সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আমেরিকা ও পশ্চিমি দেশগুলো রাশিয়ার উপর যে কঠোর ও বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে জোর আলোচনা চলছে। একটি বৃহৎ ও সম্পদশালী দেশকে অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে আদৌ কি আত্মসমর্পণে বাধ্য করা সম্ভব? ইতিহাস কী বলে? লিখছেন সুজনকুমার দাস।
মা-বাবার কাছে দুষ্টু, বিপথগামী সন্তানকে বাগে আনার শেষ অস্ত্র যেমন ‘পকেটমানি’ বা ‘হাতখরচ’ বন্ধ করে দেওয়া– ঠিক তেমনই বিশ্ব-রাজনীতিতে কোনও শক্তিশালী সার্বভৌম রাষ্ট্রকে নতিস্বীকারে বাধ্য করার একটি পুরনো ও প্রচলিত অস্ত্র হল– ‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা’ বা অবরোধ। এই কৌশলকে অনেকেই ‘হাতে না মেরে ভাতে মারার’ কৌশল হিসাবে অভিহিত করে থাকেন। এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট: ‘টার্গেট’ দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া, যুদ্ধ বা আগ্রাসন পরিচালনার ক্ষমতা দুর্বল করা এবং শেষ পর্যন্ত দেশটির নেতৃত্বকে নীতিগত পরিবর্তন কিংবা চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আমেরিকা ও পশ্চিমি দেশগুলো রাশিয়ার উপর যে কঠোর ও বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে জোর আলোচনা চলছে। কিন্তু ইতিহাস কি এই ধরনের ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধাস্ত্র’-র সাফল্যের পক্ষে সওয়াল করে?
রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন মস্কোর উপর একের-পর-এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ৬৩০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ করা, কিছু প্রধান রুশ ব্যাঙ্ককে ‘সুইফট’ (SWIFT) আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করা, এবং তেল-গ্যাস কোম্পানির আন্তর্জাতিক লেনদেন বন্ধ করার মতো পদক্ষেপ। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার দু’টি প্রধান তেল কোম্পানি– রোসনেফ্ট ও লুকওয়েলের উপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা সেই চাপের ধারাবাহিকতা। পশ্চিমিদের প্রত্যাশা ছিল, এই অর্থনৈতিক ঝড় রাশিয়ার অর্থনীতিকে দ্রুত দুর্বল করবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি করবে এবং ক্রেমলিনকে যুদ্ধ থামাতে বাধ্য করবে।
তবে এই সর্বাত্মক অর্থনৈতিক চাপ সত্ত্বেও দু’-বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও রাশিয়াকে এখনও যুদ্ধ থামাতে বা নীতিগত পরিবর্তন করতে বাধ্য করা যায়নি। রুশ অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক ভালভাবে রাশিয়া এই অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলে নিয়েছে। ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’-এর (IMF) মতো সংস্থাও স্বীকার করেছে যে, ২০২৪ সাল থেকে রাশিয়ার অর্থনীতি অপ্রত্যাশিতভাবে স্থিতিশীল রয়েছে, যা পশ্চিমি দেশগুলোর অনুমানকে অনেকটাই ম্লান করেছে। এ পরিস্থিতি আবারও সেই পুরনো প্রশ্নটিকে সামনে এনেছে– একটি বৃহৎ ও সম্পদশালী দেশকে অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে আদৌ কি আত্মসমর্পণে বাধ্য করা সম্ভব?
ইতিহাসের নজিরগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অর্থনৈতিক অবরোধ প্রায়শই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, হয়েওছে। বহুবার দেখা গিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা ‘টার্গেট’ দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক বা সামরিক আত্মসমর্পণ ঘটাতে পারেনি। বরং বহু ক্ষেত্রে এর ফল হয়েছে বিপরীত।
১৯৯৮ সালে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে, ভারত পোখরানে একাধিক পরমাণু পরীক্ষা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাপান-সহ বহু দেশ কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বিদেশি সাহায্য স্থগিত হয়, আন্তর্জাতিক ঋণপ্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি হয়, এবং প্রায় ২০০টি ভারতীয় সংস্থার উপর প্রযুক্তি-স্থানান্তর ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়। ভারতের অর্থনীতি সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, ভারত তার পারমাণবিক নীতিতে চুল পরিমাণ পিছু হটেনি। উল্টে, ভারত দেশীয় প্রযুক্তি ও আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করে। জাতীয় স্বার্থে গৃহীত সিদ্ধান্তের সামনে এই নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত টেকে না–পোখরানের ঘটনাই তার প্রমাণ।
১৯৬০ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ কিউবার অর্থনীতিকে দুর্বল করেছিল, কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রো বা বর্তমান সরকারের আদর্শ ও শাসনব্যবস্থার চরিত্রে কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি। হাভানা বরং এই চাপকে ‘বাহ্যিক শত্রুর আগ্রাসন’ হিসাবে প্রচার করে জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্য আরও দৃঢ় করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যখন পশ্চিমিরা জাপানে তেল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছিল, তারা আশা করেছিল টোকিও নতিস্বীকার করবে। বাস্তবে, জাপান আত্মসমর্পণ তো করলই না, উল্টে নিষেধাজ্ঞার জবাবে পার্ল হারবার আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধের আগুন আরও ছড়িয়ে দিল। নিষেধাজ্ঞা এখানে সংঘাতের সূচনা ঘটিয়েছিল, আত্মসমর্পণের পরিবেশ তৈরি করেনি।
