shono
Advertisement

রবিন হুড কি অলীক? ইতিহাসের ‘সামাজিক ডাকাত’ তবে কারা?

ডাকাত নিয়ে অল্পবিস্তর গল্প-উপন্যাস নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যায়।
Published By: Biswadip DeyPosted: 03:57 PM Apr 10, 2025Updated: 03:57 PM Apr 10, 2025

ডাকাত অথচ সামাজিক! তবে কি রবিন হুড? রক্তমাংসের কোনও মানুষকে ‘রবিন হুড’ বলে চিহ্নিত করা অবশ্য যায় না। আর, যদি এমন কেউ থেকেও থাকেন, তিনি কোনওভাবেই ১৪ শতকের আগে ছিলেন না। হবস্‌বম তঁার বইয়ে রবিন হুড-মার্কা যে-কয়েকজনের কথা বলেছেন, তঁারা পরবর্তী সময়ের এবং তঁাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ইতিহাস অবগত। লিখলেন ঋত্বিক মল্লিক।

Advertisement

জার্মান ভাষায় ‘Räuberromane’ শব্দটির অর্থ ‘ডাকাতিয়া উপন্যাস বা সাহিত্য’। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সাহিত্যে এমন ধারার অস্তিত্ব আছে বলে তো মনে হয় না। তবে সব ভাষায় ডাকাত নিয়ে অল্পবিস্তর গল্প-উপন্যাস নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যায়। এসব গল্পের ডাকাতরা শুধু আইনভঙ্গকারী অপরাধী নয়, এরা মানুষের কাছে নেপোলিয়ন বা বিসমার্ক, এমনকী হয়তো-বা নেপোলিয়ন বা বিসমার্কের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ! এরা শাসক-বিরোধী, গরিব কৃষকের যোদ্ধা; এরা হরিণের চেয়েও ক্ষিপ্র, বাজপাখির চেয়েও বিচক্ষণ, শৃগালের চেয়েও ধূর্ত। এই নিয়ে ১৯৫৯ সালে এরিক জে. হবস্‌বম ‘সামাজিক ডাকাত’ নামে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সন্দর্ভ রচনা করেন, এবং দশ বছর পর লেখেন ‘Bandits’ বইটি (১৯৮১ সালে এই বইয়ের সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়)।

তিনি দেখান– পৃথিবী জুড়েই এমন বেশ কয়েকজন ডাকাতের কথা জানা যায়, যঁারা রবিন হুড অভিধায় ভূষিত এবং লোকগাথায়, লোককাহিনিতে, লোকনাটকে এমনকী এই সময়ও সিনেমায় আর টেলিভিশন সিরিজে শতকের পর শতক জুড়ে অমর হয়ে আছেন। স্বয়ং রবিন হুডকে নিয়েই রয়ে গিয়েছে নানা সংশয়। এমনকী, কোনও রক্তমাংসের মানুষকে ‘রবিন হুড’ বলে চিহ্নিত করা যায় না। আর, যদি এমন কেউ থেকেও থাকেন, তিনি কোনওভাবেই ১৪ শতকের আগে ছিলেন না। প্রায় ৭০০ বছর ধরে এই রবিন হুড প্রোটোটাইপটি সমান জনপ্রিয়। হবস্‌বম তঁার বইয়ে রবিন হুড মার্কা যে-কয়েকজনের কথা বলেছেন, তঁারা পরবর্তী সময়ের এবং তঁাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ইতিহাস অবগত। যেমন ধরুন, রাশিয়ার গরিব মানুষের যোদ্ধা, দস্যু স্তেন্‌কা রাজিন ১৬৭০ সাল নাগাদ মাথাচাড়া দিয়েছিলেন। তবে এই ‘সামাজিক ডাকাত’দের স্বর্ণযুগ ছিল ১৮-১৯ শতক।

এই সময়ের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন স্লোভাকিয়ার জানোসিচ (১৬৮৮-১৭১৩)। স্লোভাক কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে এবং সিনেমায় জানোসিচকে দেখা যায় ‘নায়ক’ হিসাবে। তঁার সম্বন্ধে কিংবদন্তি হল, তিনি বড়লোকের থেকে সম্পদ লুট করে এনে বিলিয়ে দিতেন গরিবদের মধ্যে। একেবারে যেন ‘স্লোভাকিয়ার রবিন হুড’! তঁাকে নিয়ে এই গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং চেক প্রজাতন্ত্রে।

