shono
Advertisement

সম্পাদকীয়: ভাঙা পায়ে খেলা

নন্দীগ্রামে এবার প্রার্থী হলে কেমন হয়-- সেটাও মমতার মাথায় এসেছিল হাঁটতে হাঁটতেই।
Posted: 02:47 PM Mar 17, 2021Updated: 02:47 PM Mar 17, 2021

কিংশুক প্রামাণিক: হাঁটলে তাঁর মাথা খোলে। নতুন আইডিয়া নাড়া দেয়। আবার গম্ভীর পদচারণা বিগড়ানো মেজাজ ঠান্ডা করে। হাঁটতে হাঁটতে জীবনের অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নন্দীগ্রামে এবার প্রার্থী হলে কেমন হয়– সেটাও মাথায় এসেছিল হাঁটতে হাঁটতেই। সোজাকথায়, হাঁটলেই তিনি সুস্থ থাকেন। হাঁটলেই ভাল থাকেন।

Advertisement

[আরও পড়ুন: বাংলায় জন্মেই শিশুর মাথায় ৫০ হাজার টাকার ঋণ]

সেই তিনি হাঁটছেন না। হাঁটতে পারছেন না। কবে নিজের ছন্দে হাঁটতে পারবেন, কেউ জানে না। তাঁর মনের অবস্থা কেমন হতে পারে– ভেবে শিউরে উঠছি। বাকিংহাম প্যালেসের সামনে সাদা শাড়ি পরা এক মহিলা হাওয়াই চটি পরে ফটফট করে হেঁটে হাইড পার্কের দিকে চলে যাচ্ছেন। খেয়াল করে দেখেছিলাম, নাক-উঁচু ইংরেজরাও সবিস্ময়ে তাকিয়ে। ইনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? সাহেবরা খুব স্বাস্থ্যসচেতন। পথে-ঘাটে-মাঠে সারাদিন দৌড়োদৌড়ি করেন। সাইক্লিং তাঁদের অভ্যাস। বেশি-বয়সিরা বেশি স্বাস্থ্যসচেতন। শুভ্রবসনা বিদেশিনিকে তাঁদের দেশে এভাবে দেখলে তাঁরা নজর করবেন, সেটাই স্বাভাবিক।

সেই মানুষকেই একদিন দেখা গেল টাইগার হিল অভিযানে। ক্লান্তিহীন হাঁটা। চড়াই-উতরাই কিছুই তার পথে বাধা হয় না। পেটা বুক, কড়া চিবুক, স্লিম কোমর আইপিএস-দের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তাঁদের তখন ওটাই ডিউটি। হাঁপিয়ে উঠছেন নিরাপত্তাকর্মীরাও। কিন্তু তিনি অবিচল! টাইগার হিল যেন সামিট। সামসিং থেকে খাড়া চড়াই ভেঙে এইভাবেই একবার মৌচুকি গিয়েছিলেন।

আসলে হাঁটাই তাঁর যাবতীয় সাফল্যের চাবিকাঠি। স্থান-কাল-পাত্রর দরকার নেই, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। একটু জায়গা পেলেই হল। নবান্নে যেদিন খুব ব্যস্ত থাকেন, নিজের ঘরেই চক্কর কেটে কেটে কাজ করেন। একবার দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে বিশাল লাউঞ্জে তিনি হাঁটছেন দেখে ব্যাটারিচালিত গাড়ি নিয়ে হাজির হন এক কর্মী। তাঁকে যখন বোঝানো হল, দেশের রেলমন্ত্রী এভাবে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে হেঁটে আদতে দিনে কুড়ি কিলোমিটার ওয়াকের কোটা পূরণ করছেন– তখন তিনি খুবই অবাক হন! রণে ভঙ্গ দেন। ফুটপাথে হাঁটতে খুব ভালবাসেন। কলকাতা বা জেলায় সম্ভব নয়। মব্‌ড হয়ে যাবেন। বিদেশে গেলে নিশ্চিন্তে হাঁটেন। বাড়িতে ট্রেডমিল আছে। তাতে বেশ স্পিডে এক ঘণ্টা দৌড়নো এই বয়সেও তাঁর কাছে কোনও বিষয় নয়। যদিও মুক্তবায়ুতে হাঁটতেই বেশি পছন্দ। সেই মানুষই হাঁটছেন না। হাঁটতে পারছেন না। হয় বসে নতুবা শুয়ে থাকতে হচ্ছে। পায়ে চোট পেয়ে কেমন আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

