল্ফির প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’ গত মার্চে আবিষ্কার করেছে যে, অর্ধেকেরও বেশি তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা একটি সামাজিক মাধ্যমের ওয়েবসাইটে একটি সেল্ফি পোস্ট করেছে। শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু বিউটি সাইট ‘ফিলইউনিক’ জানিয়েছে, ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সি একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১৬ মিনিট বা সপ্তাহে ৫ ঘণ্টা করে সেল্ফি তোলে। এর ফলে ২০১৬ সালের তুলনায়, সেলফিতে আরও ভাল দেখানোর জন্য প্লাস্টিক সার্জারি রোগীর সংখ্যা ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেলফির জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য আইফেল টাওয়ার। সেলফিতে সবচেয়ে বেশি হাসে এশিয়া (৬৮ শতাংশ) ও দক্ষিণ আমেরিকা (৬৪ শতাংশ)। সেলফিতে সবচেয়ে কম হাসি পাওয়া যায় পূর্ব ইউরোপে (৫৩ শতাংশ)। বিশ্বব্যাপী, গড়ে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় ১.৫ গুণ বেশি সেলফি তোলে। পূর্ব ইউরোপে নারীরা পুরুষের চেয়ে ৪.৬ গুণ বেশি সেলফি তোলে, কিন্তু এশিয়ায় মাত্র ১.৩ গুণ বেশি। অবস্থা এমন যে, ৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মনে করে, শেষকৃত্যের সময় সেলফি তোলা গ্রহণযোগ্য। ৫০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী পোস্ট করার আগে সেলফি এডিট করে। এমনকী, সেলফির জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি অবধি নেয়।
কিছু ঘটনা– যেমন, গুসকরার রাজমিস্ত্রী মুন্না দাস ট্রেনে চাপা পড়ে মারা যান ২০১৭ সালে। ওই বছরেই গাভিপুরমের অভিলাষ মারা গেলেন হাতির পায়ে পিষে, আইআইটি খড়গপুরের নৌ-ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের অধ্যাপক জয়দীপের মৃত্যু হল খাদানের জলে তলিয়ে গিয়ে। আবার ২০১৮ সালে সুরাটে দুই শিক্ষার্থী, ক্যালিফোর্নিয়ায় বেড়াতে যাওয়া বিষ্ণু ও মীনাক্ষী। ২০১৯ সালে জামশেদপুরে ট্রেনলাইনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় আরও দু’জন, এমনকী ২০২১ সালে বারুইপুরের বাবাই দাস, আলিপুরদুয়ারের দীপেশ, ২০২৪ সালে মহারাষ্ট্রের শ্রীকান্ত সাতরে ইত্যাদি প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে সেলফি তুলতে গিয়ে। প্রতি বছর এসব সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তথ্য বলছে, সেল্ফি তুলতে গিয়ে যত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে তার অর্ধেকই ঘটে ভারতে। একটি গবেষণা ‘সেলফিজ: আ বুন অর বেন’-এ দেখা গিয়েছে যে, ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে প্রায় ১৫৯ জনের প্রাণ গিয়েছে। এ জন্য ভারতকে ‘সেলফি ডেথ ক্যাপিটাল’ বলা হয়। আর যারা এর শিকার, তাদের কার্যকলাপকে ‘কিলফি’ বলে শব্দায়িত করা হয়েছে। ভারতের পরে আছে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান। ফলে তা ক্রমশ চিন্তার বিষয় হয়েও দঁাড়িয়েছে। আর এটাকেই আমেরিকার মনস্তত্ত্ব সংস্থা ‘সেলফিটিস’ নামে একটি মানসিক অসুখ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আর, এখানেই ওভিডের ‘মেটামরফোসিস’-এর কাহিনি মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার– যে নিজের রূপের প্রতি তীব্র মোহবশে মারা যায়।
