মহম্মদ ইউনুসের ‘ক্যাঙারু কোর্ট’-এর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ ‘বঙ্গবন্ধু’-কন্যাকে আবার
আলোয় ফিরিয়ে নিয়ে এল। যে-সরকার নিজেরাই ‘নির্বাচিত’ নয়, যে-সরকারের কোথাও কোনও ‘বৈধতা’ নেই, তা যদি একজন ‘দেশত্যাগী’ নেত্রীর অনুপস্থিতিতে তাঁকে বিচার করে, তাহলে সেই বিচার পৃথিবীর কোথাও কোনও গুরুত্ব পায় না। মুজিব পরিবার চিরকাল ভারতের ‘বন্ধু’ ছিল, আছে এবং থাকবে। লিখছেন সৈয়দ তানভীর নাসরীন।
‘আমি ফিরে যাব। মুজিবের পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে কখনও থাকতে পারে না। আপনি যে সাহায্য করছেন, তা কোনও দিন ভুলব না। কিন্তু আওয়ামী লীগ করতে গেলে, বাংলাদেশের মাটিতে দঁাড়িয়েই লড়াইটা হবে।’ ইন্দিরা গান্ধী নাকি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আততায়ীদের হাতে নৃশংসভাবে পুরো পরিবারকে হারানো এক তরুণীর এহেন ‘জেদ’ দেখে। ভারতের ‘লৌহমানবী’ মুজিব-কন্যার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘নিশ্চিন্তে থাকো, ভারত তোমার পাশে আছে।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ৩২, ধানমণ্ডিতে সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর যখন ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের জীবিত কন্যা শেখ হাসিনাকে ইউরোপ থেকে দিল্লিতে ফেরত আনা হয়েছিল, তখন নাকি ‘বঙ্গবন্ধু’-র জ্যেষ্ঠ কন্যার সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এরকম একটি কথোপকথন হয়েছিল। গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ, এবং ‘বঙ্গবন্ধু’-র পরিবারের সঙ্গেও পরিচিত, আমার আত্মীয় যে বর্ষীয়ান সাংবাদিক সেদিন দিল্লিতে ছিলেন, তাঁর কাছে এতবার শেখ হাসিনার চোয়ালচাপা জেদের কথা শুনেছি যে, সোমবার ঢাকার আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে শুনে আবার সেই স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
বিশ্ব রাজনীতিতে গত ১০০ বছরে যে-ক’জন মহিলা উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখেছেন, শেখ হাসিনা অবশ্যই তার মধ্যে অন্যতম। আমি বিশ্বাস করি, যেসব বিতর্কের জন্য শেখ হাসিনার ছবিতে ধুলো জমেছিল, সোমবার নোবেলবিজয়ী মহম্মদ ইউনুসের ‘ক্যাঙারু কোর্ট’-এর মৃত্যুদণ্ডের
আদেশ সেসব মলিনতাকে ঝেড়ে ফেলে আবার ‘বঙ্গবন্ধু’-কন্যাকে আলোয় ফিরিয়ে নিয়ে এল।
যে-সরকার স্বয়ং ‘নির্বাচিত’ নয়, যে-সরকারের কোথাও কোনও ‘বৈধতা’ নেই, তা যদি একজন দেশত্যাগী নেত্রীর অনুপস্থিতিতে তাঁকে বিচার করে, তাহলে সেই বিচার পৃথিবীর কোথাও কোনও গুরুত্ব পায় না।
এই পর্যন্ত পড়ে যদি কারও মনে হয়, আমি শেখ হাসিনার বিরাট ‘অনুরাগী’ এবং মহম্মদ ইউনুসকে ‘শত্রু’ ঠাওরেছি, তাহলে ভুল করবেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের
তথাকথিত প্রধান উপদেষ্টা বরং আমার শহর বর্ধমানের জামাই, তঁার স্ত্রী বর্ধমান মিউনিসিপাল গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। যে-স্কুলে তঁাকেও পড়িয়েছিলেন আমার দিদিমা। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন লেখায় আমি শেখ হাসিনার শাসনপদ্ধতিকে সমালোচনা-ই করেছি।
কিন্তু তাই বলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের অবদান বা পাকিস্তানকে ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরির তাৎপর্য বুঝব না– এতটা ‘বেওয়াকুফ’-ও আমি নই। সেই কারণেই, মার্গারেট থ্যাচার, ইন্দিরা গান্ধী, কোরাজন আকিনো, অং সাং সু কি-র মতো মহিলা নেত্রীর পাশে চিরকাল শেখ হাসিনার নাম লেখা থাকবে। বাংলাদেশের বর্তমান মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে থাকা সরকারের তৈরি করা আদালতের মৃত্যুদণ্ড বরং মুজিব-কন্যাকে আরও ঔজ্জ্বল্য দিয়ে গেল। যে-দেশের শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, সেই দেশে কোনও আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সামনে দঁাড়িয়ে যখন দেশান্তরী মুজিব-কন্যা মনে করিয়ে দেন– তঁার এই জীবন দিয়েছেন ‘আল্লাহ্’, তখন বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না তিনি ঠিক কী ‘বার্তা’ দিতে চাইছেন।