চেক প্রজাতন্ত্রে এবং স্লোভাকিয়ার স্কুলে-স্কুলে এখনও পড়ানো হয় জানোসিচের জীবনগাথা। এমনকী, বিশ শতকে নাৎসিবিরোধী জাতীয়তাবাদী স্লোভাকদের মধ্যে একটি দল তঁার নামেই নিজেদের পরিচয় দিত। অত্যাচারিত মানুষের মধ্যে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন এই জানোসিচ।

জানোসিচের মতোই একইভাবে স্পেনের আন্দালুশীয় প্রদেশের রবিন হুড ছিলেন দিয়েগো কোরিয়েন্তেস (১৭৫৭-১৭৮১)। ২৩ বছর বয়সে তঁার মাথার দাম ধার্য হয়েছিল ১০০ স্বর্ণমুদ্রা। স্পেনের নাগাল এড়িয়ে তিনি চলে যান পর্তুগালে, যদিও সেখানেই তিনি ধরা পড়েন। স্পেনে তঁার বিচার হয়, এবং তঁাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সেভিলে ফঁাসি দিয়ে মেরে ফেলার পর দেহ টুকরো-টুকরো করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেসব প্রদেশে, যেখানে কোনও-না-কোনও সময় সক্রিয় ছিলেন তিনি। তঁার মাথা কবর দেওয়া হয় সেভিলেই। কয়েক বছর আগে, তঁার কবর রেস্টোরেশন করার সময় দেখা যায় মাথার করোটির মধ্যে গেঁথে আছে একটি লোহার হুক।

রীতিমতো ৩০০ জনের সশস্ত্র দল তৈরি করে ফেলেছিলেন ফ্রান্সের লুই ম্যানদ্রিন (১৭২৫-১৭৫৫)। সেই সময় ফ্রান্সে করব্যবস্থায় কোনও নির্দিষ্ট কর চালু ছিল না আর সেই সুযোগে করসংগ্রাহকরা রাজার নাম করে যতটা সম্ভব টাকা তুলত প্রধানত সাধারণ মানুষকে শোষণ করে। ম্যানদ্রিনের দস্যুবৃত্তির ক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য ছিল, এসব অসৎ করসংগ্রাহকরা। ম্যানদ্রিন প্রথমে জড়িয়ে পড়েন একটি খুনের ঘটনায়, তারপর স্যাভয় অঞ্চলে তিনি যোগ দেন একটি স্মাগলিংয়ের দলে। পরে তিনিই হয়ে ওঠেন দলপতি। সেখানে তৈরি করেন একটি ওয়‌্যারহাউস, যেখানে প্রচুর অস্ত্রের পাশাপাশি মজুত থাকত ফ্রান্স থেকে লুট করে আনা বস্ত্র, তামাক, লবণ, মশলা। এইগুলো আবার বিক্রি করতেন ফ্রান্সেই কোনও বিক্রয়কর না দিয়ে। ফলে, সাধারণ মানুষ এসব কিনতে পারত অনেক কম দামে।

স্বাভাবিক কারণেই প্রবল জনসমর্থন পেতে থাকেন আর তার ফলেই ফরাসি সরকার আইন পাস করে স্মাগলিং হওয়া জিনিস কেনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই খবর পেয়ে ম্যানদ্রিন হাজির হন দক্ষিণ ফ্রান্সের রোদেজে, সেখানকার এক প্রশাসকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে স্মাগলিং করে আনা জিনিস কিনতে বাধ্য করেন। ৩০ বছর বয়সি ম্যানদ্রিন শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেলেন। ছ’হাজার জন লোকের সামনে তঁাকে এনে ফেলা হল মাটিতে। লোহার রড দিয়ে তঁার হাত, পা আর পেটে মেরে ভেঙে দেওয়া হল কিন্তু মুখ থেকে একটা আওয়াজও বের করা গেল না। একটা বড় চাকার নিচে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হল কিছুক্ষণ। এক সময় দম বন্ধ হয়ে মারা গেলেন ম্যানদ্রিন। তঁার ভাঙাচোরা দেহ ফেলে রাখা হল, যাতে সাধারণ লোক তা দেখতে পায়। এই দৃশ্য দেখে চোখের জল সামলাতে পারেনি অনেকেই আর এখান থেকেই জন্ম নিল ম্যানদ্রিনকে নিয়ে লোকগাথা। পরবর্তী সময়ে ভলতেয়ার মাঝে-মাঝেই উল্লেখ করতেন বীর লড়াকু ম্যানদ্রিনের কথা, তুলনা করতেন প্রুশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেদেরিকের সঙ্গে।

