সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধের নামে এক ডিজিটাল প্যানপটিকন নির্মাণ করেছে সরকার। ফলে, বিপন্ন আমজনতার মৌলিক গোপনীয়তা।
ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধ, ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ থেকে শুরু করে বেনামে পরিচালিত আন্তর্জাতিক প্রতারণা, দেশের নিরাপত্তা কাঠামোর সামনে নতুন সংকট তৈরি করেছে। ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপগুলির দুর্বলতা, বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে মোবাইলে সিম কার্ড না-থাকলেও অ্যাকাউন্ট সক্রিয় থাকে, সেই ফাঁক গলেই জালিয়াতরা সরকারি আধিকারিক সেজে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ‘নকল’ বা ‘ক্লোন’ করা ‘আইএমইআই’ নম্বর ব্যবহারের দেদার বাড়বাড়ন্ত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
এমতাবস্থায় সরকার কঠোর পদক্ষেপের দিকে ঝুঁকবে প্রত্যাশিত– ২৮ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রকের পরপর দু’টি বিজ্ঞপ্তি সেই প্রয়াসকে সামনে আনল। প্রথমটিতে বলা হয়েছে ‘সিম বাইন্ডিং’-এর কথা– অর্থাৎ যে কোনও মেসেজিং অ্যাপ থেকে সিম কার্ড বিচ্ছিন্ন হলেই সেই অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি নিরাপত্তা ব্যূহ, যদিও এতে সাধারণ ব্যবহারকারীদের অসুবিধা বাড়বে। কিন্তু দ্বিতীয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের। সেখানে বলা হয়েছে, স্মার্টফোনে বাধ্যতামূলকভাবে ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ ইনস্টল করতে হবে। বাজারে আসা নতুন হ্যান্ডসেটে সেটি প্রি-ইনস্টলড থাকতেই হবে। উদ্দেশ্য যতই শুভ হোক, বিপদের সম্ভাবনাই এখানে বেশি। বলা হচ্ছে, টেলিযোগাযোগ বিভাগের (‘ডিওটি’) এই ডিজিটাল সুরক্ষা অ্যাপ তৈরি করেছে। ভারতে মোবাইল ফোন চুরির অপরাধ-রোধে সহায়ক এই অ্যাপ। অ্যাপটি (Sanchar Saathi App) ভারতে হারিয়ে যাওয়া বা চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন ট্র্যাক ও পুনরুদ্ধারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে।
তবে নকল হ্যান্ডসেট বা ক্লোন আইএমইআই আটকানোর উদ্দেশ্য যতই সদর্থক হোক, চিকিৎসা এখানে রোগের চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে দঁাড়াতে পারে। কারণ নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, অ্যাপটির কোনও ফিচার নিষ্ক্রিয় করা যাবে না। এর অর্থ, অ্যাপটিকে অপারেটিং সিস্টেমে বিশেষ প্রবেশাধিকার দিতে হবে– যা ক্যামেরা, ফোন বা এসএমএসের মতো সংবেদনশীল উপাদানে প্রবেশের দরজা খুলে দেয়। এই প্রবেশাধিকারকে যদি রাষ্ট্রীয় নজরদারি বা কোনও ক্ষতিকর সাইবার আক্রমণ কাজে লাগায়, তবে বিপদ নিশ্চিত। ‘পেগাসাস’ ইস্যুতে যে-অভিজ্ঞতা দেশ ইতিমধ্যেই পেয়েছে, তা এই আশঙ্কাকে আরও গাঢ় করছে। চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া সংসদে স্পষ্ট করেছেন যে, ব্যবহারকারী চাইলে অ্যাপটি মুছে ফেলতে পারবেন। কিন্তু নির্দেশিকায় স্পষ্ট, অ্যাপটি ‘ডিজেবল’ করা যাবে না।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের জন্য তিনটি মানদণ্ড জরুরি: আইনগত ভিত্তি, প্রয়োজনীয়তা, ও সামঞ্জস্যতা। প্রশ্ন, ‘বিকল্প’ কি আছে? রয়েছে– ‘সঞ্চার সাথী’র ওয়েব পোর্টাল, এসএমএস ভিত্তিকযাচাই, ইউএসএসডি কোড। তাহলে বাধ্যতামূলক অ্যাপ কেন? সাইবার অপরাধ-রোধ অাবশ্যক, কিন্তু নিরাপত্তার নামে নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কোনও সভ্য রাষ্ট্রের পথ হতে পারে কি?