১৮০৬ সালে নেপোলিয়ন ইউরোপ জুড়ে ব্রিটিশ পণ্যের উপর যে মহাদেশীয় অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, শেষ পর্যন্ত সেই নীতি তার নিজের সাম্রাজ্যের পতনকেই ত্বরান্বিত করেছিল– নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীর উপরেই তা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। আধুনিক বিশ্বেও একই প্রবণতা স্পষ্ট। ইরান বহু বছর ধরে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার চাপে থেকেও তার শাসনব্যবস্থার চরিত্র বদলায়নি। উত্তর কোরিয়াও ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার মুখে থেকেও তার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করেনি। এই ধরনের কঠোর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রণ এবং স্বৈরশাসনের ভিত এতটাই মজবুত যে, বহিরাগত অর্থনৈতিক চাপ কার্যত ব্যর্থ। দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলার উপর তেল রফতানি ও আর্থিক লেনদেন বিষয়ে প্রচুর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় দেশটির অর্থনীতি ধসে পড়লেও, প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এখনও ক্ষমতায় আছেন। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি ও তেল-গ্যাস রফতানিকারক দেশ হওয়ায়, এসব ঐতিহাসিক উদাহরণ বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনটি প্রাসঙ্গিক দিক নির্দেশ করে। প্রথমত, স্বনির্ভরতার কৌশল– ভারত যেমন পোখরান-পরবর্তী সময়ে দেশীয় প্রযুক্তি বিকাশে মন দিয়েছিল, রাশিয়াও নিষেধাজ্ঞার পরে দ্রুত চিন, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়িয়েছে এবং ‘বিকল্প’ বাজার তৈরি করেছে। দ্বিতীয়ত, জাতীয়তাবাদী সমর্থন– কিউবা বা ইরানের মতো, পুতিনও পশ্চিমি অবরোধকে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ হিসাবে তুলে ধরে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দিয়েছেন। তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি ধৈর্য– ইতিহাসে দেখা গিয়েছে, কেবল অর্থনৈতিক অবরোধে কোনও বড় শক্তি আত্মসমর্পণ করে না; রাজনৈতিক বা সামরিক পরাজয় ছাড়া তা অসম্ভব।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক অস্ত্র, যা কোনও দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করতে পারে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর সংকট সৃষ্টি করতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে রাশিয়ার উপর আরোপিত এই সর্বাত্মক অবরোধ প্রমাণ করে, পশ্চিমি শক্তিরা মস্কোকে আর্থিক দিক থেকে পঙ্গু করার জন্য সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল– এর বৈশ্বিক প্রভাব বা ‘স্পিলওভার এফেক্ট’। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল, গ্যাস, খাদ্যশস্য এবং সার সরবরাহকারী হওয়ায় এসব নিষেধাজ্ঞা কেবল মস্কোকে নয়, বরং বিশ্বজুড়ে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে, যার ফলস্বরূপ বহু উন্নয়নশীল দেশ নজিরবিহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, এই ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধাস্ত্র’ কেবল লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করে না, বরং বিশ্ব অর্থনীতির আন্তঃসংযুক্তির কারণে অন্যান্য নিরপেক্ষ দেশকেও ভোগান্তির মুখে ফেলে।
তবে, ঐতিহাসিক নজিরগুলো এই অবরোধের মূল ‘লক্ষ্য’ অর্জনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কঠোর বার্তা দেয়। কিউবার অনমনীয়তা, পোখরানের পর ভারতের দৃঢ়তা, বা নেপোলিয়নের অবরোধের বুমেরাং হওয়া– এই সমস্ত ঘটনাই স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, সামরিক পরাজয় বা অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার পালাবদল ছাড়া কেবল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার মতো একটি বৃহৎ, সম্পদশালী এবং পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র সহজে আত্মসমর্পণের পথে হঁাটবে না। রাশিয়া দ্রুত চিন, ভারত ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য রুট ও আর্থিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যার ফলে পশ্চিমি চাপ অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার যুদ্ধব্যয় বাড়াবে, প্রযুক্তিগত আমদানিকে কঠিন করবে, এবং জনগণের ভোগান্তি বাড়াবে সত্য; কিন্তু পুতিন সরকার এই চাপকে জাতীয়তাবাদী প্রচারণার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে জনগণের সমর্থন আরও দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে।
ইতিহাসের পাঠ থেকে স্পষ্ট– অর্থনৈতিক অবরোধ একটি রাষ্ট্রকে নতজানু করার চেয়ে বরং তাকে ‘বিকল্প’ পথে আরও কঠোর হতে বাধ্য করার সম্ভাবনাই বেশি বহন করে, এবং প্রায়শই এটি আরোপকারী দেশ বা তৃতীয় পক্ষকে অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ফেলে।
(মতামত নিজস্ব)
