shono
Advertisement
Bangladesh

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড এবং ভারত-বাংলাদেশ কূটনীতি

দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে সেই ২০১৩ সাল থেকে।
Published By: Kishore GhoshPosted: 08:07 PM Nov 19, 2025Updated: 08:07 PM Nov 19, 2025

মৃত‌্যুদণ্ডের রায় পেলেন শেখ হাসিনা। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দাবি হাসিনার প্র‍ত্যর্পণ। দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে সেই ২০১৩ সাল থেকে। তবে ভারত যদি মনে করে হাসিনা ও-দেশে সুষ্ঠু বিচার পাবেন না, তাহলে চুক্তি সত্ত্বেও তাঁকে ফেরত না দেওয়ার অধিকার ভারতের থাকছে। তা জেনেশুনেই বাংলাদেশ দেশবাসীকে দেখাতে চায় ‘পতিত স্বৈরাচারী’-কে দেশে ফেরত আনার চেষ্টায় ঘাটতি রাখা হচ্ছে না। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। একইরকম সাজা পেয়েছেন তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এই বিচার প্রত্যাশিতই ছিল। হাসিনাও জানতেন এমনই কিছু একটা হবে। কাজেই কেউ অবাক হননি।
এই মামলায় হাসিনার বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল–
১) উসকানিমূলক বক্তব্য প্রকাশ,
২) জুলাই আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ,
৩) রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা,
৪) রাজধানী ঢাকার চানখঁারপুল এলাকায় ছ’জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা
এবং
৫) আশুলিয়ায় ছ’জনকে পুড়িয়ে মারা

উসকানিমূলক বক্তব্যজনিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয় ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ প্রমাণিত হওয়ায়। বাকি অপরাধগুলির জন্য তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁর সঙ্গে সাজা পেয়েছেন আসাদুজ্জামান খানও।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশ প্রধান ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
তাঁর সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচ বছর। তিনি এই মামলায় রাজসাক্ষী হন। জবানবন্দিতে বলেছেন, আন্দোলন দমাতে গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত ছিল খোদ প্রধানমন্ত্রীর। সেই নির্দেশের কথা তাঁকে দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি নির্দেশ পালনে বাধ্য হয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা রুজু হয়েছিল গত বছরের ১৭ অক্টোবর। ৩৯৭ দিন পর সেই মামলার রায় বেরনোয় দেশের জায়গায় জায়গায় মানুষ যেমন উল্লসিত হয়েছে, মিষ্টি বিলিয়েছে– তেমনই কোথাও কোথাও জনতাকে ক্ষোভপ্রকাশ করতেও দেখা গিয়েছে। দেশের বাইরে থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা নির্দেশ দিয়েছিলেন বিক্ষোভ দেখানোর। ‘লকডাউন’ করার। গত ক’-দিন ধরেই চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলেছে। বেশ কিছু গাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে।

গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ করা হয়েছে। অতি সাহসী আওয়ামী লীগ সমর্থক কর্মীরা ঝটিকা মিছিল করেছেন। অনেকে গ্রেফতারও হয়েছেন। খোদ হাসিনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এই রায় পক্ষপাতদুষ্ট। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অনির্বাচিত সরকারের অধীনস্ত অবৈধ ট্রাইবুনালের এই রায় তিনি খারিজ করছেন।

ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে ইউনূস সরকার বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচন করাতে চাইছে। তার আগে হাসিনার বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের বিচারের রায় আসা রাজনৈতিক দিক থেকে জরুরি ছিল। সেই কাজটা সাঙ্গ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনা ও আসাদুজ্জামানকে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছে। এমন দাবি ও অনুরোধ তারা আগেও করেছে। এবার করা হল ট্রাইবুনালের রায়ের ভিত্তিতে। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়ে বলেছে, সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কোনও দেশ
আশ্রয় দিলে তা ‘অত্যন্ত অ-বন্ধুসুলভ আচরণ’ বলে গণ্য হবে। সেটা হবে ‘ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞারও’ শামিল। অতএব ভারত যেন দ্রুত তঁাদের হস্তান্তর করে।

রায় নিয়ে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত বিবৃতিটি ছিল সংক্ষিপ্ত ও সাবধানী। বলা হয়, ‘প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায় ভারত দেখেছে।’ দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়, ‘ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসাবে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতা-সহ বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থরক্ষায় ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই লক্ষ্যে সবার সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক স্থাপনে ভারত সচেষ্ট থাকবে।’ কিন্তু হাসিনাদের প্রত্যর্পণ নিয়ে একটি শব্দও তাতে নেই!

কূটনীতিতে অনেক কথা না-বলেও অনেক কিছু বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ভারতের এই সংক্ষিপ্ত বিবৃতির নির্যাসও তেমনই। প্রত্যর্পণের দাবি সম্পর্কে নীরবতার অর্থ ভারত আদৌ তা আমলে নিচ্ছে না। অথচ পাশাপাশি এটাও জানানো হল, প্রতিবেশীর সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক স্থাপনে
ভারত আগ্রহী। শান্তি, গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও অন্তর্ভুক্তির উল্লেখ করে ভারত বোঝাতে চেয়েছে বাংলাদেশের কাছে তার প্রত্যাশা কী। এই চাওয়ার চরিত্র কেমন, এর আগেও ভারত তা জানিয়েছে। সহজ কথায়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে যা কিছু করার তা হবে সে দেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে। সেই সরকারকে গণতান্ত্রিক হতে হবে। আর হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক।

হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র’ নিয়ে ভারত অবশ্য টুঁ শব্দ করেনি।
ধীরে ধীরে গণতন্ত্র জলাঞ্জলি দিয়ে হাসিনাও নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেন। ভারত
তঁাকে এর বিপদ বোঝায়নি। চরম কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছেন হাসিনা, ভারত নীরব দর্শক থেকেছে। বিরুদ্ধবাদীদের দমাতে অগণতান্ত্রিক হয়েছেন, ভারত সতর্ক করেনি।
সম্পর্কটা ক্রমেই ‘ট্রানজ‌্যাকশনাল’ হয়ে উঠেছিল। তুমি আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করো, পূর্ব সীমান্ত শান্ত রাখো, ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়ক হও, ট্রানজিট দাও, ধর্মীয় মৌলবাদীদের দমিয়ে রাখো, আমি তোমাকে গদিয়ান থাকতে সাহায্য করব, চোখ বন্ধ করে সমর্থন করে যাব– এইরকমই হয়ে দঁাড়িয়েছিল সম্পর্ক।

এই কারণে বিদ্যুৎ কেনাবেচার ক্ষেত্রে আদানিদের অন্যায্য ও অযৌক্তিক দাবি গিলতে হয়েছিল হাসিনাকে, যা ভারতকে আরও অপ্রিয় করে তুলেছে। আওয়ামী লীগের কাছে ‘নয়নের মণি’ হয়ে উঠলেও নরেন্দ্র মোদির ভারত অন্য বাংলাদেশিদের কাছে ক্রমেই ‘চোখের বালি’
হয়ে গিয়েছিল। নইলে এত ভারত-বিদ্বেষ ওপার বাংলায় জমা হত না। সেই বিদ্বেষে ঘৃতাহুতি দিয়েছে জুলাই বিপ্লবের পর ভারতে হাসিনার আশ্রয়লাভ।

তিক্ত হয়ে ওঠা সম্পর্ক কীভাবে স্বাভাবিক হতে পারে সেই গবেষণা এ-দেশে চললেও ওই বাংলাদেশ এখনও ভারতকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত নয়। ঐতিহাসিকভাবে সে দেশের স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি এখন ভারতের গাত্রদাহ বাড়াতে অনেক বেশি করে সম্পর্ক পাতাচ্ছে পাকিস্তান ও চিনের সঙ্গে। ভারতের বলিরেখা তাতে গাঢ় হচ্ছে।

নির্বাচন হলে কী হবে পরের কথা, সদ্য বাংলাদেশ ঘুরে এসে মনে হচ্ছে, ক্ষমতায় যারা-ই আসুক, ভারতকে কেঁচে গণ্ডুষ করতে হবে। সবকিছু ফের নতুনভাবে শুরু করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মন জেতার সবচেয়ে সহজ উপায় ভিসা স্বাভাবিক করা। আপামর বাংলাদেশির প্রথম দাবি এটাই। ভারতের উচিত এই বিষয়ে যত্নবান হওয়া।

অবশ্য এই মুহূর্তের রাজনৈতিক দাবি হাসিনার প্র‍ত্যর্পণ। দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে সেই ২০১৩ সাল থেকে। তিন বছর পর ২০১৬ সালে তা সংশোধন করে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও চুক্তিতে এমন কিছু ধারা রয়েছে, যেমন, যদি দেখা যায় অভিযোগ ন্যায়বিচারের স্বার্থে বা সরল বিশ্বাসে আনা হয়নি কিংবা অভিযোগ রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক অথবা তা সামরিক অপরাধমূলক যা ফৌজদারি আইনের পরিধিতে পড়ে না, তাহলে প্রত্যর্পণের অনুরোধ খারিজ করা যায়। সহজ কথায়, ভারত যদি মনে করে হাসিনা ও-দেশে সুষ্ঠু বিচার পাবেন না, তাহলে চুক্তি সত্ত্বেও তাঁকে ফেরত না দেওয়ার অধিকার ভারতের থাকছে।

বাংলাদেশও তা জানে। তবু জেনেশুনেও তাদের এই দাবি জানাতেই হবে। দেশবাসীকে দেখাতে হবে ‘পতিত স্বৈরাচারী’-কে দেশে ফেরত আনার চেষ্টায় তারা ঘাটতি রাখছে না। ভারতও বুঝিয়েছে, হাসিনা বন্ধু। বিপদের দিনে বন্ধুর পাশে না দঁাড়ালে পৃথিবীর আর কোনও বন্ধু দেশের নেতা ভারতকে বিশ্বাস করবে না। ৬৬ বছর ধরে দলাই লামা সদলে ভারতে রয়েছেন।

আং সান সু চি-কেও ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। নেহরুর নির্দেশে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বিজু পট্টনায়ক ডাচদের হাতে বন্দি সুকর্ণকে জাকার্তা থেকে উদ্ধার করে ভারতে নিয়ে এসেছিলেন। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহ ও তাঁর পরিবারকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। মুজিব-হত্যার পর হাসিনা ও তঁার বোন রেহানাকে জার্মানি থেকে উড়িয়ে ভারতে এনেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। আশ্রয় দিয়েছিলেন তঁাদের। তৃতীয় কোনও দেশে চলে না গেলে, অথবা কোনও একদিন বীরদর্পে দেশে ফিরে না গেলে– ভারতই হতে চলেছে হাসিনার বাকি জীবনের ঠিকানা। সেটা মেনে নিয়েই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশকে সম্পর্ক স্থাপনের রাস্তায় হাঁটতে হবে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা রুজু হয়েছিল গত বছরের ১৭ অক্টোবর।
  • দেশবাসীকে দেখাতে হবে ‘পতিত স্বৈরাচারী’-কে দেশে ফেরত আনার চেষ্টায় তারা ঘাটতি রাখছে না।
Advertisement