সামান্থা প্রভু এবং রাজ বিয়ে করেছেন দ্বিতীয়বার। তাই নিয়ে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। একাধিক বিবাহের খবর মাত্রই যেন অদ্ভুত সুখ আর অসুখের কারণ! সুখটুকু নিংড়ে নিই প্রথমে। তারপর নখ-দাঁত শানিয়ে চলে আক্রমণ। কিন্তু কোনও অসম্মানজনক সম্পর্ককে বয়ে বেড়ানোর হার্ডল যখন কেউ পার করে, তখন সেই ব্যক্তির দ্বিতীয় বিয়ের আনন্দে শামিল হতে পারি না কেন? লিখছেন অরিতা ভৌমিক।
`আজ তাহলে আমরা কী নিয়ে কথা বলব?
–কেন শ্যামলী দে-কে নিয়ে!
–কে শ্যামলী দে?
–আরে, ওই তো সে-ই, যে ওই ২০২৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্’স ডে-তে তার পতিদেবের সঙ্গে ইনস্টায় ছবি দিল। তারপর লিখল– ‘I am blessed...’
–হ্যাঁ তো! তাতে কী হল?
–আর কী হল... আরে, ওর বর তো তখন আর ততটাও ওর বর ছিল না!
–হ্যাঁ, বুঝলাম। কিন্তু তাতে কার কী?
–কার কী মানে? আরে বাবা, শ্যামলী দে-র যে বর, মানে প্রাক্তন স্বামী সে তো পয়লা ডিসেম্বর আবার বিয়ে করল!
–ওঃ, তাই? তা নতুন বউ কেমন?
–ইস, আবার নতুন বউ! এটা তো সেই বউটার দু’নম্বর বর!
কী মনে হচ্ছে অ্যাদ্দুর এসে? বিন্তি পিসি আর মান্তু গপ্প করছে মনের সুখে খাওয়ার
পাতে এঁটো হাতে? না কি বিমলের চায়ের দোকানে পালদা আর নান্টুমাস্টারের আড্ডা
জমে উঠেছে?
বাড়ির খাওয়ার ঘর কিংবা পাড়ার চায়ের দোকান এটা নয়। সেখানেও এর চেয়ে ঢের জরুরি বিষয়ে কথা হয়। তা, সে রান্নার পদ বিশ্লেষণ হোক, বা ‘এসআইআর’-এর ফর্ম ভরা। এমন সব বিষয় উঠে আসে, যার সঙ্গে মানুষের রোজের যাপিত জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এই সবজান্তা গামছাওয়ালামার্কা গালগল্প আমরা হরবখত শুনতে পাই সোশ্যালের দেওয়ালে কান পাতলে। কখনও কখনও এসব গেরামভারি আলোচনার দাপটেই সোশ্যাল মিডিয়ার বাজার ভারি গরম হয়ে থাকে। অন্য পক্ষের ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া না-করা অ্যালগরিদম দেখিয়ে ছাড়ে সামান্থা রুথ প্রভু আর রাজ নিদিমোরুর বিবাহসংবাদ।
তবে সংবাদটুকু দিয়েই থেমে থাকা নয়। ফিড ভরে যায়। তবু ‘পেট ভরে গেছে’ বলার অবকাশটুকু অবধি না-দিয়েই পরপর আসতে থাকে প্রাক্তন স্ত্রীর তিন বছরের পুরনো পোস্ট। অথবা প্রাক্তন স্বামীর বর্তমান দাম্পত্য প্রেমের খুঁটিনাটি। আমরা ম্যাঙ্গো পিপ্ল সেসব খুঁটে খাই। কী সব অপার্থিব আনন্দ জাগে কে কত বড় ভিলেন কিংবা ভিকটিম, তা প্রমাণ করে! শব্দ জন্মায় না। আসলে ক্রমাগত বমি করি নিজেদের যাবতীয় হতাশা। পরোক্ষে অন্যকে টেনে নামিয়ে নিজের ভালত্ব প্রমাণের কদর্য খেলায় মাতি। একবছরের একরত্তিও ছাড় পায় না। কারণ, সে তার বাবার তৃতীয় বিবাহের সন্তান!
ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটের ট্রেন্ড বলছে, ভারতে দ্বিতীয় বিবাহে ইচ্ছুকদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। বিগত ৫ বছরে এই বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশেরও বেশি। বিবাহেচ্ছুকদের লিঙ্গভিত্তিক অনুপাতে অবশ্য এখনও যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। প্রতি ১০ জন দ্বিতীয় বিবাহেচ্ছুকদের মধ্যে ৭ জন পুরুষ, আর ৩ জন নারী।
পরিসংখ্যান কথা বলে। যাবতীয় শ্রী আর সমৃদ্ধির অন্তরালে সামাজিক প্রেক্ষাপট লিঙ্গবৈষম্যের চোরা ঘূর্ণিকে চিনিয়ে দেয়। চাঁদের মাটিতে সফল অভিযান চালানো ভারত, ইসরোর মহিলা বিজ্ঞানীদের অবদান স্বীকার করা ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় শাড়ি-পরিহিতা বিজ্ঞানীর রান্নার ছবি। বাহবার বন্যা বইতে থাকে। ‘যিনি রাঁধেন তিনি চুলও বাঁধেন’– জাতীয় হ্যাশট্যাগে আটক ও আক্রান্ত হয় একটা আস্ত দেশ। কিংবা প্যারালাল ভারচুয়াল ভারত। এই চু-কিতকিত চলতেই থাকে। আর ‘শাড়িতেই নারী’ না-হয়ে উঠতে পারার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ডিপ্রেশন নামে শহুরে চিলেকোঠায়।
সেলিব্রিটিদের জীবন নিয়ে কৌতূহল আগেও ছিল। এখনও আছে। পড়শি দম্পতির কনজুগাল লাইফ নিয়েই আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। তায় হেমা মালিনী-ধর্মেন্দ্র। কিন্তু এই কৌতূহল খানিক প্রসাদধর্মী কিংবা আনন্দলোকীয় গোত্রের। ক্রিস্প নিউজ পড়ে ইরোটিকার স্বাদ নিতে চাওয়া পেটরোগা বাঙালির সংখ্যা তো নেহাত কম নয়! সোশ্যাল মিডিয়াময় বেঁচে থাকায় লোকাস অফ কন্ট্রোল গেল বদলে। কে, কাকে, কখন, কেন, কীভাবে বিয়ে করলেন– সবটাই তো হাতের মুঠোয় এনে দিচ্ছে মুঠোফোন চোখের পলকে। ধীরে-সুস্থে ও কিস্তিতে জানার বা জানানোর দিন গিয়েছে। কিন্তু ডোপামিন রাশ তো চাই।
অতএব কেরদানির কলার তুলে শুরু হল মন্তব্য পেশ। কমেন্ট-পাল্টা কমেন্টে আড়াল হল মূল বক্তব্য। নিজেদের মাপ মতো না হলেই শুরু হল খাপ বসানো। সোশ্যালের আগল ভাঙা ডেটাসর্বস্ব দুনিয়ায় আমরা প্রত্যক্ষ করি ভার্বাল ডায়েরিয়ার প্রাদুর্ভাব। হ্যাশট্যাগ সামান্থা
রুথ প্রভু... হ্যাশট্যাগ রাজ... হ্যাশট্যাগ সেকেন্ড ম্যারেজ... হ্যাশট্যাগ হীরের আংটি ... হ্যাশট্যাগ প্রাক্তন... ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি অতি-জরুরি হ্যাশট্যাগ জুড়ে বসেছে ভারচুয়াল খাপ পঞ্চায়েত। কে ভিকটিম, আর কে ভিলেন– সব হিসাব করে ফেলছি আমরা জাস্ট আঙুলের আলতো ছোঁয়ায়।
বিজ্ঞান বলছে, পলিগ্যামির ব্লুপ্রিন্ট ছাপা রয়েছে আমাদের জিনে। কিন্তু সামাজিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তা সমস্যার। সম্পত্তির অর্জন ও অধিকারকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার তাগিদ থেকে বিবাহের উৎপত্তি। উৎপাদন ব্যবস্থার নিরিখে বিবাহ একটা ‘সামাজিক চুক্তি’। এই চুক্তি উৎপাদন ব্যবস্থার নির্দিষ্ট উপকরণের উপরে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অধিকারকে মান্যতা দেয়। সামাজিক স্টিরিওটাইপকে মান্যতা দিয়েই আমরা মনোগ্যামি প্র্যাকটিস করি। বিয়ে আর যৌনতাকে এক ব্র্যাকেটে বসাই। কিন্তু ভিতরের পশুটা মরে না কিছুতেই। তাই একাধিক বিবাহের খবর মাত্রই আমাদের অদ্ভুত সুখ আর অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুখটুকু নিংড়ে নিই প্রথমে।
তারপর নখ-দাঁত শানিয়ে চলে আক্রমণ। যত বেশি অবদমন, ততোধিক কদর্য ভাষায় চলে আক্রমণ আবডালহীন সোশ্যাল হ্যান্ডলে। কিংবা ভারচুয়ালের আড়ালটুকুই হয়তো আমাদের ভদ্দরলোকের মুখোশবিহীন হতে প্রলুব্ধ করে।
ভারতের মতো দেশে ডিভোর্সের হার ক্রমবর্ধমান। এর একটা কারণ যদি হয় মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, অন্যটি তাহলে অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গির বদল। জীবনের শেষতম দিন পর্যন্ত ভালবাসাহীন, অসম্মানজনক সম্পর্ককে বয়ে বেড়ানোর হার্ডলটা আমরা কোনওক্রমে পার করতে পেরেছি হয়তো। কিন্তু ডিভোর্সি নিকটাত্মীয়ার দ্বিতীয় বিয়ের আনন্দে শামিল হতে পারার মতো মন তৈরি করতে পেরেছি কি?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক শিক্ষক
aritabhoumick@gmail.com