রাজনীতির ময়দানে তাঁর হাঁটা শুরু ১৯৮৪ সালে যাদবপুর কেন্দ্রে হেভিওয়েট সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে। তারপর দীর্ঘ সময়। নানা অধ্যায়। বর্তমানে সাধনার মতো রুটিন মেনে হাঁটারও একটা প্রেক্ষাপট আছে। ২০০৬ সালে ডিসেম্বরে অনশন করার পর অসুস্থ মমতাকে ভরতি করা হয় নার্সিংহোমে। সুস্থ হয়ে ময়দানে ফিরে আসার পর তাঁর চরম ডিসিপ্লিনড লাইফ শুরু। সম্পূর্ণ বদলে যায় জীবন। অনশন করার জন্য ওজন অনেক কমে যায় তাঁর। সামনে অনেক বড় লড়াই। সবার আগে প্রয়োজন নিজেকে সুস্থ রাখা। মমতা জীবনের নতুন রুটিন তৈরি করেন। হাঁটার সঙ্গে পরিমিত আহার। প্রয়োজনমতো শরীরচর্চা। নিজের ওজন আর বাড়তে দেননি তৃনমূলনেত্রী। গত ১৪ বছর তাঁর চেহারায় তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে যেমন ছিলেন, একুশে তেমনই আছেন।

সেই মানুষটার হৃদয় কীভাবে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, তা টের পেলাম ঝালদায় প্রথম নির্বাচনী সভায়। নন্দীগ্রামে প্রচারে তিনি আহত হন। বড় চোট লাগে বাঁ পায়ে। ঘটনা যা-ই হোক– তাঁর পায়ে আঘাত এতটাই যে, প্লাস্টার করতে হয়। ডাক্তাররা বেড রেস্ট দিয়েছিলেন অন্তত ২১ দিন। কিন্তু তিনি হুইলচেয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। খানিকটা নিরুপায় হয়েই এই সিদ্ধান্ত। প্রতিপক্ষ দলে অনেক মুখ আছে। একজন কেউ সামনে না এলেও সমস্যা হবে না। কিন্তু নীল-সাদা জার্সিতে মারাদোনা একটাই। ফলে তাঁকে ভাঙা পায়ে নামতেই হয়েছে ‘খেলা হবে’-র ময়দানে।

তিনি একবার আসা মানে খেলা ঘুরে যাওয়া। বাঁ পা-টা উঁচু করে রাখতে হবে। ঝোলানো বারণ। এই অবস্থায় কপ্টারে নামা-ওঠা কম ঝক্কির কাজ নয়। একটু এদিক-ওদিক হলেই চোট-আঘাত লাগবে। সভাস্থলে কপ্টার নামার পর একটি অস্থায়ী প্ল্যাটফর্ম সেট করা হচ্ছে– যাতে হুইলচেয়ারের চাকা গড়াতে পারে। মঞ্চে ওঠার জন্য ঢালু প্ল্যাটফর্ম থাকছে। মঞ্চ থেকে নামার সময় পিছন করে নামানো হচ্ছে। এসব যখন হচ্ছে, দৃশ্যত বিরক্ত লাগছিল মমতাকে। এভাবে কি এত বড় যুদ্ধ লড়া যায়? কিন্তু লড়ে নিচ্ছেন।

বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা তিনি দিতেই পারেন। প্রশাসনিক বৈঠকে এভাবে তিনি কথা বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু নির্বাচনী সভায় বসে বক্তৃতা কীভাবে সম্ভব! সেই জোশ আসবে কী করে? এই ধরনের সভায় মমতা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মঞ্চের চারপাশ ঘুরে বক্তৃতা দেন। তাঁর নানা ভঙ্গিমা আছে। অভিব্যক্তি আছে। মানুষ এভাবেই তাঁকে চায়। পায়ে প্লাস্টার নিয়ে অদ্ভুত এক চেয়ারে বসে সেই পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব নয়। স্বভাবতই তিনি মনের দিক থেকেও আহত। চোখে-মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণা। তা-ও প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট বললেন। স্লোগান দিলেন। হার না মানার যুদ্ধে ভাঙা পায়ের সংগ্রামই দস্তুর, বোঝালেন সেটাই।

এইভাবেই এখন অন্তত দু’-তিন সপ্তাহ চলবে প্রচার। তারপর প্লাস্টার কাটা হবে। কাটলেও সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়াতে পারবেন, তা মনে করার কারণ নেই। একটু সময় দিতেই হবে। কিন্তু মিছিলে হাঁটা? সবার হাঁফ ধরিয়ে এগিয়ে যাওয়া? সময় লাগবে অনেকটা। প্রতিপক্ষ নেতৃত্ব যখন গাড়ির মাথায় বসে রোড শো করেন, তখন নিজে হেঁটে মিছিল করেন মমতা। সেই মিছিল আপাতত হুইলচেয়ারে। তাঁকেই পথে থাকতে হবে। তিনি কাণ্ডারি। অদম্য জেদকে পাথেয় করে রাজনৈতিক জীবনে কঠিনতম ফুটবল ম্যাচ খেলতে নামছেন দিদি। ভাঙা পায়ে উদ্বুদ্ধ করছেন দলকে। নির্দিষ্ট করে দিচ্ছেন রাজনৈতিক নিশানা। সমর্থকরা তাই স্লোগান দিয়েছেন– সকল বাধা কেটে যাবে, ভাঙা পায়েই খেলা হবে।

[আরও পড়ুন: বাংলায় জন্মেই শিশুর মাথায় ৫০ হাজার টাকার ঋণ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement