রাশ টানা না গেলে সোনার বাংলা হয়তো অচিরেই ভয়ংকর গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হবে। ‘প্রথম আলো’, ‘ডেলি স্টার’-এর উপর আঘাতের ঘোষিত উদ্দেশ্য যদি হয় ভারত-বিরোধিতা, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য– নির্বাচন পিছনো। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত বৃহস্পতিবার সারা রাত দু’-চোখের পাতা এক করতে পারিনি। ঠায় বসে বসে জ্বলেপুড়ে
খাক হয়ে যেতে দেখেছি বাংলাদেশের দুই সেরা দৈনিক ‘প্রথম আলো’ ও ‘দ্য ডেলি স্টার’-এর অফিস। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে আসা ভিডিওগুলোয় দেখছিলাম অন্ধ-উন্মত্ত, রক্তলোলুপ জনতার উল্লাস। প্রত্যক্ষ করছিলাম শয়ে শয়ে যুবকের বাধাহীন লুটপাট। তাণ্ডব। ঘণ্টা দেড়েক ধরে ‘প্রথম আলো’ পুড়িয়ে সেই জনতা এগিয়ে যায় এই সংস্থারই ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেলি স্টার’-এর দিকে।
অবাক হয়ে দেখলাম, সেখানে সেনারা জোড়হাতে ‘বাবা’-‘বাছা’ করছে অজ্ঞান জনতার কাছে! তাদের বোঝাতে চাইছে, অফিসের ছাদে আটক সাংবাদিকদের উদ্ধার করা জরুরি। জবাবে সেনাকর্তাদের উদ্ধত জনতা বলছে, বিশ মিনিট সময় দিচ্ছি। ঠিক বিশ মিনিট। তার মধ্যে অফিস খালি করে সরে দঁাড়ান! তেমনই হয়েছিল। সাংবাদিকদের সরিয়ে সেনাবাহিনী দায়িত্ব সেরেছিল। অথচ সেনাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার!
আমার হৃদয়ে সেই থেকে রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে। প্রজ্বলিত সংবাদপত্র অফিস কোনও সাংবাদিকের কাছে দৃষ্টিসুখ বয়ে আনে না। তার উপর গত ১২ বছর ধরে ‘প্রথম আলো’ আমার পরিচয়। অন্নদাতা। জ্বলে যাওয়া অফিসের প্রতিটি কক্ষ, অলিন্দ আমার চেনা। সম্পাদক ও সহকর্মীরা আত্মীয়সম। তঁাদের কাছে আমি এই পরিবারেরই একজন। এই রক্তক্ষরণ, উন্মত্ত অর্বাচীন জনতার হিংস্র আস্ফালন, কবে বন্ধ হবে জানি না। আগুনের লেলিহান শিখা মনে করাচ্ছিল
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি– ‘এই দেশটা কি মানুষের বসবাসযোগ্য হবে?’ কেন যেন মনে হচ্ছিল, রাশ টানা না গেলে সোনার বাংলা হয়তো অচিরেই ভয়ংকর গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হবে। পরিণতি অনুমেয়।
দেড় বছর ধরে এমন আক্রমণের শঙ্কা সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ছিল। মাঝে মাঝে ফণা তুলে হিস হিস করেছে। এখানে-ওখানে ছোবলও মেরেছে। দুই অফিসের সামনে অর্বাচীনরা
জড়ো হয়েছে। গরু জবাই করেছে। গালিগালাজ দিয়েছে। কিন্তু আক্রমণ হানেনি। ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শঙ্কা জোরালো হয় ধর্মান্ধ মৌলবাদী নেতাদের হুংকারে। বারবার শোনা গিয়েছে, ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেলি স্টার’ বন্ধ করে দিতে হবে। ‘ছায়ানট’, ‘উদীচী’-দের নির্মূল করতে হবে। নইলে প্রকৃত ‘স্বাধীনতা’ অর্জিত হবে না। দু’-তিনদিন ধরে অবিরাম ঘৃণাবর্ষণের পর হাদি-মৃত্যুর রাতে জনতা ধেয়ে আসে গণতন্ত্রর চতুর্থ স্তম্ভের দিকে।
বৃহস্পতিবার রাত দশটা থেকে সরকার, সেনা ও পুলিশ কর্তাদের বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে। কেউ শোনেনি। তৎপর হয়নি। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ সরকার সব ছারখার হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বাণী শোনা যায়। পাশে দঁাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। বহ্নু্যৎসব বন্ধে কেন তিনি ব্যর্থ, শুধু বৃহস্পতিবার রাতে নয়, দেড় বছর ধরে বারবার, বহু স্থানে, বহু আক্রমণ ও লুঠতরাজের ক্ষেত্রে, এমনকী ময়মনসিংহে দীপুচন্দ্র দাসকে পিটিয়ে মেরে গাছে ঝুলিয়ে পোড়ানোর সময় কেন তিনি এবং তঁার সরকার নির্বাক দর্শক, ঠুঁটো জগন্নাথ, সেসব প্রশ্ন মাথা কুটে মরছে। কোনও জবাব নেই।
ষোড়শ শতকে আরাকান প্রদেশের মগ দস্যুদের দৌরাত্মে্য বঙ্গভূমির যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ‘মগের মুলুক’-এ পরিণত হয়েছিল, হাসিনা-বিদায়ের পর ইউনূস প্রশাসনের সৌজন্যে এখন তা ‘মবের মুলুক’। এ দায় থেকে নোবেলজয়ী প্রশাসক কোনও দিনই নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন না। এই স্মৃতি দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়াবে।
কেন ‘প্রথম আলো’ বারবার আক্রমণের লক্ষ্য? সহজ উত্তর, ২৭ বছর ধরে এই পত্রিকা কোনও শাসকের অন্ধভক্ত হয়নি। প্রশ্নহীন আনুগত্য দেখিয়ে কারও ‘বন্ধু’ হয়নি। কোনও পক্ষ নিয়ে চলেনি। বিগত জমানায় এই দুই সংবাদপত্র তাই ‘শত্রু’ ঘোষিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, “‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেলি স্টার’ আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের শত্রু। এই দুই কাগজ পড়বেন না।”
তঁার বয়ানে, ‘প্রথম আলো’ আওয়ামি লিগ ও বাংলাদেশের শত্রু। তাই ভারতেরও শত্রু। হাসিনার হুকুমে শতাধিক মামলায় জেরবার হয়েছেন এই কাগজের সম্পাদক ও সাংবাদিকরা। অর্ধশতাধিক মামলা এখনও অমীমাংসিত। মরিয়া হাসিনা শেষদিকে চেষ্টা করেছেন কাগজটির দখল নিতে। সম্পাদক বদলে দিতে। বিজ্ঞাপনদাতাদের হুমকি দিয়ে ভাতে মারতে। ৫৫ শতাংশ রাজস্ব কমেছিল। ‘প্রথম আলো’ তবু মাথা নোয়ায়নি। হাসিনার পতনের পর স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি বাংলাদেশে দ্রুত মাথাচাড়া দিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক, উন্নতমনা, প্রগতিশীল, উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে যারা ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, তারা এই দুই প্রতিষ্ঠানকে দাগিয়েছে ‘ভারতের দালাল’ হিসাবে। দেড় বছর ধরে জনসংখ্যার এই সংখ্যালঘু অংশ উচ্চকিত– ভোকাল। তাদের দাপাদাপিতে শান্তিপ্রিয় সংখ্যাগুরু বাংলাদেশি নীরব দর্শকে পরিণত। ইসলামি মৌলবাদীরা জেলায় জেলায় বাউলদের ঠেঙাচ্ছে। লালনমেলা বানচাল করছে। মাজার ভাঙছে।
গানবাজনা বন্ধ করে দিচ্ছে। স্কুলে গানের শিক্ষক নিয়োগ তুলে দিয়েছে। সিলেবাস বদলাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য পদে নিয়োগ করছে অনুগামীদের। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুফিবাদ অস্বীকার করছে। জাতীয় সংগীত বদলাতে চাইছে। সংখ্যালঘুদের ত্রস্ত করে রেখেছে তারা-ই। একের পর এক প্রতিষ্ঠান দখলের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রনীতি বদলানো তাদের লক্ষ্য। লিখতে চাইছে নতুন সংবিধান। মুহাম্মদ ইউনূস এদের হাতের পুতুল।
