ইতিমধ্যেই যে ভোটাধিকার পেয়েছে, তাকে কেন নতুন করে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে? একজন প্রাপ্তবয়স্ক, আত্মনির্ভর ব্যক্তিকে কেন দিতে হবে তার বাবার ‘এপিক নম্বর’? বংশলতিকা যদি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে ব্যক্তির মায়ের বংশলতিকা এখনও গুরুত্বহীন কেন? তাহলে কি ঘুরেফিরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজই গড়ে তোলার ফিকির চলছে? লিখছেন ভাস্কর মজুমদার।
ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ
ওমা তোমার চরণ দু’টি বক্ষে আমার ধরি
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।
ভারতের সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্রের এক জ্যোতিষ্কসম রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। বহু দেশে যখন ‘ভোটাধিকার’ ধাপে ধাপে প্রাণ পেয়েছিল, মেয়েরা তা পেয়েছিল অনেক দেরিতে– সেখানে ভারতে যবে থেকে ভোটাধিকারের শুরু– সেদিন থেকেই জাতি-ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলে সমমানের ভিত্তিতে ভোট দেওয়ার অধিকার প্রাপ্ত হয়েছিল। এখানে কেউ ছোট, কেউ বড় নয়। এবং কারও সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বেশি বলে সে দুটো ভোটাধিকার বেশি পাবে, এমনও নয়। ভারত রাষ্ট্র ও সমাজে যত বৈষম্যই থাকুক না কেন, নির্বাচনের সময় প্রত্যেকের যে একই অংশগ্রহণ থাকবে, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি ইতিবাচক দিক। আর, ভারতে কেউ ভোটাধিকার পেয়েছে মানে– সে এ-দেশের একজন পূর্ণ নাগরিক। এ-দেশে কেউ যদি জন্মগ্রহণ করে থাকে, তবে সে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই এখানকার নাগরিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও আরও কিছু রাজ্যে চলা সাম্প্রতিক ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’-এর আবহে মনে হচ্ছে– নাগরিকত্বের সংজ্ঞা কিছু অংশে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনে হঠাৎ ২০০২ সালটিকে একটি প্রামাণ্য বছর হিসাবে ধরা হয়েছে। ওই সময় কারও ভোটার তালিকাতে নাম ছিল কি ছিল না, তা এখন বিচার্য। তার কারণ খুব অস্পষ্ট নয়। যেহেতু ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর উদ্যোগে নাগরিকত্ব আইন পাশ হয়েছিল এবং তখন থেকে কোনও ভারতীয়র নাগরিকত্ব শুধু তার এ-দেশে জন্মগ্রহণে নয়, তার মা-বাবাও দেশের নাগরিক কি না তা বিচার্য হয়ে উঠল, তাই ২০০২ সালটিকে প্রামাণ্য বছর হিসাবে ধরে ২০২৫ সালের বিশেষ নিবিড় সংশোধন চলছে। অথচ ২০০২ সালে হওয়া নিবিড় সংশোধনের জন্য তার আগের সর্বশেষ সংশোধনীটিই ব্যবহৃত হয়েছিল! আপত্তি এখানেই।
যে-মানুষগুলি ২০০২ সালের পর ভোটাধিকার পেয়েছে এবং তারপরে সারা দেশ জুড়ে এতগুলো নির্বাচন হয়েছে তাদের অংশগ্রহণে, তাদেরই ভোটাধিকার কেন পুনরায় প্রশ্নের মুখে পড়ল? তাকে বা তাদের নতুন করে কেন সবকিছু জমা করতে হবে, বা কাগজ তৈরি রেখে নিজের নাগরিকত্বর প্রমাণ নিজেকেই দিতে হবে? দ্বিতীয়ত, এনিউমারেশন ফর্মটিতে প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যক্তির বাবা এবং মায়ের নাম। বিশেষত, বাবার বংশলতিকা। কথা হল, সম্পর্কের নানারকম টানাপোড়েনে, সামাজিক উচ্চাবচ-হেতু একজন নাগরিকের তার মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক না-ই থাকতে পারে। একজন নাগরিক যে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে নিজের পায়ে দঁাড়িয়ে গিয়েছে মা-বাবার পরিচয়কে গৌণ করে, তাকে কেন ফিরে তাকাতে হবে, যখন সে ইতিমধ্যেই ভোটাধিকার পেয়েছে? কিংবা কোনও ব্যক্তির মা এবং বাবার দাম্পত্য সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, কারও মা-বাবার যৌথজীবন না থাকতে পারে, এবং সেই বিষণ্ণ সময় কাটিয়ে উঠে সেই ব্যক্তি হয়তো জীবনে এগিয়ে গেল বাবার পরিচয়কে তুচ্ছ করে, তাকেই-বা কেন সেই বাবার কাছে ফিরতে হবে বাবার ‘এপিক নম্বর’টির জন্য? এ কি তার এবং তার মায়ের আত্মসম্মানের হানি নয়? এমন করে কেন এনিউমারেশন ফর্মটি তৈরি হল না, বিশেষত যার ভোটাধিকার আছে, যেখানে সেই ব্যক্তিটির নিজের পরিচয়ই প্রধান, তার মা-বাবার পরিচয় নয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কি এটুকু মর্যাদা প্রাপ্য নয়? আর বংশলতিকা যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে ২০২৫ সালে দঁাড়িয়ে ব্যক্তির মায়ের বংশলতিকা এখনও এত গুরুত্বহীন কেন?
