ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে সরকারি নিষেধাজ্ঞাই বারুদের স্তূপে আগুন দিয়েছে। অথচ ওলি সরকারের অপশাসনের প্রতি ক্ষোভ তো ছিলই। তা হলে এ বিপ্লব আগে হল না কেন? কাঠমান্ডুর রাজপথে কি আসল খেল দেখাচ্ছে কর্পোরেট! বলতে গেলে, মার্কিন টেক দানবরা? লিখলেন মণিশংকর চৌধুরী।
তরুণ তুর্কির তরবারি। ছিন্নভিন্ন রাজনেতাদের ধোঁকার টাটি। সর্বশক্তিমান মন্ত্রী-সান্ত্রীদের পালাই পালাই রব। দিন তিনেক ধরে নেপালে নাকি আরব বসন্তের ছোঁয়া! সংবাদমাধ্যম বলছে, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে সরকারি নিষেধাজ্ঞাই বারুদের স্তূপে আগুন দিয়েছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা-বাক স্বাধীনতার দাবি গর্জনে পরিণত হয়েছে। আর ওলি সরকারের অপশাসনের প্রতি ক্ষোভ তো ছিলই। এবং দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। এখানেই প্রশ্ন, রুজি-রুটি বা কাপড়া-মকানের থেকেও কি ফেসবুক জরুরি? হিমালয়ের বুকে ছোট্ট দেশটিতে কি সবাই খেতে পাচ্ছে? সবাই চিকিৎসা পাচ্ছে? তা হলে এ বিপ্লব আগে হল না কেন? জেন জেড কি ফেসবুক পেলেই খুশি? তাদের চাকরি চাই না? ৫ বাই ২ ইঞ্চির মুঠোফোনের খোলে রিলসের মায়াজগতেই কি তারা খুশি? নাকি কাঠমান্ডুর রাজপথে খেল দেখাচ্ছে কর্পোরেট! টু বি স্পেসিফিক. মার্কিন টেক দানবরা?
গত বছর বাংলাদেশে ছাত্র 'বিপ্লব' হয়। গদি হারান মুজিবকন্যা তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দাবি করেছেন, সেন্ট মার্টিন না পেয়ে আমেরিকাই নাকি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। তা ছাড়া, চিনের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করছিলেন হাসিনা। দেদার চিনা অস্ত্রও কিনেছিলেন তিনি। তাঁর আমলে বাংলাদেশে চিনা সংস্থাগুলোরও ছড়াছড়ি ছিল। তবে সেই অর্থে হালে পানি পায়নি মার্কিন কর্পোরেটগুলো। আরেকটু এগোলে দেখা যাবে ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কা। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাসভবন দখল করে নিয়েছে জনতা। দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে চিনপন্থী ওই নেতাকে। নিজের শাসনকালে লক্ষ লক্ষ ডলার মূল্যের বিদেশি রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। রপ্তানিকারীদের তালিকায় ছিল চিন, ভিয়েতনাম, নরওয়ে, ব্রিটেন ও জার্মানির মতো দেশগুলো। এবার নেপাল। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের কাছে রেজিস্ট্রেশন ফি চেয়ে গদি খোয়ালেন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি। ঘটনাগুলির মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে তেমন যোগ না দেখা গেলেও জটায়ুর মতো বলতেই হয়, ''হাইলি সাসপিশাস ব্যাপার মশাই।''
ইতিহাসের পাতায় অনেকটা জুড়েই কর্পোরেট 'কুকীর্তি'র কথা লেখা। কীভাবে মুনাফাখোরদের অঙ্গুলিহেলনে গণতান্ত্রিক সরকার হেঁচকি তুলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, কীভাবে 'ডিপ স্টেট' মানুষের মতবাদকে দুমড়ে মুচড়ে মেকি উত্থানের নাম দিয়েছে তা বহুলচর্চিত। ফিরে দেখলে ইরানের কথা মাথায় আসে। প্রায় সাত দশক আগে ১৯৫৩ সালে আমেরিকার সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল। কেন মোসাদ্দেক ইরানের তেলশিল্পের জাতীয়করণ করেছিলেন? যা আগে ব্রিটিশ মালিকানাধীন অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (বর্তমানে বিপি) এবং মার্কিন তেল সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। ওয়াশিংটনের আশঙ্কা ছিল, মোসাদ্দেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকেও ঝুঁকে পড়তে পারেন। এই পরিস্থিতিতে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করতে কর্পোরেটদের প্ররোচনায় একটি গোপন অভিযান চালায়। নাম ছিল ‘অপারেশন অ্যাজ্যাক্স’।
অভিযানের অংশ হিসেবে বিক্ষোভে ঘটাতে কোটি কোটি ডলার দেওয়া হয়। স্থানীয় পত্রিকায় প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়। ইরানের শাহ মহম্মদ রেজা শাহ পেহলভির প্রতি অনুগত সেনাকর্তাদের সমর্থন করা হয়। ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। অল্প সময়ের জন্য ইরান ছেড়ে যাওয়া শাহ আবার ফিরে এসে আমেরিকার সহায়তায় নিজের ক্ষমতা শক্তিশালী করেন। ১৯৫৪ সালে কর্পোরেট যুদ্ধের শিকার হয় গুয়াতেমালা। গদি হারাতে হয় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেকব আরবেনজকে। তাঁর ভূমি সংস্কার নীতিতে সিঁদুরে মেঘ দেখছিল মার্কিন সংস্থা 'ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি'। কারণ, দেশটির প্রায় ৪০ শতাংশ জমির মালিকানা ছিল সংস্থাটির হাতে। ফলে যা হওয়ার তাই হল। সমাজতন্ত্র রোখার নামে অপারেশন 'পিবি সাকসেস' শুরু করল সিআইএ। নকল অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরিয়ে দেওয়া হল আরবেনজকে। কর্পোরেটের কারবার নিরঙ্কুশ হল। '৭৩ সালে একইভাবে গদি হারাতে পয় চিলির সালভাদর এলান্দেকে। সিআইএ-র মদতে ক্ষমতায় বসেন সেনাশাসক পিনোচেত। নিকারাগোয়া, ইরাকের কথা নাই বা বললাম।
সব মিলিয়ে ধনতন্ত্রের জয়জয়কার যেন সর্বত্রই। ক্যাপিটালিস্ট আমেরিকা থেকে ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও কর্পোরেটই যেন শক্তির উৎস। রুশ ওলিগার্কদের খেয়াল ও বিলাসী জীবন রাজা মহারাজাদের ও হার মানায়। সোভিয়েতের পতনের পর রুশ বিলিওনেয়ার তথা 'তৈল দানব' মিখাইল খোদোরকভস্কির উত্থান যেন রূপকথা। তাঁর সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের লড়াই গল্পের উপাদান জোগায়। খাতায় কলমে চিন যদিও বা কমিউনিস্ট, সেখানে আজ ধনতান্ত্রিকদের রমরমা। ক্যাপিটেলিস্ট কায়দায় চলছে পার্টিতন্ত্র। তাই সংশয় জাগে, ঝকঝকে মোড়কে বিপ্লব কি বেসাতি মাত্র?