হাসিনা যাদের টুঁটি টিপে ধরে রেখেছিলেন, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু পর্যন্ত পালন করতে দেননি, সেই স্বাধীনতাপন্থী বিএনপি এখন ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর। হাসিনা বিদায়ের পর টাকা রোজগার তাদের একাংশের ধর্ম হয়ে উঠেছিল। তোলাবাজি, জবরদস্তি চঁাদাবাজি, সিন্ডিকেট দখল করে দ্রুত আখের গোছাতে তারা যখন ব্যস্ত, জামায়াতে ইসলামির নজর তখন সামাজিক স্তরে বিস্তার ঘটানোর দিকে। বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য দ্রুত নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসা। পক্ষান্তরে জামায়াতে ও ইসলামপন্থীরা চায় নির্বাচন আরও পিছতে। যত পিছবে তত তাদের শিকড় আরও প্রোথিত হবে। এই পরস্পরবিরোধী স্বার্থের মাঝে দোদুল্যমান অন্তর্বর্তী সরকার।
‘প্রথম আলো’, ‘ডেলি স্টার’-এর উপর আঘাতের ঘোষিত উদ্দেশ্য যদি হয় ভারত-বিরোধিতা, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য তাহলে নির্বাচন পিছনো। গত নভেম্বরে ঢাকা সফরের সময় এই স্তম্ভে লিখেছিলাম, নির্বাচন হলে সবচেয়ে ক্ষতি যাদের, তারা কেন তা হতে দিয়ে অন্যের লাভের কারণ হবে? বিএনপির দৃঢ় ধারণা, ফেব্রুয়ারিতে ভোট হলে তারা-ই ক্ষমতাসীন হবে। ‘প্রথম আলো’-র সাম্প্রতিক সমীক্ষাতেও রয়েছে তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু একই সঙ্গে সেই সমীক্ষা এটাও দেখিয়েছে, দ্রুত এগচ্ছে জামায়াতে ইসলামি ও অন্যান্য ইসলামপন্থী জোট। দখল করছে সামাজিক পরিসর। যত দিন যাচ্ছে, ইসলামি মৌলবাদের প্রভাব ও বিকাশও ঘটছে তত। কোনও দিন যারা জোটবদ্ধ হয়েও ৮ শতাংশ ভোট পায়নি, এখন তারা ভবিষ্যতে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে। নির্বাচন যত পিছবে তাদের ততই লাভ।
১৭ বছরের নির্বাসন শেষে লন্ডন থেকে দেশে ফিরছেন খালেদা-পুত্র তারেক রহমান।
২৫ ডিসেম্বর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিএনপি নেতা-কর্মীরা চনমনে। ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়া ও মৃত্যু, ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেলি স্টার’-এ তাণ্ডব, দীপুচন্দ্র দাসকে হত্যা, বিএনপি নেতার বাড়িতে আগুন লাগানোর মতো ঘটনার প্রাথমিক ‘লক্ষ্য’ তারেকের প্রত্যাবর্তনের পথে কঁাটা বিছানো। তঁাকে ঠেকানো। আর, মূল লক্ষ্য অরাজকতার মাত্রা বাড়িয়ে নির্বাচন স্থগিত করে দেওয়া।
বাংলাদেশ উন্নতমনা, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকবে কি না শুরু হয়েছে সেই পরীক্ষা। ‘প্রথম আলো’-র ২৭তম বর্ষপূর্তির স্লোগান ছিল ‘সত্যই সাহস’। সত্যের পথে থেকে সাহসী না-হলে পরবর্তী আঘাতের হাত থেকে রবীন্দ্র-নজরুল-লালনের বাংলাদেশকে বঁাচানো কঠিন। সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের মুখে দঁাড়িয়ে প্রহর গুনছে বাংলাদেশ।
