জীবন সদা অনিশ্চিত। সে উড়ানের সঠিক রানওয়ে, জীবন-শেষের অভ্রান্ত সমাপ্তি-সরণি- কে জানে তারা ঠিক কোথায়।
রবিবার দুপুরে দিল্লি এয়ারপোর্টে এক ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটতে পারত। আফগানিস্তান থেকে উড়ে আসা আরিয়ানা আফগান এয়ারলাইনসের যাত্রী ভর্তি 'এয়ারবাস ৩১০' নেমে এল ভুল রানওয়েতে। সেই রানওয়েতেই অন্য একটি বিমান। শিউরে উঠল এয়ারপোর্টের কর্মীরা মুখোমুখি সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখে। শেষ মুহূর্তে যদিও সংঘর্ষ হওয়া আটকানো যায়।
যে কোনও উড়ানই জীবনের মতো অনিশ্চিত। অথচ উড়ান এবং জীবন কোনওটাতেই আপাত নিশ্চয়তারও অভাব নেই। চারবারের 'ফিল গুড' ব্যবস্থা বেশ নিশ্চিন্তেই রাখে আমাদের। তবু এ-কথাও ঠিক, বাড়ি থেকে বেরলেই, ট্রেনে বা প্লেনে আরও দূরের যাত্রা শুরুর আগে, অধিকাংশ মানুষের মধ্যে কোথাও একটা অনিশ্চয়তার ছায়াপাত ঘটেই। যেন নিরাপদে পৌঁছতে পারি, এমন একটা প্রার্থনাও জাগে মনে। অতি বড় নাস্তিকও হয়তো এমন সময় নিজেকে সমর্পণ করে অদৃশ্য শক্তির কাছে। প্রত্যেকেরই, বিশেষ করে দীর্ঘজীবীদের জীবনে আসে এক অনিবার্য প্রশ্ন, ঠিক রানওয়ে কি পেয়েছিলাম জীবন-শুরুর উড়ানে। অথবা, জীবন-প্রান্তে ল্যান্ডিংয়ের সময় এই প্রশ্নও মানুষের মনে উদয় হতেই পারে, যেসব স্বপ্ন নিয়ে উড়েছিলাম, সেসব স্বপ্নের সার্থকতার মধ্যে ঠিক রানওয়েতে নামতে পারলাম। জীবন-উদ্ভানের সঠিক রানওয়ে, জীবন-শেষের অভ্রান্ত সমাপ্তি-সরণি- কে জানে তারা ঠিক কোথায়।
আলব্যের কামু 'দ্য রং সাইড অ্যান্ড দ্য রাইট সাইড'-এ জীবন প্রসঙ্গে এই গভীর এবং দূরুহ প্রশ্নটাই তুলেছেন। জীবনের প্রারম্ভিক উড়ানের এবং সমাপ্তির ল্যান্ডিংয়ের সত্যিই কি আছে কোনও বেঠিক সঠিক, ভ্রান্ত এবং অভ্রান্ত। তারপর আরও এক পা এগিয়ে গিয়ে বলছেন, 'আই ডু নট ওয়ান্ট টু চুজ বিটউইন দ্য রাইট আঅ্যান্ড দ্য রং সাইডস'। কেননা ওইভাবে বেছে নেওয়া যায় না। কারণ জীবনের বুনন চলেছে নি অফুরন্ত স্ববিরোধ ও বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে। জীবনের 'অ্যাবসার্ডিটি' বা আবোল-তাবোল রীতিই সেটা। এই নিরর্থ অ্যাবসার্ডিটির মধ্যে 'আই ডু নট লাইক আ চয়েস টু বি মেড' বললেন কামু।
জীবনের শুরুতেই এক অসাধারণ প্রতিভার রানওয়ে পেয়েছিলেন অস্কার ওয়াইল্ড। এবং তিনি বেছে নিয়েছিলেন লন্ডনের সর্বোচ্চ সামাজিক উচ্চতায় এক সফল রঙিন বিলাসের জীবন। তাঁর সেই উন্মীল উড়ান চমকে দিয়েছিল। কিন্তু এক প্রান্ত রানওয়েতে নেমে এল তাঁর উড়ান। তাঁর জেল হল সমকামের জন্য, যেজন্য এখন আর কারও জেল হয় না। অথচ জীবনের শেষে আত্মজীবনীমূলক লেখা 'ডে প্রোফানডিস'-এ, তিনি লিখে গেলেন, হে বাতাস উড়িয়ে দাও সমাজের বুক থেকে আমার সমস্ত পদচিহ্ন, যেন আমার নির্জন নির্বাসনে গোপন গুহার নাম কেউ না খুঁজে পায়। আর রবীন্দ্রনাথ- যিনি বিপুল আস্থা ও প্রত্যয়ের রানওয়ে থেকে উড়েছিলেন প্রবল প্রতিভার ডানায় অনির্ণেয় পথে, ল্যান্ড করলেন অবিশ্বাসের রানওয়েতে অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে, সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার!