এনিউমারেশন ফর্মে যা চাওয়া হচ্ছে এবং যা গুরুত্ব পাচ্ছে, তাতে ভারতে যে এখনও লিঙ্গসাম্য কত অমিল, সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে বারবার। রাষ্ট্র কি তবে মা-বাবা আর সন্তানের এক অলীক স্বপ্নে বিভোর– যেখানে ‘পরিবার’-এর আর কোনও সংজ্ঞা থাকতে পারে না? আর, বাবার বংশলতিকা যদি ভোটাধিকার আর নাগরিকত্বে এত গুরুত্ব পায়, তবে তো সেই ঘুরেফিরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজই গড়ে তোলার ফিকির চলছে বলে ধরে নিতে হয়।
অথচ, কোথাও আবার ধর্মগুরুকে ‘পিতা’ হিসাবে বিবেচনা করা যাচ্ছে! এই পশ্চিমবঙ্গেই একটি ধর্মীয় সংস্থার এনিউমারেশন ফর্মে বহু ‘ভোটারের পিতা’ হিসাবে তাদের ধর্মীয় গুরুর নাম দেখা গিয়েছে। ভারতীয় ঐতিহ্য রূপে তাতে যদি অসুবিধা না থাকে– তবে সংগীত, নৃত্য ও হিজড়া সমাজে গুরুবাদী মানসিকতার যে প্রাধান্য, তা রাষ্ট্র স্বীকার করে নিলে, তারাও মাতা-পিতার জায়গায় গুরুর নাম লিখতে পারবে তো?
ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের দায়িত্ব কেবল রাষ্ট্রের হাতে। নির্বাচন কমিশনের মতো তথাকথিত স্বশাসিত সংস্থা কখনওই এ-কাজ করতে পারে না। তাহলে যে-প্রক্রিয়ায় এত
বছর ভোটার তালিকা সংশোধিত হয়েছে অনুচ্চকিতভাবে কেবলমাত্র মৃত ভোটার, পরিযায়ী ভোটার ইত্যাদি চিহ্নিত করার জন্য, সেটাই বা এখন কেন হচ্ছে না? তাছাড়া, বিশেষ নিবিড় সংশোধন কেবলমাত্র এক সময় একটি মাত্র জায়গা জুড়ে হতে পারে, তাও আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে সে-জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জনসংখ্যার অস্বাভাবিক পরিবর্তন এলে। সেখানে নানা রাজ্য জুড়ে সেই রাজ্যে ভোটের কিছু মাস আগে এমন বৃহৎ কর্মকাণ্ড কী করে চলতে পারে, তাও আবার একটি মাসের মধ্যে সব কাজ শেষ করার শপথ নিয়ে?
বিশেষ নিবিড় সংশোধন শুরু হওয়ার একটি কারণ চারিদিক ঘুরপাক খাচ্ছে। ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, নাকি প্রচুর অনুপ্রবেশকারী। এই তত্ত্ব ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তার সরকার বহু বছর আওড়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনুপ্রবেশের ‘সঠিক’ পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। বলা হয়, অনুপ্রবেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিসংখ্যান ছাড়া অহেতুক প্রচার আসলে মানুষের মধ্যে ভীষণরকম ‘জেনোফোবিয়া’ (বিদেশাতঙ্ক) বাড়িয়ে দেয়। হিটলারের জার্মানিতে মানুষ মনে করত, তাদের চারিদিকে ইহুদি বেড়ে গিয়েছে, আটের দশকে অসমে মনে করা হত তাদের চারপাশে প্রচণ্ড পরিমাণে বাঙালি– যারা অহমিয়াদের সব কাজ নিয়ে নিচ্ছে, নয়ের দশকে রোয়ান্ডাতে সংখ্যাগুরু হুটুরা মনে করত তাদের চারিদিকে বহু টুটসি জনজাতির মানুষ বেড়ে গিয়েছে। এতে মানুষ একে-অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে দ্রুত। গণহিস্টিরিয়া তৈরি হতে পারে। কলকাতার প্রান্তে যেমন সেই হিস্টিরিয়া আক্রান্ত বহু মানুষ রোহিঙ্গা দেখতে পাচ্ছে! কিংবা ঘর বন্ধ করে কেউ কাজে গেলেই টিভি চ্যানেল এসে বলে দিচ্ছে– ‘এসআইআর’-এর জন্য অনেকে বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছে!
এবারের বিশেষ নিবিড় সংশোধনের চারিধারে মানবাধিকার, মানুষের আত্মমর্যাদা, নাগরিকত্বের সংজ্ঞা এবং পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বিষয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ভারতের মতো এমন বহুস্তরীয় দেশে এত তাড়াহুড়ো করে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলে তা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আপন দেশের উপর অধিকার প্রতিটি নাগরিকের ন্যায্য– কোনও মুষ্টিমেয়র নয়, তা যারা ভুলিয়ে দিতে চায়, তাদেরও শেষকালটা যে ভালো হয় না, ইতিহাস সেই সাক্ষ্য বহন করে।
(মতামত নিজস্ব)