সাহিত্যে প্রবলভাবে জায়গা করে নেয় এই ‘সামাজিক ডাকাত’-এর মিথ। সারভেন্তিস যেমন তঁার লেখায় নিয়ে আসেন ষোড়শ শতকের স্পেনীয় ডাকাতদের, তেমনই ওয়াল্টার স্কট লেখেন স্কটল্যান্ডের কুখ্যাত রব রয়-কে নিয়ে। হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, চেক, এশিয়া বিশেষত ভারত আর তুরস্কের লেখকদের লেখায় পাওয়া যেতে থাকে একের-পর-এক বাস্তব এবং কাল্পনিক ডাকাতদের। আসলে, সেই নির্দিষ্ট সময়কালে সমাজে এদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব লেখকদের বাধ্য করেছিল সাহিত্যের আঙিনায় নিয়ে আসতে।

তবে এখানেই কিছু সংগত প্রশ্ন তোলেন হবস্‌বম-সহ বেশ কয়েকজন গবেষক। তঁাদের প্রথম বক্তব্য হল, এই ‘ডাকাতিয়া সাহিত্য’ সৃষ্টিকারীরা প্রধানত শহুরে সমাজের ‘এলিট’ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত, গ্রামের কৃষক বা এই ডাকাত শ্রেণির সঙ্গে সরাসরি যঁাদের সম্পর্ক বা অভিজ্ঞিতা ছিল না, বা থাকলেও তা ছিল খুবই ক্ষীণ। দ্বিতীয়ত, মৌখিক লোকজ ইতিহাসকে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতেও পারেননি তঁারা। হবস্‌বম তো লিখেইছেন, ‘Most oral history today is personal memory, which is a remarkably
slippery medium for preserving facts. The point is that memory
is not so much recording as a selective mechanism, and the
selection is, within limits, constantly changing.’

বলিভিয়া নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন এরিক ল্যাঙ্গার তঁার ‘Andean Banditry and Peasant Community Organization’ লেখায়। তিনি মন্তব্য করেছেন ‘...exhibit a selective
memory that emphasizes only
certain traits among bandits. No tale deals with robbing other peasants.’

আসলে এঁদের মনে হয়েছে এসব সাহিত্য বা লোককথায় ‘সামাজিক ডাকাত’দের আলোর দিকটাই দেখাতে গিয়ে অস্বীকার করা হয়েছে খুনখারাপি, রক্তপাত, ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখার ভয়াবহ নিষ্ঠুর দিকগুলো। এই তত্ত্বের কচকচি থেকে একটু অন্যদিকে যাওয়া যাক। ক্লেপ্টোম্যানিয়া’ শব্দটি আমাদের কাছে এখন আর খুব একটা অজানা নয়।

এ এক এমন মানসিক রোগ, যার ফলে কোনও ব্যক্তি, দরকারে হোক বা না-হোক, নানা কিছু চুরি করতে থাকে। এর সঙ্গে বড়সড় ডাকাতির তেমন যোগ নেই। কিন্তু এই ‘kleptomania’ শব্দের উৎসে রয়েছে ‘klepht’ শব্দ। ‘ক্লেফ্‌ট’ মূলত ১৫ শতকের এক বিশেষ জনজাতিকে বোঝাত। অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত গ্রিসের পাহাড়ি অঞ্চলে এদের বসবাস ছিল। এরা ছিল অটোমান শাসনের বিরোধী এবং অটোমান শাসকদের সঙ্গে নিরন্তর সংঘাতে লিপ্ত থাকত। লুটপাট, ডাকাতি, দস্যুবৃত্তি এবং যে কোনওরকম কর ফঁাকি দেওয়ায় এরা ছিল সিদ্ধহস্ত। বেশিরভাগ ক্লেফ্‌ট গোষ্ঠী কোনও-না-কোনওভাবে অংশ নিয়েছিল গ্রিকদের স্বাধীনতা যুদ্ধে। ফলে এই ‘ক্লেফ্‌ট’-দের থেকে ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়া’ শব্দটি এসে থাকলেও রোগের ক্লিন্নতা কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল না।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ডাকাত অথচ সামাজিক! তবে কি রবিন হুড?
  • রক্তমাংসের কোনও মানুষকে ‘রবিন হুড’ বলে চিহ্নিত করা অবশ্য যায় না।
  • আর, যদি এমন কেউ থেকেও থাকেন, তিনি কোনওভাবেই ১৪ শতকের আগে ছিলেন না। হবস্‌বম তঁার বইয়ে রবিন হুড-মার্কা যে-কয়েকজনের কথা বলেছেন, তঁারা পরবর্তী সময়ের এবং তঁাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ইতিহাস অবগত।
Advertisement