১৯৬২ সালে জেমস ডি. ওয়াটসন ও তাঁর দুই সহযোগী ডিএনএ আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এর মধ্যে ওয়াটসন বিচিত্র প্রকৃতির। লাগামহীন বাক্যচয়নের বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি। ছিলেন বর্ণবাদী, লিঙ্গবৈষম্যে বিশ্বাসী, সমকাম-ভীত। তবু বিজ্ঞানের পরিসরে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। ৬ নভেম্বর প্রয়াত হলেন তিনি। লিখছেন অরিজিত চট্টোপাধ্যায়।
১৯৫৩ সাল, শনিবার, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন। বেশ সকাল সকাল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস গবেষণাগারে প্রবেশ করলেন বছর পঁচিশের এক যুবক। ভোর ভোর বিছানা ছেড়ে অন্যদের থেকে অনেক আগে গবেষণাগারে পৌঁছানোর পিছনে সংগত কারণ ছিল। আগের দিন যে-কাজটা তিনি করছিলেন, তা করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়, তাই পরের দিন জলদি গবেষণাগারে পৌঁছন– যাতে শনিবার সকালের
শান্ত-নিঝুম পরিবেশে, নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। হঠাৎ করে দেখলে, তাঁর কাজটি খুবই সাধারণ মনে হতে পারে, কারণ তিনি কার্ডবোর্ডের কিছু নির্দিষ্ট আকৃতির টুকরো জুড়ে জুড়ে ত্রিমাত্রিক জিগ্-স পাজ্লের মতো কিছু একটা কাঠামো বানানোর চেষ্টা করছিলেন। এ ব্যক্তি আর কেউ নন, আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা ‘বিস্ময় প্রতিভা’ জেমস ওয়াটসন। পিএইচডি শেষ করার পর চলে আসেন কেমব্রিজে এবং সেখানে পরিচয় হয় বয়সে সামান্য বড় এক ব্রিটিশ নাগরিক ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গে। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন-ভিন্ন কাজে নিযুক্ত হলেও সহজেই তাঁদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে, এবং একসঙ্গে নেমে পড়েন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ডিএনএ-র সন্ধানে।
জেমস ডি. ওয়াটসনের জন্ম ১৯২৮ সালের ৬ এপ্রিল আমেরিকার শিকাগো শহরে। বাবার শখ ছিল পাখি দেখা, যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াটসনের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে তাঁদের পরিবার যে খুব একটা সচ্ছল ছিল তেমনটা নয়, স্কুলজীবনেও তিনি নাকি খুব ভাল ছাত্র ছিলেন না। যদিও বছর পনেরো বয়েসে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে স্কলারশিপ জোগাড় করে নেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত চিন্তাধারা তাঁর জীবনে নিয়ে আসে শ্রেণিবিভাজনের জটিলতাবর্জিত সমাজের আস্বাদ। প্রথমে পাখি নিয়ে এগতে চাইলেও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গারের বই ‘হোয়াট ইজ লাইফ?’ তাঁর পড়াশোনাকে জেনেটিক্সের দিকে ঠেলে দেয়।
ডিএনএ-র অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছিল আগেই। আর, সেটা যে চাররকমের অণু– অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থাইমিন আর সাইটোসিন দিয়ে তৈরি– এ খবরও অজানা ছিল না। কিন্তু বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আগেও যে-সম্পর্কে কোনও সম্যক ধারণা ছিল না, তা হল: এই ডিএনএ-র গঠন ঠিক কেমন, আর তা কাজই-বা করে কী করে।
অনেক দিন চেষ্টা করেও কার্ডবোর্ডগুলো, যা আসলে চারটি অণুর অনুরূপ, তা এদিক-ওদিক লাগিয়ে, খুব সুবিধা হচ্ছিল না ওয়াটসনের। সেদিন বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে মডেলটার দিকে তাকানোর পর হঠাৎ তাঁর মনে হল– আরে, অ্যাডেনিনের সঙ্গে থাইমিন আর গুয়ানিনের সঙ্গে সাইটোসিন তো বেশ খাপ খেয়ে যাচ্ছে! মনের মধ্যে বেশ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লেও নিজেকে সংযত রাখলেন। অপেক্ষা করতে থাকলেন সহকর্মী ক্রিকের মতামতের জন্যে। ক্রিকের শ্যেনদৃষ্টিতে কোনও ত্রুটি চোখে পড়ে কি না। ক্রিক বুঝতে পারলেন– ওয়াটসনের সজ্জাপ্রণালী অনেকটা ‘ঘোরানো সিঁড়ি’ বা ‘ডাব্ল হেলিক্স’ কাঠামোর মতো, যেখানে দু’-ধরনের আণবিক শেকল একে-অন্যের বিপরীত সাজানো। উত্তেজনা ধরে রাখতে না-পেরে সেদিন বিকেলবেলায় স্থানীয় পানশালায় গিয়ে ঘোষণা করেন, তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন জীবনোদ্ভবের গোপন রহস্য– ‘দ্য সিক্রেট অফ লাইফ’।
তাঁদের এই রহস্যোন্মোচন যেন খুলে দেয় এক প্যান্ডোরার বাক্স, যেখানে একদিকে এই আবিষ্কারের সাহায্যে হাতে চলে আসে বিবর্তন রহস্যের চাবিকাঠি, আর সঙ্গে বহু দিনের দুই প্রশ্নের অধরা উত্তর, কীভাবে জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত থাকে আর কীভাবে সেই বৈশিষ্ট্যের প্রতিলিপি বংশপরম্পরায় ছড়িয়ে হয়। অন্যদিকে মাথাচাড়া দেয় ক্লোনিং, ‘জেনেটিকালি মডিফায়েড অরগ্যানিজম’ বা ‘জিএমও’-র নৈতিকতা নিয়ে বিতর্ক। মনে করা হয়, তাঁদের এই আবিষ্কার জীববিজ্ঞানের নিরিখে সর্বোচ্চ দুই তত্ত্ব– মেন্ডেলের বংশগতি ও ডারউইনের বিবর্তনবাদের সমতুল্য। তবে যেমন মুদ্রার দু’-পিঠ কখনও সমান হয় না, তেমনই এই মহান সাফলে্যর পিছনের কাহিনিও সম্পূর্ণ নির্দাগ নয়।
ওয়াটসন এবং ক্রিক যখন ক্যাভেন্ডিসের ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ সন্ধানে মত্ত, তখন লন্ডনেরই কিংস কলেজে আরও দু’জন ছিলেন একই উত্তরের খোঁজে– কেমিস্ট রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন, এবং বায়োফিজিসিস্ট মরিস উইলকিন্স। যদিও তাঁদের নিজেদের মধ্যে যে খুব একটা সদ্ভাব ছিল না।
রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন একজন অত্যন্ত কৃতী গবেষক এবং তাঁর ‘এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি’-র মাধ্যমে ছবি তোলার ক্ষেত্রে দক্ষতা ছিল অসাধারণ। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি প্রথম ডিএনএ-র ছবি তোলেন, যেখানে সর্বপ্রথম আভাস মেলে ডিএনএ-র ত্রিমাত্রিক সত্তার। মরিস উইলকিন্স মাঝেমধ্যেই ওয়াটসনের সঙ্গে নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করলেও, রোজালিন্ড তাঁর কাজের ফলাফল কারও সঙ্গে খুব একটা ভাগ করতেন না। ফলে এই রোজালিন্ড, খুব একটা পছন্দের পাত্রী ছিলেন না ওয়াটসনের। এমনকী, রোজালিন্ডের গবেষণাকেও ওয়াটসন খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন না। কিন্তু মূলত রোজালিন্ডের সহযোগীর গাফিলতিতেই ওয়াটসনের চোখে পড়ে যায় ডিএনএ-র আকারের মূল প্রমাণ, রোজালিন্ডের তোলা ‘ফোটো ৫১’। রোজালিন্ডের মতামতকে উড়িয়ে দিলেও সেই ছবি ওয়াটসনও এড়িয়ে যেতে পারেননি।
মনে করা হয়, রোজালিন্ডের এই ছবিই ওয়াটসন এবং ক্রিককে ডিএনএ-র ত্রিমাত্রিক গঠন আবিষ্কারের পথ দেখায়। ১৯৬২ সালে ওয়াটসন, ক্রিক এবং উইলকিন্স তাঁদের এই ঐতিহাসিক আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, চিন্তাশীল বৈজ্ঞানিকদের জগতে নিজেদের স্থায়ী জায়গা করে নেন। কিন্তু ১৯৫৭ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে জরায়ুর ক্যানসারে রোজালিন্ডের দেহবসান হয়। ফলে নোবেল পুরস্কারের স্বীকৃতি থেকে তিনি বঞ্চিত থাকেন।
লাগামহীন বাক্যচয়ন সবসময় ওয়াটসনকে বিতর্কের কেন্দ্রে রেখেছে। নিজের আত্মজীবনী ‘অ্যাভয়েড বোরিং পিপ্ল’ বইয়ে নিজের সহকর্মীদের ‘ডাইনোসর’, ‘ফসিল’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা শ্বেতাঙ্গদের থেকে কম বুদ্ধিমান! তিনি মনে করতেন, যদি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় কারও গর্ভস্থ সন্তান বড় হয়ে ‘সমকামী’ হতে পারে, তাহলে সেই সন্তানের গর্ভপাত করার সম্পূর্ণ অধিকার নারীর আছে। যদি পরবর্তীতে তাঁর মন্তব্যের সপক্ষে যুক্তি দেন, তিনি নাকি শুধু বলতে চেয়েছিলেন নারীদের আপন পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা!
ওয়াটসন-ই একমাত্র নোবেলজয়ী, যিনি ২০১৪ সালে নিজের নোবেল স্বর্ণপদক নিলামে তোলেন। কারণ হিসাবে দর্শান– পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী ষড় করে তাঁকে একঘরে করেছে। তাই তাঁর আর নোবেল পদকের প্রয়োজন নেই।
গত ৬ নভেম্বর আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে ৯৭ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ওয়াটসন। এমনই এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর বিভেদের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেওয়া দুষ্কর। আবার বিজ্ঞানের পরিসরে জেমস ওয়াটসনের প্রাসঙ্গিকতা এড়িয়ে যাওয়াও কঠিন।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, আশুতোষ কলেজ