সেখানে ‘বর্ডারলাইন’ (দিনে তিনটি সেল্ফি তোলা কিন্তু ‘পোস্ট’ না-করা), ‘অ্যাকিউট’ (দিনে তিন বা ততধিক সেল্ফি তোলা এবং ‘পোস্ট’ করা) ও ‘ক্রনিক’ (মূলত চব্বিশ ঘণ্টা সেল্ফি শট এবং প্রতিদিন ছয় বা ততধিকবার ‘পোস্ট’ করা) এই তিনটি স্তরে জটিলতার ক্রমে অসুখটিকে সাজানো হয়েছে। তবুও দিনে-দিনে বাড়ছে বিভিন্ন সাইটের সংখ্যা যেখানে ‘কীভাবে সেরা সেল্ফি তুলতে হবে’, ‘সেলফির কোন্ পোজে দুনিয়া মাত হবে’ ইত্যাদি প্রচার চলছে, বিভিন্ন সাইট সবচেয়ে বেশি ভিউ পাওয়া সেল্ফির জন্য রিওয়ার্ড বা অর্থের বন্দোবস্ত রাখছে, সেলফিকে পণ্যায়িত করে সেলফি স্টিক, সেলফি জুতো এমনকী স্কুল-কলেজে ‘সেরা সেলফি গ্রাহক’ পুরস্কারের রমরমা হচ্ছে।
তবে মনস্তাত্ত্বিকরা পজিটিভ-নেগেটিভ দু’ভাবেই নার্সিসিজমকে দেখিয়েছেন। ‘সেলফি’ তোলা মানেই ব্যাধিগ্রস্ত নয়। একমাত্র ‘নার্সিসিস্ট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’-কেই ব্যাধি হিসাবে ধরা হয়। বাকিরা বিরাট সফল, আত্ম-গুরুত্বে মশগুল, নিজেকে নিয়ে রূপকল্পে বিভোর, অতিরিক্ত প্রশংসাকামী, অন্যের ব্যাপারে উদাসীন ইত্যাদি নানা স্তরে থাকতেই পারে– কিন্তু তা সবসময় রোগ নয়। আসলে সামাজিক মাধ্যমে তথাকথিত ‘কুল’ সেজে থাকার ইচ্ছা ও অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের ‘বাজারদর’ টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় বিপজ্জনক ঝুঁকিগুলি মানুষ নিয়ে ফেলে, যার ফল হয় ভয়ানক। সরকার ও অন্যান্য অথোরিটি অবশ্যই নানা স্থানে সেল্ফি তোলাকে ‘নিষিদ্ধ’ করে ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু অন্তিমে মানুষকেই সচেতন হতে হবে– এবং বুঝতে হবে যে, জীবনের অস্তিত্ব শুধুমাত্র একটা ছবি হতে পারে না। ছবি জীবনের ও ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশভাক মাত্র।
মনে পড়ে, যখন ‘সেলফি’ শব্দটাও তখন উদ্ভূত হয়নি, তখন অর্থাৎ ১৮৩৯ সালে, সম্ভবত দুনিয়ার প্রথম সেলফিটি তোলা হয়। ওই বছর প্যারিসে ‘ড্যাগুয়েরোটাইপ’ (Daguerreotype) প্রক্রিয়া ঘোষণা করা হয় এবং একই বছর ‘বম্বে টাইম্স’ ভারতে নতুন ‘ড্যাগুয়েরোটাইপ’ ক্যামেরার আগমন সম্পর্কে নিবন্ধ প্রকাশ করে। এমনকী কলকাতার ‘থ্যাকার অ্যান্ড কোম্পানি’ এই ক্যামেরাগুলির আমদানি ও বিক্রির বিজ্ঞাপনও শুরু করেছিল। সেই বছরেই ফিলাডেলফিয়ার রবার্ট কর্নেলিয়াস বিশ্বের প্রথম আত্ম-প্রতিকৃতিটি তুলেছিলেন। ওই সময়, অর্থাৎ উনিশ শতকে, ত্রিপুরায় মহারাজা ছিলেন বীরচন্দ্র মাণিক্য এবং তঁার মহারানি খুমান চানু মনমোহিনী দেবী। মহারাজা ছিলেন আলোকচিত্রের এক পথিকৃৎ। ইন্দোরের রাজা দীনদয়ালের পর তিনিই ভারতের দ্বিতীয় রাজকীয় ব্যক্তি যিনি ক্যামেরার অধিকারী ছিলেন। রানি মনমোহিনী দেবীও ছবি তোলার বিষয়ে অনুরক্ত ছিলেন। তঁাকেই ভারতের ‘প্রথম’ মহিলা ফোটোগ্রাফার বলা হয়। বলা হয়, ১৮৮০ সালে এই রাজ-দম্পতিই ভারতের প্রথম সেলফি তুলেছিলেন।
অন্যদিকে সত্যজিৎ রায়ের ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে একটি ছবি দেখতে পাওয়া যায়, যার নীচে লেখা আছে, ‘মা আর আমি। ক্যামেরার শাটারের সঙ্গে সুতো বেঁধে আমিই টান দিয়ে তুলেছিলাম ছবিটা’। সেই হিসাবে এ-ও এক অনবদ্য সেলফি বইকি। তাই সেলফি সুখস্মৃতির অংশ হোক, কিন্তু শেষস্মৃতি যেন না হয়ে ওঠে– খেয়াল মানুষকেই রাখতে হবে।
(মতামত নিজস্ব)