তিনি তঁার ‘মুসলিম আইডেনটিটি’-র কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, আবার ‘বঙ্গবন্ধু’-র তৈরি করা ‘বাঙালি আইডেনটিটি’-র তিনিই যে ধারক এবং বাহক– সেই কথাও বুঝিয়ে দিতে কোনও চেষ্টার কসুর রাখেননি। মার্গারেট থ্যাচার থেকে সু কি, এবং এই তালিকায় যদি আমরা শ্রীলঙ্কার সিরিমাভো বন্দরনায়েকেকেও জুড়ে নিই– তাহলে দেখতে পাব– এই মহিলা নেত্রীদের জীবনে নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতের অভাব কোনও দিন ছিল না। বন্দরনায়েকে, ফিলিপাইনসের কোরাজন আকিনো, মায়ানমারের সু কি– এই মহিলানেত্রীদের সবার পরিবারের কেউ না কেউ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকারও হয়েছে। আমি ইচ্ছা করেই ইন্দিরা গান্ধী আর শেখ হাসিনার উদাহরণটা পরে দিচ্ছি, যেখানে পরিবারের ইতিহাসের সঙ্গে আততায়ীর হামলা, রক্ত– এসব আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। বন্দরনায়েকে, আকিনো, সু কি– এঁরা সব রক্তের হোলি খেলাকে অতিক্রম করেই কুর্সি পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। শেখ হাসিনাও সেই একই ধারা বহন করেন। এশিয়ার এসব মহিলা নেত্রীর সঙ্গে ওয়াশিংটনের কোনও দিনই সুসম্পর্ক ছিল না।
অর্থাৎ, ‘স্যাম চাচা’-র হুকুমদারিকে উপেক্ষা করেই এঁরা চিরকাল রাজনীতি করেছেন, সরকার চালিয়েছেন। আর, মায়ানমারের সেনাবাহিনী হোক কিংবা বাংলাদেশের অন্য কোনও রাজনৈতিক শক্তি, তারা সবসময়ই অভিযোগ করেছে, ভারত, ভারতের গণতন্ত্র সু কি অথবা শেখ হাসিনাকে মদত দিচ্ছে। সোমবারও হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়ে ইউনুস প্রশাসনের দাবি এবং নয়াদিল্লির ‘সপাটে জবাব’ আমাকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আর-একবার ভারতের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গেল। নিজে কিছু দিন কূটনৈতিক মিশনে কাজ করেছি বলে আমি কূটনৈতিক বিবৃতির প্রতিটি শব্দ এবং ‘অনুচ্চারিত অক্ষরগুলি’-কে পড়তে পারি।
এটা সত্যি, রাজনীতিতে এবং কূটনীতিতেও ‘পার্মানেন্ট এনিমি’ বা ‘চিরশত্রু’ বলে কোনও শব্দ নেই। সেজন্যই তালিবান বিদেশমন্ত্রীকে নয়াদিল্লি লাল গালিচা পেতে অভ্যর্থনা জানাতে পারে। কিন্তু যে-কথাটা কেউ বলে না, ভারতের রাজনীতি, ভারতের কূটনীতির দীর্ঘ ইতিহাস অনুধাবন করে মনেও করিয়ে দেওয়া হয় না যে– ‘বন্ধু’কে কখনও বিসর্জন দেওয়া যায় না। তাহলে পরে ‘বন্ধু’ হওয়ার আগে কেউ দশবার ভাববে।
ঢাকার সোশ্যাল মিডিয়া পণ্ডিতরা, যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অবধি ‘মুসলিম বিদ্বেষী’ সাজিয়ে দিতে পারেন, তাঁরা বোঝেন না মুজিব পরিবার চিরকাল ভারতের ‘বন্ধু’ ছিল, আছে এবং থাকবে। মুজিব পরিবার সব অর্থেই ভারতের ‘চিরসখা’। আর সে-কারণেই শেখ হাসিনা কিংবা মালদ্বীপের সব হারিয়ে ফেলা নেতা মহম্মদ নাশিদ চিরকাল দিল্লির হৃদয়ের মণিকোঠায় রাখা হীরেই রয়ে যাবেন।
গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশে কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, তার নেপথ্যে আওয়ামী লীগের কতখানি ‘ভুল’ ছিল, আমেরিকা কতটা ‘কলকাঠি’ নেড়েছিল– এই চুলচেরা হিসাবে নভেম্বরের এক শীতের সন্ধ্যায় আমি ঢুকতে চাই না। কিন্তু একজন ‘ভারতীয়’ হিসাবে, একজন ‘মহিলা’ হিসাবে, এবং অবশ্যই একজন মুসলমান হিসাবে আমি বিশ্বাস করি– সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে আমাদের মৌলবাদ, আধিপত্যবাদ এবং সংখ্যালঘুকে কোণঠাসা করার চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়তে হয়। সেই লড়াই একদিনের নয়, আর সহজে সেই লড়াইতে ‘শত্রুপক্ষ’ হারও মানবে না। কিন্তু আমরা যারা নিজেকে ‘মুক্তমনা’ বলে বিশ্বাস করি, নেহরু এবং গান্ধীকে হৃদয়ে ধারণ করি, তারা জানি এই লড়াই চলবে।
মৌলবাদের বিপক্ষে, মহিলাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন চেহারায়।
মালদ্বীপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাশিদ মাঝে মাঝেই আমাকে সরস ভঙ্গিতে গল্প শোনাতেন, কীভাবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি রাজধানী মালেতে ভারতীয় দূতাবাসে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত নাশিদকে জেলে যেতে হয়েছিল, হাসিনার মতোই তাঁর উপরও গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, কিন্তু বরিস জনসনের বন্ধু ওই মালদ্বীপীয় রাজনীতিবিদ আবার ভোটে লড়েই তাঁর দলকে ক্ষমতায় ফিরিয়েছিলেন। যে-মহাদেশে পাকিস্তান আছে, ইসলামাবাদের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই আছে, সেখানে লড়াই চলতেই থাকবে।
