‘সেমিকোলন’ একটি বিরামচিহ্ন, যেখানে লেখক চাইলেই বাক্য শেষ করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। তার বদলে একটু থেমে আবার লিখে গিয়েছেন– কিছু বলার এখনও বাকি। ‘অক্সফোর্ড’ অভিধানের ভাষায়, ‘সেমিকোলন’ হল বাক্যের এমন এক বিরতি, যা পূর্ণচ্ছেদের মতো চূড়ান্ত নয়। কারও শরীরে যদি ‘সেমিকোলন’ ট্যাটু দেখতে পান, তাকে সম্মান করুন, বুঝুন, তিনি ভয়ংকর দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে জীবনতরি সচল রেখে এগিয়ে চলেছেন। লিখছেন সঙ্গীতা সরকার।
সেদিন মেট্রো রেলে যেতে যেতে আমার এক সহযাত্রীর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল একটি ট্যাটু। হাতের পাতার উপর, বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ার কাছে খোদাই করা ছোট্ট একটি সেমিকোলন– ‘;’। অজান্তেই চোখ চলে গেল তার চোখের দিকে। মায়াময় দৃষ্টির গভীরে ছিল এক অদ্ভুত মিশ্র ভাষা– বেদনা ও আশার, হেরে যাওয়া আর টিকে থাকার একসঙ্গে বলা গল্প। কত কিছু বুঝিয়ে দিল সেই ছোট্ট চিহ্নটি! মানুষের শরীরে ট্যাটু এখন আর নিছক সাজ নয়– বরং অনুভূতির, সহমর্মিতার, সাহসের এবং বেঁচে থাকার প্রতীক।
‘সেমিকোলন’ (;) আসলে এক বিরামচিহ্ন, যেখানে লেখক চাইলেই বাক্য শেষ করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। তার বদলে তিনি একটু থেমে আবার লিখে গিয়েছেন– কিছু বলার এখনও বাকি। ‘অক্সফোর্ড’ অভিধানের ভাষায়, ‘;’ বা ‘সেমিকোলন’ হল বাক্যের এমন এক বিরতি, যা পূর্ণচ্ছেদের মতো চূড়ান্ত নয়।
এই ব্যাকরণগত অর্থের ভিতরেই লুকিয়ে আছে জীবনের গভীর দর্শন। জীবনেও তো এমনই হয়– থেমে যাওয়া যায়, শেষ করে দেওয়া যায়, কিন্তু আমরা অনেকেই আবার কলম তুলে নিই, জীবনের পাতায় নতুন বাক্য শুরু করি। সেমিকোলন যেন বলছে, ‘তুমি তোমার জীবনের লেখক। তুমি থামতে পারতে, কিন্তু থামোনি। তোমার গল্প এখনও শেষ হয়নি।’
এই একটিমাত্র চিহ্নকে কেন্দ্র করেই ২০১৩ সালে শুরু হয়েছিল এক বিশ্বব্যাপী আন্দোলন– ‘প্রোজেক্ট সেমিকোলন’। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণী এমি ব্লুয়েল। এমির জীবন ছিল এক দীর্ঘ অন্ধকারের গল্প। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, অবসাদ, একাকিত্ব– সবকিছুর মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন তিনি। বাবা আত্মহত্যা করেন, যা এমির জীবনে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
জীবনের বহু মুহূর্তে তিনিও হাল ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একদিন তিনি বুঝলেন– কষ্ট থেকে পালানো নয়, বরং তার সঙ্গে লড়াই করাই জীবনের প্রকৃত সাহস। তিনি উপলব্ধি করলেন, পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ আছে, যারা তঁার মতোই মানসিক যন্ত্রণায় জর্জরিত। তাদের পাশে দঁাড়াতে, তাদের জানাতে যে– ‘তুমি একা নও’– তিনি তৈরি করলেন এই আন্দোলন– ‘প্রোজেক্ট সেমিকোলন’।
এই ট্যাটু তাই শুধুই শরীরের অলংকার নয়, বেঁচে থাকার প্রতীক। যিনি এটি পরেছেন, হয়তো কোনও এক কঠিন অধ্যায়ে জীবনের প্রতি আশা হারিয়েছিলেন– আত্মহত্যার চিন্তা এসেছিল মনে, পথ হারিয়েছিলেন মানসিক অন্ধকারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরে তাকিয়েছেন জীবনের দিকে। ‘সেমিকোলন’ তঁার জীবনের সেই মুহূর্তের প্রতীক, যখন তিনি নিজের গল্প শেষ না করে আবার লিখতে শুরু করেছেন। কেউ এটি হাতে, কেউ কবজিতে, কেউ বুকের কাছে বা গলায় অঁাকেন– যেন প্রতিদিন নিজের চোখে পড়ে, আর মনে করিয়ে দেয়, ‘আমি থেমে যাইনি, আমি এখনও চলছি।’
আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কখনও-না-কখনও আসে কষ্ট, ব্যর্থতা, একাকিত্ব। কেউ ভালবাসায় হারে, কেউ জীবনের লড়াইয়ে। কিন্তু কিছু মানুষ এই যন্ত্রণার ভার বইতে না পেরে শেষ করে দেয় নিজের গল্প– ‘আত্মহত্যা’-র ভয়ংকর সিদ্ধান্তে। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’-র তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৮ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে– অর্থাৎ প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন। এটি এক নীরব মহামারী– যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে– পরিবার, বন্ধু, সমাজ– সর্বত্র। মানসিক অসুস্থতা, বিশেষ করে ডিপ্রেশন ও উদ্বেগ, এখন এক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, ভারতে এখনও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা হয় না। আমাদের সমাজে মনখারাপকে প্রায়ই দুর্বলতা হিসাবে দেখা হয়। কেউ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে মানুষ চুপিচুপি বলে, ‘ওর নাকি একটু সমস্যা আছে।’ অথচ মানসিক অসুস্থতা যেমন বাস্তব, তেমনই শারীরিক ব্যথাও বাস্তব। একটিতে আমরা ওষুধ খাই, অন্যটিতে লজ্জা পাই– পার্থক্য শুধু আমাদের মানসিকতায়।
‘প্রোজেক্ট সেমিকোলন’ আসলে এই নীরবতা ভাঙার বার্তা দেয়। এমি চেয়েছিলেন মানুষ যেন বুঝতে পারে– কষ্ট বা ডিপ্রেশন লজ্জার নয়, বরং সাহায্য চাওয়াই সাহসের পরিচয়। মনোবিজ্ঞানী এডউইন শ্নাইডম্যান বলেছিলেন, ‘আত্মহত্যা জীবনের ইচ্ছার মৃত্যু নয়, কষ্ট থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।’ সত্যিই, যে মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবে, সে বাঁচতে চায়– কেবল যন্ত্রণার অবসান চায়। তাই সমাজের দায়িত্ব তাদের পাশে দঁাড়ানো, মন খুলে শোনা, এবং জানানো– ‘তুমি একা নও’।
২০১৩ সালের সেই ছোট উদ্যোগ এখন এক আন্তর্জাতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ভারত, অস্ট্রেলিয়া– সর্বত্র তরুণ প্রজন্ম এই প্রতীকের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেছে। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও হাসপাতাল মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার অংশ হিসাবে ‘সেমিকোলন ডে’, ‘মেন্টাল হেলথ উইক’, বা ‘সাইলেন্ট হোপ ক্যাম্পেন’ পালন করছে। শিক্ষার্থীরা সেখানে নিজের গল্প বলছে, কবিতা লিখছে, চিত্র অঁাকছে, এবং একে-অপরের পাশে দঁাড়াচ্ছে। শিল্পী, লেখক, থেরাপিস্ট, সাধারণ মানুষ– প্রত্যেকে যন্ত্রণাকে প্রকাশ করছে এই এক ছোট্ট প্রতীকের মাধ্যমে। এমন প্রতীকী সংযোগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সহপাঠী নানা নেটওয়ার্ক অনেক সময় একে-অপরের মধ্যে খোলামেলা কথা বলার সুযোগ তৈরি করে, লজ্জা বা সামাজিক কলঙ্কের দেওয়াল ভাঙে, এবং সাহায্য চাইতে শেখাকে স্বাভাবিক করে তোলে।
তবে এই আন্দোলন কেবল একটি ‘প্রতীক’ নয়, বরং এক মানসিক বিপ্লব। এটি শেখায়– কষ্ট বাস্তব, কিন্তু তার মধ্যেও আলো খোঁজা সম্ভব। এটি সহমর্মিতার ভাষা– যেখানে আমরা শিখি অন্যের ব্যথা বুঝতে, সহানুভূতির হাত বাড়াতে, এবং বলতে যে– ‘তুমি একা নও’।
তাই এখন যদি কারও শরীরে সেমিকোলন ট্যাটু দেখতে পান, সম্মান করুন তাকে। হয়তো সে জীবনের এক ভয়ংকর যুদ্ধ জিতে এসেছে। হয়তো সেই ছোট্ট চিহ্নের আড়ালে আছে অগণিত না-বলা কান্না, আর এক অদম্য বেঁচে থাকার ইচ্ছা। মনে রাখুন, কখনও-কখনও একটি ফোন কল, একটু আলিঙ্গন, কিংবা সামান্য সরল কথা, বঁাচিয়ে দিতে পারে একটি জীবন। ‘সেমিকোলন’ আমাদের শেখায়– জীবন মাঝপথে থেমে যেতে পারে, কিন্তু গল্প শেষ হয় না। কারণ গল্পটা এখনও চলছে, আর কলমটা এখনও আমাদের হাতেই।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক মনোবিদ
saaangita@gmail.com
