মল্লিকার্জুন খাড়গে ‘এক্স’ হ্যান্ডলে জানিয়েছেন, ১৮২০ সালে দেশের বড়লোক এক-তৃতীয়াংশর হাতে অায় ও সম্পদের ৭৩.২ শতাংশ ছিল। মধ্যবিত্ত এক-তৃতীয়াংশর হাতে ছিল অায় ও সম্পদের ১৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে মধ্যবিত্তর হাতে জাতীয় অায়ের মাত্র ১৪.৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ১৮২০ সালের চেয়ে কম। এর কারণ কী? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
গত এক দশকে দেশে মধ্যবিত্তর যে দুর্দশা হয়েছে, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। পরিস্থিতি প্রত্যেকে উপলব্ধি করে। বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার সবাই-ই। তবুও সম্প্রতি কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে তঁার ‘এক্স’ হ্যান্ডলে মধ্যবিত্তর করুণ দশা নিয়ে যে-পোস্টটি করেছেন, তা নতুন করে অনেকের চোখ খুলে দিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ডেটাবেস’ উদ্ধৃত করে খাড়গে দেখিয়েছেন, ভারতে মধ্যবিত্তর অায় ১৮২০ সালের নীচে চলে গিয়েছে। ১৮২০ সাল মানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অামল। ২০০ বছর পিছিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সতি্যই খুব চমকপ্রদ। ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট’-এ বিষয়টি অাগেই উঠে এসেছিল, কিন্তু এত দিন সবার নজর এড়িয়ে গিয়েছিল।
‘ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ডেটাবেস’ থেকে তিনি যে-তথ্যটি তুলে ধরেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে– ১৮২০ সালে দেশের বড়লোক এক-তৃতীয়াংশর হাতে অায় ও সম্পদের ৭৩.২ শতাংশ ছিল। মধ্যবিত্ত এক-তৃতীয়াংশর হাতে ছিল অায় ও সম্পদের ১৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে মধ্যবিত্তর হাতে জাতীয় অায়ের মাত্র ১৪.৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ১৮২০ সালের চেয়ে কম। দেশের বড়লোক এক-তৃতীয়াংশ করায়ত্ত করেছে মোট জাতীয় অায়ের ৭৭.৮ শতাংশ। অায়ের মাপকাঠিতে নীচের দিকে থাকা জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশর অবস্থা মধ্যবিত্তর চেয়েও খারাপ হয়েছে। ১৮২০ সালে তাদের ভাগে ছিল মোট অায়ের ১০.৮ শতাংশ, ২০২৩ সালে সেটা হয়েছে ৬.৪ শতাংশ।
ভারতের অার্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি নিয়ে সংখ্যাতত্ত্বর এই কচকচি নতুন বিষয় নয়। মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে অার্থিক সংস্কারের সময় থেকে অর্থনীতিবিদরা অাশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, মিশ্র অর্থনীতির পথ ছেড়ে খোলা বাজারের দিকে গেলেই অার্থিক বৈষম্য বাড়বে। কয়েক বছর পর থেকেই সেটা ঘটেছে। নানা তথ্য পরিসংখ্যান সামনে অাসছে। তারই রূপটা প্রকট হয়েছে। এখন এই বৈষম্য কমানোর ওষুধ কী হতে পারে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে অালোচনা শুরু হয়েছে। নিয়মিত নতুন-নতুন তত্ত্ব সামনে অাসছে। তঁার শাসনে গত এক দশকে অার্থিক বৈষম্য বাড়া নিয়ে সরল সমাধানের পথ বাতলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তঁার কথায়, ‘অাগে প্রায় সবাই গরিব ছিল। সেই অবস্থায় ফেরত যাওয়ার কোনও মানে হয় না। এখন কিছু লোক ধনী হয়েছে। বাকিরাও ধীরে-ধীরে ধনী হয়ে যাবে। কিছু দিন সময় লাগবে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেড়ে চলা অার্থিক বৈষম্য ও মধ্যবিত্তর অবলুপ্তির পথে যাওয়া নিয়ে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অাইনের অধ্যাপক ড্যানিয়েল মার্কোভিটসের বিশ্লেষণ বছর ছয়েক অাগে দুনিয়ায় সাড়া ফেলে। ‘মেধাতন্ত্রর ফঁাদ’ নিয়ে তিনি যে-বইটি লিখেছেন, ইদানীং এ দেশের সমাজবিজ্ঞানীদেরও তা উদ্বুদ্ধ করছে। চরম দারিদ্র থেকে মেধা ও পরিশ্রমকে সম্বল করে বড়লোক হয়ে ওঠার ‘অামেরিকান ড্রিম’ যে ক্রমশ একটি মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে– তা ব্যাখ্যা করেছেন মার্কোভিটস। অর্থাৎ ‘অ্যাপল’-এর প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জোবসের মতো ‘র্যাগস টু রিচেস’ হয়ে ওঠার কাহিনি যে মার্কিন সমাজে এখন একটি ফঁাদ ছাড়া কিছু নয়, তা ব্যাখ্যা করেছেন মার্কোভিটস। তঁার ব্যাখ্যায়, বাজারচালিত সমাজ এখন ক্ষমতার বণ্টন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মেধাতন্ত্র যে সবার সামনে দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণের সমান সুযোগ এনে দিচ্ছে, তা নয়। বরং ‘মেধাতন্ত্র’ একটি প্রযুক্তি-সামন্ত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। অভিজাত পরিবারের সন্তানরা সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতার শীর্ষে পৌঁছচ্ছে। সরকারি স্কুল-কলেজে পড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে।
মেধাতন্ত্রর ফঁাদ থেকে মার্কিন সমাজকে মুক্ত করার জন্য মার্কোভিটস-সহ তাত্ত্বিকরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে অারও ন্যায্য, উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার কথা বলছেন। এর জন্য উচ্চমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তি কম প্রতিযোগিতামূলক করার দাবি উঠছে। অল্প খরচে যাতে উন্নত মানের প্রশিক্ষণ মেলে তার দাবি উঠছে। অভিজাততন্ত্রর গ্রাস থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে বের না করে অানতে পারলে যে ‘মেধাতন্ত্রর ফঁাদ’ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না– সেই কথাও সোচ্চারে বলা হচ্ছে। এই তত্ত্বের প্রবক্তাদের বক্তব্য হল, “গণতন্ত্র মেধাতন্ত্রকে মুক্তি দেয়নি, বরং তাকে একটি ফঁাদে পরিণত করেছে। মেধাতন্ত্র তথা ‘মেরিটোক্রেসি’-র নামে বিরাজ করছে পরীক্ষার নম্বরভিত্তিক একটি ‘টেস্টোক্রেটিক’ ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিভার মূল্যায়ন হচ্ছে না, মধ্যবিত্ত ও কম অার্থিক ক্ষমতাসম্পন্ন ঘরের ছেলেরা প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে।” সমাজে গতিশীলতা অানতে, বৈষম্য কমাতে এঁরা মেধাতন্ত্রর বিদায় ঘণ্টা বাজাতে চাইছেন। মধ্যবিত্তর জন্য কম-দক্ষতার কাজ সৃষ্টির কথা বলছেন। যেমন ডাক্তারের চেয়ে অনেক বেশি নার্স নিয়োগের কথা বলছেন।
বৈষম্য কমানোর রাস্তা খুঁজতে অামাদের দেশের সরকার এইরকম সাহসী ভাবনাচিন্তাকে প্রশ্রয় দেবে কি না জানা নেই। ‘মেধাতন্ত্র নিপাত যাক’– এমন স্লোগান এখনও পর্যন্ত অামাদের সুশীল সমাজে শোনা যায় না। ‘মেধাতন্ত্রর ফঁাদ’ নিয়েও কেউ খুব একটা বিচলিত বলে মনে হচ্ছে না। বরং মোদির অামলে নয়া শিক্ষা নীতিতে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে অারও ধনী ও অভিজাতদের কুক্ষিগত করার রাস্তাই প্রশস্ত করা হয়েছে। ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’ যখন শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হয়ে দঁাড়াচ্ছে– তখন মেধাতন্ত্র যে গণতান্ত্রিক– সেই কথা বলা যাবে কী করে? কম দক্ষতা ও যোগ্যতার মানুষের জন্য কাজ সৃষ্টির দায়ও সরকারের রয়েছে বলে মনে হয় না। তাহলে বৈষম্য কমবে কীভাবে? ভারতের প্রেক্ষিতে এটা খুব জরুরি প্রশ্ন। কংগ্রেস সভাপতি শুধু বৈষম্যর ছবি প্রকাশ করেই দায় সারছেন। তাতে কাজ হবে না। ‘মেধাতন্ত্রর ফঁাদ’ গোছের তত্ত্ব নির্মাণ অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। এই দায়িত্বটা নিক দেশের অগ্রগণ্য চিন্তাবিদরা।